‘বিতর্কিত’ চট্টগ্রাম-নোয়াখালীর মাঠের লড়াইও বিতর্কিত হবে না তো?
- ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:২৮
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ–সংক্ষেপে বিপিএল। নামের সঙ্গে ‘প্রিমিয়ার’ থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘বিতর্ক’ যেন এই টুর্নামেন্টের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই ক্রীড়াঙ্গনে রসিকতা করে অনেকেই একে ‘বিতর্ক প্রিমিয়ার লিগ’ও বলেন। বছর বদলায়, আসর বাড়ে, দল বদলায়–কিন্তু বিতর্কের ছায়া থেকে মুক্তি মেলে না। তবুও সব সমালোচনা একপাশে রেখে প্রতি মৌসুমেই নতুন করে স্বপ্ন দেখেন ক্রীড়াপ্রেমীরা। ক্রিকেটারদের কাছেও বিপিএল মানে ঘরোয়া ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় মঞ্চ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এবারও মাঠে বল গড়ানোর আগেই বিতর্কের ঘন মেঘে টইটুম্বর ঘরোয়া এই টুর্নামেন্টটি।
এবারের বিপিএলে নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজি নোয়াখালী এক্সপ্রেস। প্রথমবারের মতো আসরে নামতে যাওয়া ফ্র্যাঞ্চাইজিটিকে ঘিরে শুরুতেই ছিল প্রবল উত্তেজনা। নতুন দল, নতুন পরিচয়, নতুন স্বপ্ন–সব মিলিয়ে সমর্থকদের আগ্রহও ছিল চোখে পড়ার মতো। সেই আগ্রহে আরও রং চড়ান জনপ্রিয় অভিনেতা জিয়াউল হক পলাশ, দলটির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে যুক্ত হন তিনি। তবে সময়ের পরিক্রমায় আশার জায়গায় ততই ভর করছে প্রশ্নচিহ্ন। দল গঠন, ব্যবস্থাপনা, আর্থিক বিষয়–একের পর এক অপ্রত্যাশিত ইস্যু সামনে আসায় নোয়াখালী দ্রুতই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু থেকে সমালোচনার কেন্দ্রে ঠাই করে নেয়।
আসরের আরেক ‘বিতর্কিত’ অধ্যায় চট্টগ্রাম রয়্যালস। টুর্নামেন্ট উদ্বোধনের ঠিক আগের দিন ফ্র্যাঞ্চাইজিটির মালিকানা ছেড়ে দেয় ট্রায়াঙ্গল সার্ভিসেস। হঠাৎ এই সিদ্ধান্তে কার্যত বিপাকে পড়েন ক্রিকেটার থেকে শুরু করে ক্রিকেটের নিয়ন্তা সংস্থাও। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই বিপিএলের অভিভাবক সংস্থা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে (বিসিবি) দায়িত্ব নিতে হয়। দায়িত্ব নিয়ে দ্রুতই টিম ডিরেক্টর হিসেবে হাবিবুল বাশার সুমন, প্রধান কোচ হিসেবে মিজানুর রহমান বাবুল এবং ম্যানেজার হিসেবে নাফিস ইকবালকে নিয়োগ দেয় বোর্ড। এ ছাড়া শেখ মেহেদীর হাতে অধিনায়কত্বের গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়।
তবে ব্যবস্থাপনা বিসিবির কাছে এলেও সংকট কাটেনি চট্টগ্রামের। টুর্নামেন্ট শুরুর মুহূর্তে দলটিতে বিদেশি ক্রিকেটার মাত্র দু’জন। যদিও টিম ডিরেক্টর হাবিবুল বাশার বলছেন, নতুন করে বিদেশি খেলোয়াড় খোঁজা হচ্ছে।
এদিকে একই সময়ে দুবাইয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিগ টি–টোয়েন্টি, অস্ট্রেলিয়ায় বিগ ব্যাশ ও দক্ষিণ আফ্রিকায় এসএ টোয়েন্টি চলায় মানসম্মত বিদেশি ক্রিকেটার পাওয়া যে সহজ হবে না, তা-ও স্বীকার করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে মাঠে নামার আগেই চট্টগ্রাম রয়্যালস যে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে, তা বলাই বাহুল্য।
কিন্তু সবচেয়ে উদ্বেগ ও আশ্চশ্যের বিষয়, বিতর্কে জড়ানো এই দলগুলোর মাঠের লড়াই নিয়েও তৈরি হচ্ছে শঙ্কা। একদিকে নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজি নোয়াখালীর ব্যবস্থাপনা ও প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন, অন্যদিকে মালিকানাহীন অবস্থায় বিসিবির তত্ত্বাবধানে নামতে যাওয়া চট্টগ্রাম–সব মিলিয়ে দুই বিতর্কিত দলের মুখোমুখি লড়াইও যে বিতর্ক এড়িয়ে যেতে পারবে, এর নিশ্চয়তা নেই। মাঠের পারফরম্যান্স কি সব প্রশ্নের জবাব দেবে, নাকি বিপিএলের ইতিহাসে আরও একটি বিতর্কিত অধ্যায় যোগ হবে, তা নিয়েও উঠছে নানা প্রশ্ন।
অবশ্য, নানা নেতিবাচক কারণে বারবার শিরোনামে উঠলেও চট্টগ্রামের বোলিং আক্রমণকে কোনোভাবেই হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। মাঠের বাইরের আলোচনার আড়ালে কাগজে-কলমে চট্টগ্রামের বোলিং ইউনিট বেশ ভারসাম্যপূর্ণ ও অভিজ্ঞতায় ভরপুর।
স্পিন বিভাগে দলটির বড় শক্তি অধিনায়ক শেখ মেহেদী ও তানভীর ইসলাম। দুজনই সাদা বলের ক্রিকেটে জাতীয় দলের হয়ে নিয়মিত মুখ। পাওয়ারপ্লে থেকে ডেথ ওভার; ম্যাচের যেকোনো মুহূর্তে বল করার সামর্থ্য আছে তাদের। বাংলাদেশের কন্ডিশনে তাদের নিয়ন্ত্রিত লাইন-লেন্থের জুড়ি নেই।
এই স্পিন আক্রমণকে আরও সমৃদ্ধ করেছে অভিজ্ঞ শুভাগত হোম ও আরাফাত সানি। অলরাউন্ড দক্ষতায় প্রয়োজনে ব্রেক-থ্রু এনে দিতে পারেন গুভাগত, অন্যদিকে মাঝের ওভারগুলোতে রানের গতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম বাঁহাতি আরাফাত।
পেস বোলিংয়ে সবচেয়ে বড় নাম শরীফুল ইসলাম। নতুন বলে সুইং ও বাউন্স কাজে লাগিয়ে প্রতিপক্ষের শীর্ষ সারির ব্যাটসম্যানদের বিপাকে ফেলতে পারেন তিনি। শরীফুলের সঙ্গে পেস আক্রমণে আছেন অভিজ্ঞ আবু হায়দার। বিপিএলে ৭৩ ম্যাচ খেলে ৭৮ উইকেট নেওয়া এই বাঁহাতি পেসার ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে নির্ভরযোগ্য মুখ।
অন্যদিকে নোয়াখালীর পেস বোলিং ইউনিট শক্তিও তুলনামূলকভাবে বেশ ভালোই বলা যায়। স্থানীয় ক্রিকেটারদের মধ্যে হাসান মাহমুদ, মেহেদী হাসান রানা, মুশফিক হাসান ও রেজাউর রহমান নিয়মিতই ঘরোয়া ক্রিকেটে নির্দিষ্ট ভূমিকা রাখছেন। নতুন বলে গতি ও আগ্রাসনে সক্ষম হাসান, অন্যদিকে মিডল ওভারে নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে বেশ কার্যকর রানা ও মুশফিক।
আরও পড়ুন : পাঁচ ক্রিকেটারের নাম প্রত্যাহারের নেপথ্যে ভিন্ন ‘দুর্গন্ধ’, উঠছে প্রশ্ন
এই স্থানীয় পেস আক্রমণকে আরও শক্তিশালী করেছে বিদেশি দুই পেসার। পাকিস্তানের ফাস্ট বোলার ইহসানউল্লাহ খান তার গতির জন্য পরিচিত, যা প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের জন্য বাড়তি চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে, এর সঙ্গে আছেন আফগান পেসার বিলাল সামি। সব মিলিয়ে পেস বিভাগে বিকল্প ও গভীরতা, দুটোই আছে নোয়াখালীর।
তবে স্পিন বিভাগে নোয়াখালীর অবস্থান তুলনামূলকভাবে দুর্বল। বাঁহাতি স্পিনার আবু হাশিম জাতীয় লিগ টি-টোয়েন্টিতে ভালো পারফরম্যান্স করলেও বিপিএলের মতো বড় মঞ্চে এটি তার প্রথম সুযোগ। আরেক বাঁহাতি স্পিনার নাজমুল ইসলাম তার সেরা সময় অনেক আগেই পার করে এসেছেন, তাই আগের মতো প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।
দলে আফগানিস্তানের রহস্য স্পিনার জহির খান থাকলেও একার পক্ষে পুরো স্পিন আক্রমণের ভার বহন করা কঠিন। তার উপস্থিতি কিছুটা বৈচিত্র্য আনলেও সামগ্রিকভাবে নোয়াখালীর স্পিন ইউনিট প্রত্যাশা জাগাতে পারছে না। এ ছাড়া অলরাউন্ডার মোহাম্মদ নবি এখনো নোয়াখালী শিবিরে যোগ দেননি।
চট্টগ্রামের ব্যাটিং ইউনিটও সেভাবে প্রত্যাশার আলো ছড়াতে পারছে না। নিলাম থেকে এক কোটি ১০ লাখ টাকায় ওপেনার মোহাম্মদ নাঈমকে দলে ভেড়ায় চট্টগ্রাম। বড় অঙ্কের এই বিনিয়োগে ব্যাটিং বিভাগে স্থিতি ফেরানোর প্রত্যাশা থাকলেও বাস্তবে দলটির সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার জায়গা ব্যাটিং লাইনআপই। বিশেষ করে টপ-অর্ডারে ধারাবাহিক পারফর্মার না থাকার বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করেন টিম ডিরেক্টর হাবিবুল বাশার সুমন। তার মতে, ব্যাটসম্যানের অভাব স্পষ্টভাবে অনুভূত হচ্ছে। এই ঘাটতি পূরণে চট্টগ্রাম রয়্যালসের বড় ভরসা হতে পারেন বিদেশি ক্রিকেটাররা।
স্থানীয় ক্রিকেটারদের দিকে তাকালে, আলোচনায় মাহমুদুল হাসান জয়। মূলত টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবেই পরিচিতি তিনি, তবে সাম্প্রতিক সময়ে সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটেও নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিচ্ছেন। সর্বশেষ এনসিএল টি-টোয়েন্টিতে ৮ ম্যাচে ১৫৫ দশমিক ২৮ স্ট্রাইক রেটে ৩২৩ রান করে নজর কাড়েন জয়। ওই টুর্নামেন্টে তার ব্যাট থেকে দুটি ফিফটির পাশাপাশি একটি সেঞ্চুরিও দেখা যায়।
অন্যদিকে নোয়াখালীর ব্যাটিং বিভাগ যথেষ্ট সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী। টপ-অর্ডারে আছেন সৌম্য সরকার, জনসন চার্লস, কুশল মেন্ডিস এবং হাবিবুর রহমান সোহারান। আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে দক্ষতার কারণে নিলামে ভালো দামে সোহানকে দলে নেয় নোয়াখালী। সম্প্রতি এশিয়া কাপ রাইজিং স্টারসে মাত্র ৩৫ বলে বাংলাদেশের দ্রুততম সেঞ্চুরি করে এই তরুণ ব্যাটসম্যান সবার নজর কাড়েন। যদিও সিলেট পর্বে সৌম্য সরকারের সার্ভিস পাচ্ছে না ফ্র্যাঞ্চাইজিটি।
টপ-অর্ডারের পাশাপাশি মিডল-অর্ডারও বেশ ভালো দলটির। মাহিদুল ইসলাম অঙ্কন, জাকের আলী অনিক, অধিনায়ক সৈকত আলী ও হায়দার আলীর মতো ব্যাটাররা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দলকে চাপমুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে রান গড়ার দায়িত্বও নিতে সক্ষম।
সবমিলিয়ে নানা জটিলতা, চাপের মুহূর্ত এবং দলগত সমন্বয়—এই সবকিছুকে সামলে নিজেদের প্রথম ম্যাচে নোয়াখালী-চট্টগ্রাম দল কতটা পারফরম্যান্স দিতে পারবে, সেটাই দর্শক ও সমালোচকদের নজরের মূল বিষয়।