প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের ওপর হামলা, স্বাধীন তদন্তের আহ্বান বিসিএসএনএ’র

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি © সংগৃহীত

ঢাকায় প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের কার্যালয়ে সংঘটিত সহিংস হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে আমরা, উত্তর আমেরিকায় অবস্থানরত বাংলাদেশি যোগাযোগবিদদের সংগঠন বাংলাদেশি কমিউনিকেশন স্কলার্স ইন নর্থ আমেরিকা (BCSNA)। সেই সঙ্গে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, সাংবাদিক ও কর্মীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, এবং এডিটরস কাউন্সিলের সভাপতি ও ডেইলি নিউ এজ-এর সম্পাদক নুরুল কবিরের ওপর শারীরিক নির্যাতন বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর এক গুরুতর আঘাত বলে মন্তব্য করেছে সংগঠনটি।

আজ শনিবার (২০ ডিসেম্বর) সকালে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে শত শত লোকের একটি উন্মত্ত দল কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে হামলা চালায়। তারা অফিসের বিভিন্ন অংশ ভাঙচুর করে, যন্ত্রপাতি ধ্বংস করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়—এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়ভাবে অনুপস্থিত। সাংবাদিক ও কর্মীদের আগুন নেভাতে বাধা দেওয়া হয়। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই হামলার কারণে শুক্রবার প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার উভয়ই নিয়মিত অনলাইন ও মুদ্রিত প্রকাশনা বাতিল করতে বাধ্য হয়। এর কিছুক্ষণ পর হামলাকারীরা দ্য ডেইলি স্টারের কার্যালয়ের দিকে অগ্রসর হয়, সেখানে কাচের প্যানেল ভেঙে ফেলে, আসবাবপত্র রাস্তায় টেনে এনে আগুন ধরায় এবং উসকানিমূলক স্লোগান দেয়। পরিস্থিতি আরও অবনতি হলে রাতের শিফটে কর্মরত কয়েক ডজন কর্মী ছাদে আটকা পড়েন। দমকল বাহিনী জানায়, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সহায়তা ছাড়া তারা কাজ করতে পারেনি; শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো প্রতিবাদ ছিল না; বরং সমন্বিত হামলা—যার উদ্দেশ্য ছিল ভয় ও ধ্বংসের মাধ্যমে স্বাধীন সাংবাদিকতাকে স্তব্ধ করা এবং যা মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, যোগাযোগ, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার গবেষক হিসেবে আমরা বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ ও কঠিন সংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন। দেশের গণমাধ্যম ইতিহাস নথিবদ্ধ করা, প্রান্তিক কণ্ঠস্বরকে তুলে ধরা এবং জনপরিসরে বিতর্ককে উসকে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কয়েক দশক ধরে প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের মতো গণমাধ্যম অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় স্বাধীনতা ও জনপরিসরের জন্য অপরিহার্য পেশাগত মানদণ্ডে অবদান রেখে আসছে। তাদের লক্ষ্য করে আঘাত করা মানে নাগরিকদের জানার সামষ্টিক অধিকারের ওপর আঘাত হানা। পরিহাসের বিষয় হলো, যে উন্মত্ত জনতা দুইটি পেশাদার গণমাধ্যমে ক্ষতি সাধন করেছে, সেগুলোই ছিল পতিত হাসিনা শাসনের—একটি স্বৈরতন্ত্রের—বিরুদ্ধে সোচ্চার; যে শাসন এক দশক ধরে একই কাজ করার চেষ্টা করেছিল। এ ধরনের নৃশংসতা জুলাইয়ের যে চেতনার প্রতিনিধিত্বের দাবি ভাঙচুরকারীরা করে, তার অর্জনকেই ধ্বংস করে।

সাংবাদিক ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের জন্য সময়মতো সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের দৃশ্যমান ব্যর্থতা এবং জরুরি সেবা কার্যক্রমে বাধা দেওয়ার প্রতিবেদনে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এই একই সরকার তাদের নিজস্ব গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের চিহ্নিত ও সংস্কারের সুপারিশকৃত কোনো বিষয়—এর মধ্যে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও সাংবাদিকতাকে একটি পেশা হিসেবে সুরক্ষার প্রশ্নও রয়েছে—সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করা এবং যারা তা চর্চা করেন তাদের সুরক্ষা দেওয়া রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। এর মধ্যে সহিংসতা প্রতিরোধ, হুমকিতে দ্রুত সাড়া দেওয়া, সাংবাদিক ও কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনা অন্তর্ভুক্ত। সংবাদমাধ্যমের ওপর হামলায় দায়মুক্তি কেবল আরও সহিংসতাকেই আমন্ত্রণ জানায়।

আমরা কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাই—প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের ওপর হামলার ঘটনায় দ্রুত, স্বাধীন ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত পরিচালনা করতে এবং পরিকল্পনা, উসকানি ও বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত সকল দায়ীদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনতে। আমরা সাংবাদিক, সম্পাদক, কর্মী ও জরুরি সেবাদানকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানাচ্ছি; উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে গণমাধ্যম কার্যালয়গুলোর জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করাও এর অংশ। একই সঙ্গে রাষ্ট্রকে সংবিধানিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত ও বাস্তবায়নের আহ্বান জানাই—যাতে সাংবাদিকরা প্রতিশোধের ভয় ছাড়াই কাজ করতে পারেন।

সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষমতার দেওয়া কোনো বিশেষাধিকার নয়; এটি সমাজের অর্জিত ও রক্ষিত অধিকার। নিউজরুমে হামলা মানে গণতন্ত্রের ওপর হামলা। আমরা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক শক্তি, নাগরিক সমাজ ও সাধারণ নাগরিকসহ সকল অংশীজনের প্রতি সহিংসতা প্রত্যাখ্যান, সাংবাদিকদের সুরক্ষা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও আইনের শাসনের নীতিমালা পুনর্ব্যক্ত করার আহ্বান জানাই। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ এর ওপরই নির্ভরশীল।

বিবৃতিতে উত্তর আমেরিকায় অবস্থানরত বাংলাদেশি কমিউনিকেশন স্কলার্স (BCSNA) সদস্যদের পক্ষে স্বাক্ষর করেন ড. ফাহমিদুল হক, ড. আনিস রহমান, ড. মো. খাদিমুল ইসলাম, ড. মোহাম্মদ রশিদ, ড. দাউদ ইসা, ড. খাইরুল ইসলাম, ড. জামাল উদ্দিন, ড. নূর ই. মকবুল, ড. নাজমা আখতার, ড. এম. ডি. আশরাফুল গনি, ড. জাহেদ আরমান, ড. আহমেদ শাতিল আলম, মীর ফজলা রাব্বী, শেরিন ফারহানা মনি, মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, কাজী মেহেদী হাসান, মীর হাসিব, মানজুর মাসউদ, হাসান ফয়সাল, প্রিয়াঙ্কা কুন্ডু, মামুনর রশিদ, মাহবুবুল হক ভূঁইয়া, সাজ্জাদ মাহমুদ শুভ, জেনিফার কামাল নোভা,এইচ. এম. এম. মুরতুজা, মো. আজাদ, শাহ জাহান শুভ, মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, ছোটন দেব নাথ, মাহেদী হাসান, শায়না ফারহিন, বেলাল মুনতাসির, মো. সুমন আলী প্রমুখ।