মেডিকেলে ভর্তি
৫ যমজ, সবাই ছাত্রী— একসঙ্গে সত্যি হলো দশ স্বপ্ন
- টিডিসি রিপোর্ট
- ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫:৪৪
একই দিনে জন্ম, একইসঙ্গে বড় হওয়া— এবার একসঙ্গে দশ সাফল্যের গল্প লিখলেন দেশের চার জেলার পাঁচ জোড়া যমজ বোন। ২০২৫–২৬ শিক্ষাবর্ষের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তারা সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। তাদের এই সাফল্যে পরিবার, স্বজন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আনন্দের জোয়ার বইছে।
দিনাজপুরের মাখনুন ও মুসফিকা:
দিনাজপুরের বোচাগঞ্জে ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষে সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন যমজ দুই বোন মাখনুন আক্তার ও মুসফিকা নাজনিন। তাদের মধ্যে মাখনুন ভর্তি পরীক্ষায় ৮২ দশমিক ৫ নম্বর পেয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও মুসফিকা ৮০ দশমিক ৫ নম্বর পেয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। তারা সেতাবগঞ্জ সরকারি পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ অর্জন করেন।
ছোটবেলা থেকেই ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা ছিল জানিয়ে মাখনুন বলেন, মা-বাবার সহযোগিতা ছাড়া এই সাফল্য সম্ভব হতো না। বড় বোন সবসময় আমাদের পাশে ছিল। আর বাবারও ইচ্ছা ছিল আমি যেন ডাক্তার হয়ে দেশের মানুষের সেবা করতে পারি।
নাজনিন বলেন, ‘আমরা দুই বোনই একসঙ্গে মেডিকেলে চান্স পেয়েছি, এতে আমরা খুব আনন্দিত। ভবিষ্যতে একজন ভালো ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে চাই।
তাদের বাবা মশিউর রহমান মুরারিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী। মেয়েদের সাফল্য নিয়ে তিনি বলেন, আমার তিন মেয়ে, কোনো ছেলে নেই। কিন্তু আমি কখনো আক্ষেপ করিনি। আমি বিশ্বাস করি, সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে—শিক্ষাই আসল পরিচয়। আল্লাহ তাআলা আমার ইচ্ছা পূরণ করেছেন। তারা যেন ভালো ডাক্তার হয়ে দেশ ও মানুষের সেবা করতে পারে এই দোয়া চাই।
বোচাগঞ্জের সারাহ ও সামিহা:
দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার আরও এক যমজ এবারের মেডিকেল ভর্তিতে চান্স পেয়েছেন। তারা হলেন সাজ্জাদ হোসেন ও তাহারিমা আকতার দম্পতির যমজ মেয়ে মুতমাইন্না সারাহ এবং মুমতাহিনা সামিহা। সারাহ ঢাকার মুগদা মেডিকেল কলেজে এবং সামিহা সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছেন। তাদের বাড়ি জেলার বোচাগঞ্জ উপজেলার ২নং ইশানিয়া ইউনিয়নের রামপুর গ্রামে।
মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার অনুভূতি জানাতে গিয়ে দুই বোন জানান, পড়াশোনার ক্ষেত্রে তারা কখনো অতিরিক্ত চাপ বা দীর্ঘ সময় ধরে পড়ার পথে যাননি। ১৮-২০ ঘণ্টা টানা পড়াশোনার বদলে নিয়ম মেনে, মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি বিষয় বুঝে পড়াই ছিল তাদের কৌশল। ক্লাসে কখনো অনুপস্থিত না থাকা, শিক্ষকদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা ও নোট নেওয়া এসবই ছিল তাদের নিয়মিত অভ্যাস। বাসায় ফিরে সেগুলো আবার পড়ে নেওয়াই সাফল্যের মূল চাবিকাঠি বলে মনে করেন তারা।
মেয়েদের অর্জনে ভীষণ খুশি মা তাহারিমা আকতার বলেন, তাদের এক ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় ছেলে তাহমীদ বিন সাজ্জাদ বর্তমানে রংপুর মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। আর এবার যমজ দুই মেয়েও মেডিকেলে সুযোগ পাওয়ায় পরিবারে আনন্দ দ্বিগুণ হয়েছে।
প্রভাষক বাবা সাজ্জাদ হোসেন জানান, ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় মেয়েদের মধ্যে এক ধরনের সুস্থ প্রতিযোগিতা ছিল। কেউ পরীক্ষায় এক-দুই নম্বর কম পেলে পরের পরীক্ষায় তাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত অন্যজন। এই প্রতিযোগিতাই তাদের এগিয়ে নিয়েছে। এইচএসসি শেষ হওয়ার পর মেডিকেল প্রস্তুতিও তারা একসঙ্গে করেছে, একে অপরকে সহযোগিতা করেছে। তার ভাষায়, বাবা হিসেবে মেয়েদের এমন সাফল্য দেখা সত্যিই গর্বের এবং আবেগের।
ময়মনসিংহের মিহা ও লিহা:
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের কলেজ ও হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এম. কামরুজ্জামান মানিকের যমজ দুই মেয়ে ফাবিহা জামান মিহা ও লামিসা জামান লিহা সরকারি মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। তাদের মধ্যে ফাবিহা জামান মিহা ৮১.৭৫ নম্বর পেয়ে জাতীয় মেধায় ৮৭৩তম হয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়বেন। আর লামিসা জামান লিহা ৭৫ নম্বর পেয়ে জাতীয় মেধায় ৪৬৭৫তম হয়ে পড়বেন নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজে।
মিহা ও লিহা ময়মনসিংহ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ও ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। ২০২৩ সালের এসএসসি পরীক্ষায় মিহা ১২৪৭ নম্বর এবং লিহা ১২৪১ নম্বর, এইচএসসি-২০২৫ পরীক্ষায় মিহা ১১৯২ এবং লিহা ১১৮৫ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তারা দুই পরীক্ষাতেই মেধাবৃত্তি পান।
মিহা তার অনুভূতি জানিয়ে বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। মানবিক ডাক্তার হয়ে পরিবার, দেশ ও মানুষের সেবা করতে চাই’। আর লিহা বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। ডাক্তার হয়ে বাবার মতো মানুষের সেবা করতে চাই।’
রংপুরের নাজাহ ও নুবাহ:
রংপুরের মোতাহের মণ্ডল ও শাহানাজ বেগম দম্পতির যমজ দুই মেয়ে হাফসা ইসমাত নাজাহ কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজে এবং ও হাজ্জা ইসমাত নুবাহ নীলফামারী মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। তারা মিঠাপুকুর মডেল সরকারি বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং রংপুর সরকারি কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পাস করেছেন।
তাদের সাফল্যে মা শাহানাজ বেগম বলেন, দুই মেয়ে ছোটবেলা থেকেই মেধাবী। তাদের স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করা।
রংপুর সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ফিরোজুর রহমান বলেছেন, কলেজের ধারাবাহিক ভালো ফলাফলের অংশ হিসেবে দুই বোন মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন, যা সত্যিই আনন্দের খবর।
পঞ্চগড়ের পূজা ও পলি:
পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলা থেকে এক কৃষক বাবার জমজ দুই মেয়ে পূজা রানী রায় ও পলি রানী রায় মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। পূজা কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজে এবং পলি নীলফামারী মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য মনোনীত হয়েছেন।
তাদের মধ্যে পূজা কার্ডিওলজিস্ট ও পলি গাইনোকোলজিস্ট হতে চান।
বিনয়পুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ‘গোল্ডেন এ প্লাস’ পেয়ে এসএসসি ও ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ থেকে ‘গোল্ডেন এ প্লাস’ পেয়ে এইচএসসি পাস করেছেন। তারা ট্যালেন্টপুলে বোর্ড বৃত্তিও লাভ করেন।
দুই মেয়ের একসঙ্গে এই সাফল্যে মা-বাবা আবেগাপ্লুত। তারা বলেন, পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের ফলেই আজ তারা এই সাফল্য অর্জন করেছে। আমরা অত্যন্ত গর্বিত।