উই রিভোল্ড : রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান ও বিজয় দিবস
- ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:০১
১৬ ডিসেম্বর—বিজয় দিবস—বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে কেবল একটি স্মরণীয় তারিখ নয়; এটি একটি জাতির সাংবিধানিক বিজয়, সার্বভৌম অস্তিত্বের স্বীকৃতি এবং দীর্ঘ ২৪ বছরের সামরিক ও উপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়, তার ভিত্তি ছিল জনগণের সম্মিলিত বিদ্রোহ, আত্মত্যাগ ও রাজনৈতিক দৃঢ়তা। এই অর্থে বিজয় দিবস বাঙালি জাতির ইতিহাসে চূড়ান্ত বিদ্রোহের বিজয়—যার দর্শনকে এক কথায় প্রকাশ করা যায়: “We Revolt.”
এই “We Revolt” কোনো বিমূর্ত স্লোগান নয়; এটি ছিল একটি জাতির অস্তিত্ব-সংগ্রামের ঘোষণা। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও রাষ্ট্রীয় শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির সেই বিদ্রোহের কণ্ঠস্বর যাঁর মাধ্যমে প্রথম সুস্পষ্ট ও সংগঠিত রূপ পায়, তিনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ‘বীর উত্তম’ (১৯৩৬–১৯৮১)। ১৯৭১ সালের মার্চের ভয়াবহ গণহত্যা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিচ্ছিন্নতা এবং সর্বত্র আতঙ্কের পরিবেশে জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে জাতিকে একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক ও সামরিক প্ল্যাটফর্ম প্রদান করেন। তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত বিদ্রোহের আহ্বান—“বাংলাদেশ স্বাধীন, শত্রুকে প্রতিহত করো”—ই ছিল “We Revolt” দর্শনের বাস্তব রূপ।
জিয়াউর রহমান তাই শুধু মুক্তিযুদ্ধের একজন অংশগ্রহণকারী নন; তিনি ছিলেন বিদ্রোহকে রাষ্ট্রীয় সংগ্রামে রূপান্তরের অন্যতম কারিগর। যুদ্ধক্ষেত্রে সেক্টর কমান্ডার ও Z Force-এর ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে তাঁর নেতৃত্ব, এবং স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে গণতন্ত্র, জাতীয় ঐক্য ও স্বনির্ভরতার দর্শন—সব মিলিয়ে জিয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রনায়কোচিত উত্তরাধিকার নির্মাণ করেন। এই উত্তরাধিকার আজও বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক, বিশেষত তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর রাজনৈতিক দর্শন ও গণভিত্তির মধ্য দিয়ে।
২.১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত—বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গভীর অন্ধকারের মুহূর্ত। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মাধ্যমে শুরু হয় পরিকল্পিত গণহত্যা। ঢাকাসহ দেশের প্রধান শহরগুলোতে নির্বিচারে হত্যা, গ্রেপ্তার ও ধ্বংসযজ্ঞ চলতে থাকে। এই মুহূর্তে রাজনৈতিক নেতৃত্ব কার্যত বিচ্ছিন্ন—কেউ গ্রেপ্তার, কেউ আত্মগোপনে, কেউ যোগাযোগহীন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ভাষায় এটি ছিল একটি “Political Vacuum”—যেখানে একটি জনগোষ্ঠী বিদ্রোহে প্রস্তুত, কিন্তু সংগঠিত নেতৃত্ব অনুপস্থিত। এই সংকটময় মুহূর্তেই ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসেন মেজর জিয়াউর রহমান। ১৯৭১ সালের ২৬ ও ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তিনি ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এই ঘোষণাটি কেবল একটি বার্তা ছিল না; এটি ছিল একটি রাষ্ট্রের জন্মঘোষণা এবং সশস্ত্র প্রতিরোধের বৈধ আহ্বান।
এই ঘোষণার মাধ্যমে জিয়াউর রহমান তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন—প্রথমত, তিনি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বাঙালির সশস্ত্র বিদ্রোহকে রাজনৈতিক বৈধতা দেন। দ্বিতীয়ত, তিনি জাতিকে একটি সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও দিকনির্দেশনা দেন—স্বাধীনতা অর্জন। তৃতীয়ত, তিনি মুক্তিযুদ্ধকে একটি বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ থেকে সংগঠিত জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরের সূচনা করেন। এই অর্থে জিয়াউর রহমানের ঘোষণা ছিল “We Revolt” দর্শনের বাস্তব প্রকাশ—রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনগণের সম্মিলিত বিদ্রোহের ঘোষণা।
জিয়াউর রহমানের ভূমিকা ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন সক্রিয় সামরিক নেতা, যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি প্রথমে সেক্টর–১ এবং পরে সেক্টর–১১-এর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সেক্টরগুলোতে তিনি গেরিলা যুদ্ধ সংগঠিত করেন, স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মুক্তিযুদ্ধের সামরিক ইতিহাসে জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো Z Force ব্রিগেডের নেতৃত্ব। এটি ছিল মুক্তিবাহিনীর প্রথম সুসংগঠিত কনভেনশনাল (conventional) ব্রিগেড, যেখানে নিয়মিত সামরিক কাঠামো, শৃঙ্খলা ও কমান্ড সিস্টেম প্রতিষ্ঠিত হয়। Z Force-এর অধিনায়ক হিসেবে জিয়া শুধু গেরিলা কৌশলেই নয়, বরং সম্মুখসমরেও পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সফল অভিযান পরিচালনা করেন।
আরও পড়ুন: আজ মহান বিজয় দিবস, জাতির গৌরবময় দিন
সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, Z Force প্রমাণ করেছিল যে মুক্তিবাহিনী কেবল প্রতিরোধকারী নয়, বরং একটি কার্যকর যুদ্ধক্ষম বাহিনী। এই কৌশলগত সাফল্য আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে সহায়তা করে। ফলে জিয়াউর রহমানকে কেবল একজন যোদ্ধা নয়, বরং একজন কৌশলবিদ সামরিক নেতা (Strategic Military Leader) হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের সাহসিকতা, নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ রাষ্ট্র তাঁকে প্রদান করে ‘বীর উত্তম’ খেতাব। এই পদক শুধু ব্যক্তিগত সম্মান নয়; এটি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত একটি ঐতিহাসিক ঘোষণা—জিয়াউর রহমান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রীয় সামরিক নেতাদের একজন। ফলে তাঁর রাজনৈতিক ভূমিকা, বিশেষ করে পরবর্তীকালে রাষ্ট্রনায়ক ও দলীয় প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাঁর অবস্থান, একটি শক্তিশালী মুক্তিযুদ্ধ-উত্তরাধিকার দ্বারা সমর্থিত হয়।
জিয়াউর রহমানের “We Revolt” কেবল ১৯৭১-এর একটি তাৎক্ষণিক উচ্চারণ নয়; এটি একটি রাজনৈতিক দর্শন। এই দর্শনের মূল কথা হলো—অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, এবং জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতিষ্ঠা। এই দর্শনই পরবর্তীকালে তাঁর রাষ্ট্রনায়কোচিত কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হয়—একদলীয় শাসনের অবসান, বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জাতীয় ঐক্যের আহ্বান এবং অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার প্রচেষ্টা। একই দর্শন বিএনপি’র রাজনৈতিক আদর্শের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে। এই কারণেই বলা যায়, জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক হিসেবে শুধু একটি যুদ্ধের সূচনা করেননি; তিনি একটি রাজনৈতিক ঐতিহ্য নির্মাণ করেছেন—যার ভিত্তি বিদ্রোহ, গণতন্ত্র এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব। এই ঐতিহ্যই আজও বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক এবং বিএনপি’র জনপ্রিয়তার অন্যতম মূল উৎস।
৩. ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশে ছিল গভীর রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রশাসনিক ভাঙন এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের সংকটে নিমজ্জিত। একের পর এক অভ্যুত্থান, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতিতে রাষ্ট্র কার্যত “State of Near Collapse” অবস্থায় উপনীত হয়। এই প্রেক্ষাপটে ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লব এবং জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব কোনো সাধারণ ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘটনা ছিল না; এটি ছিল রাষ্ট্র পুনর্গঠনের ঐতিহাসিক মুহূর্ত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায়, জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বকে বলা যায় Crisis Leadership—যেখানে একজন নেতা ভাঙনের মুহূর্তে রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতা (State Continuity) নিশ্চিত করেন। তাঁর প্রথম কাজ ছিল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে পুনরুজ্জীবিত করা—বিশেষত সেনাবাহিনী, পুলিশ ও প্রশাসনকে শৃঙ্খলার আওতায় আনা। এই প্রক্রিয়া ছাড়া গণতন্ত্র বা উন্নয়নের কোনো ভিত্তিই সম্ভব ছিল না।
জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত অবদানের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বহুদলীয় গণতন্ত্র (Multi-Party Democracy) পুনঃপ্রতিষ্ঠা। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, একদলীয় শাসনব্যবস্থা (BAKSAL) রাষ্ট্রকে রাজনৈতিকভাবে নিস্তব্ধ এবং সমাজকে মতপ্রকাশহীন করে তুলেছে।
ফলে তিনি—রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন, সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পুনর্বহাল করেন, সংসদীয় রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তনের পথ উন্মুক্ত করেন- এই পদক্ষেপগুলো কেবল প্রশাসনিক সংস্কার নয়; এগুলো ছিল গণতান্ত্রিক বৈধতা (Democratic Legitimacy) পুনর্গঠনের উদ্যোগ। ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে তিনি জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন। এটি প্রমাণ করে, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নয়, বরং ক্ষমতার সাংবিধানিক রূপান্তর ঘটানোর জন্য কাজ করেছিলেন। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (BNP)। এটি ছিল তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ।
বিএনপি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকেন্দ্রিক দল নয়; এটি গড়ে ওঠে একটি স্পষ্ট আদর্শের ভিত্তিতে—বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ তিনটি মৌলিক উপাদানের ওপর দাঁড়িয়ে—১) ভূখণ্ডভিত্তিক জাতীয় পরিচয় ২) ধর্ম-বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে নাগরিক ঐক্য ৩) রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
আরও পড়ুন: গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় বাংলাদেশ: সকলের প্রার্থনায় বেগম খালেদা জিয়া
এই দর্শন পুরোনো জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক সংকীর্ণতার বাইরে গিয়ে একটি Inclusive Nationalism প্রতিষ্ঠা করে। এর ফলে আদিবাসী, সংখ্যালঘু, ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং ভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিচয়ের নাগরিকরাও রাষ্ট্রের সমান অংশীদার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, বহুধাবিশিষ্ট সমাজে রাষ্ট্র টেকসই হয় তখনই, যখন জাতীয়তাবাদ অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়—জিয়াউর রহমান ঠিক সেই মডেলই উপস্থাপন করেন। জিয়াউর রহমান কেবল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কথা ভাবেননি; তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। তাই তাঁর অর্থনৈতিক দর্শনের মূল কথা ছিল—Production, Not Dependency। তিনি কৃষিকে অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করেন। খাল খনন কর্মসূচি, সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ, সার ও উন্নত বীজ সরবরাহের মাধ্যমে তিনি কৃষিতে উৎপাদন বিপ্লব ঘটান। ফলাফল ছিল সুস্পষ্ট—খাদ্য উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তার পথে অগ্রসর হয়।
রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পনির্ভর অর্থনীতির পরিবর্তে জিয়াউর রহমান Private Sector–Led Growth Model গ্রহণ করেন। তিনি ‘বন্ডেড ওয়্যারহাউস’ ও ‘ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি’ নীতির মাধ্যমে পোশাক শিল্পের ভিত্তি স্থাপন করেন। দক্ষিণ কোরিয়ার ডেইউ কোম্পানির সঙ্গে সহযোগিতা করে দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি চালু করেন। এই সাহসী সিদ্ধান্তের ফল আজ সুস্পষ্ট—বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। বিশেষ করে নারীর কর্মসংস্থান ও সামাজিক ক্ষমতায়নে এই খাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। জিয়াউর রহমান মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার করে জনশক্তি রপ্তানির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। আজ প্রবাসী আয় বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ—যা তাঁর দূরদর্শী নীতিরই ফল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জিয়াউর রহমান ছিলেন Independent Foreign Policy-এর প্রবক্তা।
তিনি ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ নীতিতে বিশ্বাস করতেন। তাঁর সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক অবদান হলো দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (SAARC)-এর ধারণা প্রবর্তন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া দারিদ্র্য, অস্থিতিশীলতা ও বৈদেশিক নির্ভরতা কাটাতে পারবে না। তাঁর এই ধারণা ১৯৮৫ সালে ঢাকায় সার্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাস্তব রূপ পায়—যা তাঁকে আঞ্চলিক কূটনীতির একজন দূরদর্শী স্থপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। জিয়াউর রহমানকে কেবল রাষ্ট্রপতি বা সামরিক নেতা হিসেবে দেখলে তাঁর অবদান অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তিনি ছিলেন—শাসনতান্ত্রিক রূপান্তরের কারিগর, বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা, উৎপাদনমুখী অর্থনীতির স্থপতি, অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা- এই কারণেই যথার্থভাবেই “Nation Builder” হিসেবে তিনি বিবেচিত হন।
৪. বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার (Liberation Legacy) একটি মৌলিক বৈধতার উৎস। এই উত্তরাধিকারকে সাংগঠনিক ও আদর্শিকভাবে ধারণ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করেছে। বিএনপি নিজেকে ‘মুক্তিযোদ্ধাদের দল’ হিসেবে দাবি করে—এ দাবি কেবল রাজনৈতিক স্লোগান নয়; এর পেছনে রয়েছে প্রতিষ্ঠাতার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা, সামরিক ও বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং রাষ্ট্রগঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁদের প্রভাবশালী উপস্থিতি।
বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম—স্বাধীনতার ঘোষক, সেক্টর কমান্ডার এবং Z Force-এর অধিনায়ক। বিএনপি’র আদর্শিক ভিত্তি হলো বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ—যা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক (Inclusive) রাষ্ট্রদর্শনে রূপ দেয়। এই দর্শনের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হলো—ভূখণ্ডভিত্তিক সার্বভৌমত্ব, ধর্ম-বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে নাগরিক ঐক্য, গণতন্ত্র ও বহুদলীয় রাজনীতি, জনগণের ভোটাধিকার ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধ কোনো একক মতাদর্শে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রতিষ্ঠা। বিএনপি এই সার্বভৌমত্বকে নির্বাচন, সংসদ ও বহুদলীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়নের কথা বলে। ফলে বিএনপি’র আদর্শিক বৈধতা দাঁড়িয়ে আছে Procedural Democracy ও Popular Sovereignty-র ওপর। বিএনপি’র রাজনৈতিক পরিচয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হলো—গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দল হিসেবে জনমানসে প্রতিষ্ঠা।
একদলীয় শাসনের অবসান, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, নির্বাচনভিত্তিক ক্ষমতা হস্তান্তর—এসবই বিএনপি’র রাজনৈতিক পরিচয়ের অংশ। এই কারণেই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে দীর্ঘ সময়ের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অভিজ্ঞতার পর, জনগণের মধ্যে বিএনপি’র প্রতি নতুন করে আস্থা তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায়, এটি হলো Democratic Recall Effect—যেখানে জনগণ অতীতের গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একটি দলকে পুনরায় গ্রহণযোগ্য মনে করে। বিএনপি’র জনসমর্থনের ভিত্তি কয়েকটি স্তরে বিশ্লেষণ করা যায়—গ্রামীণ ও মধ্যবিত্ত সমর্থন: কৃষি, স্বনির্ভরতা ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রতি জিয়াউর রহমানের দর্শন গ্রামীণ সমাজে গভীর প্রভাব ফেলেছে। মধ্যবিত্ত ও পেশাজীবী শ্রেণি: বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও ভোটাধিকার—এই শ্রেণির কাছে বিএনপি বিশ্বাসযোগ্য। তরুণ ও শিক্ষিত ভোটার: দীর্ঘ রাজনৈতিক সংকটের পর গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা বিএনপি’র দিকে ঝুঁকছে। জনমত জরিপগুলোও দেখায় যে, কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বিএনপি’র Core Vote Bank অটুট রয়েছে এবং সময়ের সঙ্গে তা সম্প্রসারিত হচ্ছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানকে বিএনপি তাদের রাজনৈতিক বয়ানে মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে। বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই ঘটনাকে “৫২, ৭১ কিংবা ৯০-এর মতো জনগণের আরেকটি বিজয়” হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি স্পষ্টভাবে বলেন—প্রতিশোধ নয়, আইনের শাসন, সহিংসতা নয়, গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন, বিভাজন নয়, জাতীয় ঐক্য। এই অবস্থান বিএনপি’র আদর্শিক ধারাবাহিকতারই প্রতিফলন—যেখানে We Revolt মানে ধ্বংস নয়, বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগঠিত ও নৈতিক বিদ্রোহ। সবশেষে বলা যায়, বিএনপি’র শক্তি তিনটি স্তম্ভে দাঁড়িয়ে—মুক্তিযুদ্ধের বৈধ উত্তরাধিকার (Founder & Leadership Legacy), অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের দর্শন, টেকসই জনসমর্থন ও রাজনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা। এই তিনটি উপাদান মিলেই বিএনপি’কে কেবল একটি জনপ্রিয় দল নয়, বরং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের একটি কেন্দ্রীয় শক্তি (Central Political Actor) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
৫. বিজয় দিবসের আলোয় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের “We Revolt” দর্শন আজ নতুন অর্থ বহন করছে। ১৯৭১ সালে এটি ছিল সামরিক দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ; ২০২৬ সালে এটি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক সংগ্রামের প্রতীক। জনমত জরিপ, রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা—সব মিলিয়ে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচন বিএনপি’র জন্য কেবল ক্ষমতায় ফেরার সুযোগ নয়; এটি হবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের নির্বাচন। এই বিজয়, প্রত্যাশা অনুযায়ী বাস্তবায়িত হলে, তা হবে জনগণের ভোটে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের বিজয়, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিজয়; ঠিক যেমন ১৯৭১ সালে জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ সশস্ত্র সংগ্রামে হয়েছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান এবং অধ্যাপক, থিয়েটার এন্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।