তরুণ উদ্যোক্তার ভ্যাট চ্যালেঞ্জ: জটিলতার সমাধান কোন পথে?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি © সংগৃহীত

একটি উদ্যোগ শুরু করার উৎসাহ ও স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাওয়া তরুণদের প্রথম বাধাই হয়ে দাঁড়ায় ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) নামক জটিল প্রক্রিয়া। ফিনটেক, ই-কমার্স, বা ছোটো কারখানা—যে খাতেই হোক না কেন, ভ্যাটের বহুস্তরীয় নিয়ম, অনিশ্চিত হার ও দুর্বোধ্য কম্প্লায়েন্স প্রক্রিয়া তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য আতঙ্কের নাম। অনেকেই ভ্যাটকে ‘অদৃশ্য দেয়াল’ হিসেবে দেখেন, যা উদ্যমকে ঠেকিয়ে দেয় প্রথম সোপানেই। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জই যে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিতে পারে, তা আমরা ভাবি না বলেই হয়তো সমস্যা রয়েই যায়।

তরুণদের মুখোমুখি হওয়া ভ্যাট-জটিলতা:

১. নীতিগত অস্পষ্টতা: কোন পণ্য বা সেবার ভ্যাট কত হবে, কোনটি ছাড় পাবে—তা নিয়ে দ্বিধা কাজ করে। নিয়মের বই ঠিকমতো বুঝতে না পারায় অনেকে ভুল কর্তন বা হিসাব করে ফেলেন, যা পরে জরিমানা বা আইনি জটিলতা ডেকে আনে।

২. ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় অভিযোজনের সমস্যা: e-BIN নিবন্ধন থেকে e-Return জমা—পুরো প্রক্রিয়া অনলাইনে হলেও অনেক তরুণের কাছে ইন্টারফেস জটিল ও ব্যবহারবান্ধব মনে হয়। প্রযুক্তি সহায়তার অভাব ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে ডিজিটাল সিস্টেমই বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

৩. সময় ও সম্পদের অপচয়: একটি ছোটো স্টার্টআপের জন্য আলাদা ভ্যাট একাউন্টেন্ট রাখা বা নিজে সময় দিয়ে শেখা বড় চাপ। এর ফলে মূল ব্যবসার উপর মনোযোগ কমে, উদ্যম স্তিমিত হয়।

সমাধানের পথ: ভ্যাটকে করা যায় তরুণ-বান্ধব

এই সমস্যাগুলো অপরিবর্তনীয় নয়। কয়েকটি কাঠামোগত ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এনে ভ্যাট ব্যবস্থাকে তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ ও উৎসাহব্যঞ্জক করা সম্ভব।

১. নীতির সরলীকরণ: একক হার ও স্বচ্ছ গাইডলাইন:

ভ্যাটের হার ও খাতভিত্তিক নিয়ম সহজ ও স্পষ্ট করতে হবে। বিশেষ করে ছোটো ও মাঝারি উদ্যোগের জন্য প্রারম্ভিক বছরে একটি সরলীকৃত কম্প্লায়েন্স কাঠামো চালু করা যেতে পারে।

তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সহায়তা ডেস্ক ও হেল্পলাইন চালু করে দ্রুত প্রশ্নের সমাধান দেওয়া যেতে পারে।

২. প্রযুক্তিকে করা যেতে পারে সহজ ও আকর্ষণীয়:

ভ্যাটের সব প্রক্রিয়া একটি মোবাইল অ্যাপ বা সুপার-সহজ ওয়েব পোর্টালে নিয়ে আসা। যেখানে স্বয়ংক্রিয় হিসাব, রিমাইন্ডার ও লাইভ চ্যাট সাপোর্ট থাকবে।

গেমিফিকেশন এর মাধ্যমে ভ্যাট রিটার্ন জমা দিতে উৎসাহ দেওয়া—যেমন দ্রুত জমা দিলে ছাড় বা সার্টিফিকেট।

তরুণ ডেভেলপারদের নিয়ে ‘হ্যাকাথন’ আয়োজন করে ভ্যাট ব্যবস্থার জন্য ইনোভেটিভ অ্যাপ বা টুল তৈরি করা—যা ব্যবহারবান্ধব ও স্থানীয় চাহিদা মেটাবে।

৩. তরুণদের অংশগ্রহণে দক্ষতা উন্নয়ন:

বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্যবসায়িক ইনকিউবেটরে ভ্যাট কম্প্লায়েন্স ও ফিসকাল টেকনোলজি সম্পর্কে কোর্স চালু করা।

তরুণ আইটি বিশেষজ্ঞদের ভ্যাট ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ায় ইন্টার্নশিপ বা চুক্তিভিত্তিক কাজে যুক্ত করে দেশীয় সল্যুশন তৈরিতে উৎসাহ দেওয়া। এতে চাকরির পাশাপাশি নতুন একটি টেক-খাত গড়ে উঠবে।

৪. প্রাথমিক সহায়তা ও পরামর্শ সেবা:

তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য প্রথম দুই বছর ভ্যাট পরামর্শক সেবা বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে দেওয়ার ব্যবস্থা।

ভ্যাট অফিসগুলোতে ‘ইয়ুথ সেল’ তৈরি, যারা শুধু তরুণ উদ্যোক্তাদের বিষয়ে বিশেষভাবে সাহায্য করবে।

ভ্যাট ব্যবস্থার সংস্কার কেবল রাজস্ব বাড়ানোর বিষয় নয়, এটি তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করবে। নীতির সরলীকরণ, প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার এবং তরুণদের সক্ষমতা বাড়ানোর সমন্বিত উদ্যোগই পারে এই জটিলতা কাটিয়ে উঠতে। তরুণরাই যখন দেখবে ভ্যাট একটি বোঝা নয়, বরং একটি সুষ্ঠু ব্যবসায়িক অংশীদার—তখন তারা আরও আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগোবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ তরুণদের হাতেই; তাদের পথচলা সহজ করাই হোক ভ্যাট সংস্কারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।

লেখক:
অর্ণব চক্রবর্তী
অর্থনীতি বিষয়ক কলামিস্ট