অবসরভাতা
ভুয়া ইনডেক্স ও জাল আবেদনে ৬৭৪ কোটি টাকা লোপাট, আবেদন না করেও টাকা পেয়েছেন ২০ জন
- একই ইনডেক্স নম্বরে একাধিকবার অর্থ উত্তোলন
- শিহাব উদ্দিন
- ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০:৩১
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডে দীর্ঘদিন ধরে চলা ব্যাপক দুর্নীতি ও আর্থিক লুটপাটের অবিশ্বাস্য চিত্র উঠে এসেছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষায়।অধিদপ্তর জানিয়েছে, ভুয়া ইনডেক্স, জাল আবেদন, দ্বৈত পেমেন্ট, নীতিমালা লঙ্ঘন, অবসর-অযোগ্যদের নামে টাকা ছাড় এবং বেসরকারি ব্যাংকে বেআইনিভাবে বিপুল অর্থ আটকে রাখাসহ নয়টি বড় ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে ৬৭৪ কোটি টাকার বেশি লোপাট করা হয়েছে।
সম্প্রতি অবসর সুবিধা বোর্ডের ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের আর্থিক লেনদেন পর্যালোচনা করে এই বিপুল পরিমান অর্থ লোপাটের প্রমাণ পেয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।
অবসর সুবিধা বোর্ডের এমন পুকুর চুরির ঘটনা উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তারা বলছে, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, সফটওয়্যার অপারেটর, ব্যাংক কর্মকর্তাসহ একটি বড় চক্রের সুসংগঠিত দুর্নীতির প্রমাণ। শিক্ষক-কর্মচারীদের কষ্টার্জিত অবসর তহবিল থেকে শত শত কোটি টাকা লোপাটকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-২) মো. মিজানুর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের এমন কোনো প্রতিবেদন এখনো আমাদের হাতে আসেনি। শিক্ষকদের এ ধরনের অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অনুসন্ধানের তথ্য বলছে ‘০৫৯৫৪২’ ইনডেক্সধারী শিক্ষক মোহাম্মদ মুখলেছুর রহমানের নামে অবসর সুবিধা বোর্ডের ৩১ লাখ ৯০ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। পরে একই ইনডেক্স নাম্বার (০৫৯২৪৫) ব্যবহার করে দ্বিতীয় দফায় অর্থ জমা হয় সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘গ্রীন বি’-এর ভেন্ডর গোলাম সরোয়ারের স্ত্রী জাকিয়া নুসরাতের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। সফটওয়্যারের ডেটা পরিবর্তন, ইনডেক্স যাচাই-ব্যবস্থা অক্ষম করে রাখা এবং অভ্যন্তরীণ যোগসাজশ ছাড়া এ ধরনের লেনদেন অসম্ভব বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০ জন শিক্ষক-কর্মচারীর নামে অবসর সুবিধার টাকা তোলা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ; তবে তারা কেউ টাকা পেতে আবেদনই করেননি। অবসর সুবিধা বোর্ডও কোনো ব্যাংকে পরিশোধের অনুমোদন পাঠায়নি। তবুও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখার একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ২০টি অ্যাকাউন্টে ১ কোটি ৩৭ লাখ ৯৬ হাজার টাকা পাঠানো হয়েছে। বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই বিপুল পরিমান এ অর্থ ছাড় হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভুয়া ইনডেক্স ব্যবহার করে অবসর সুবিধার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের তালিকায় যেসব ইনডেক্স নম্বর আদৌ ছিল না, সেগুলোর বিপরীতে শিক্ষক দেখিয়ে রাখা হয় সফটওয়্যারে। সেই ভুয়া শিক্ষকদের নামে বোর্ড থেকে তোলা হয় ১ কোটি ৪২ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। নিরীক্ষকরা বলছেন, যে ইনডেক্স নম্বরগুলো কোনো অধিদপ্তরেই ছিল না, সেগুলো ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে টাকা লোপাট করা হয়েছে।
২০ জন শিক্ষক-কর্মচারীর নামে অবসর সুবিধার টাকা তোলা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তারা কেউ টাকা পেতে আবেদনই করেননি। অবসর সুবিধা বোর্ডও কোনো ব্যাংকে পরিশোধের অনুমোদন পাঠায়নি। তবুও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখার একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ২০টি অ্যাকাউন্টে ১ কোটি ৩৭ লাখ ৯৬ হাজার টাকা পাঠানো হয়েছে। বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই বিপুল পরিমান এ অর্থ ছাড় হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর জানিয়েছে, একই ইনডেক্স নম্বর ব্যবহার করে দুইবার অবসর সুবিধা তুলেছে একটি চক্র। প্রথমবার প্রকৃত শিক্ষকের টাকা পরিশোধের পর একই ইনডেক্স আবার ব্যবহার করে ভিন্ন অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয় অর্থ। এতে বোর্ডের ক্ষতি হয়েছে ৭৯ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। সফটওয়্যারে এক ইনডেক্স একবার ব্যবহার হলে তা পুনরায় ব্যবহার অসম্ভব হওয়ার কথা। তবুও বোর্ড কর্মকর্তাদের যোগসাজসে এমন অসাধ্যকে সাধন করেছে চক্রটি।
জাল আবেদনপত্র তৈরি করে ভিন্ন অ্যাকাউন্টে অর্থ উত্তোলনের ঘটনাও পাওয়া গেছে একাধিক। কুমিল্লা, নোয়াখালি, বাগেরহাটের প্রকৃত আবেদনকারীদের সরকারি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের পরিবর্তে নারায়ণগঞ্জের একটি বেসরকারি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে পাঠানো হয় ৫৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। ইনডেক্স নম্বর আসল, আবেদন আসল হলেও অর্থ পেয়েছেন ভুয়া ব্যক্তি। বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা এ ধরনের আবেদনের কাগজপত্র যাচাই না করেই পেমেন্ট অনুমোদন দিয়েছেন।
‘বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বোর্ডে নানা অনিয়ম হয়েছে। শিক্ষকদের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।’- এ বি এম আব্দুল হান্নান, মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব)
নিরীক্ষা প্রতিবেদনের সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য উঠে আসে বোর্ডের স্থায়ী তহবিল এনডাউমেন্ট ফান্ড ব্যবস্থাপনায়। আইন অনুযায়ী, অবসর সুবিধা বোর্ডের অর্থ কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে জমা রাখার কথা থাকলেও বোর্ড ৬৩৯ কোটি টাকারও বেশি ১১টি বেসরকারি ব্যাংকে এফডিআর ও এসটিডি আকারে জমা রাখে। এসব ব্যাংকে টাকা ফেরতের আবেদন করা হলেও ব্যাংক কোনো অর্থ ফেরত দেয়নি। এ ধরনের বিপুল অঙ্কের সরকারি তহবিল বেসরকারি ব্যাংকে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হলো, কে অনুমোদন দিল তার কোনো তথ্য নথিতে পায়নি শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর।
এনডাউমেন্ট ফান্ড ব্যবস্থাপনাতেও রয়েছে আরও গুরুতর অনিয়ম। বোর্ড প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাওয়া এক হাজার ২২৯ কোটি টাকার এনডাউমেন্ট ফান্ড দীর্ঘ সময় ব্যাংকে ‘অচল’ রাখা হয়, পরে তা বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে বিনিয়োগ করা হয়। লভ্যাংশের অন্তত ২৫ শতাংশ স্থায়ী তহবিলে জমা রাখার নিয়মও মানা হয়নি। নিরীক্ষা প্রতিবেদনের হিসেব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন নাগাদ মোট তহবিল হওয়ার কথা ছিল এক হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। বাস্তবে পাওয়া গেছে ১৩০২ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে ২৯ কোটি ২০ লাখ টাকার অনিয়ম পাওয়া গেছে।
এসব অনিয়ম বা অপরিকল্পিত ব্যয়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি অবসর সুবিধা বোর্ড। পারিতোষিক দেওয়ার ক্ষেত্রেও বিধি লঙ্ঘন করেছে বোর্ড। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী বোর্ডে কর্মরত কেবল ১২ জন নির্দিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী পারিতোষিক পেতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে বোর্ড সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকেই পরিতোষিক দিয়েছে, যার কারণে অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে ৭ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। একইসঙ্গে এক শিক্ষককে প্রাপ্যতার চেয়ে ৫ লাখ ৭৯ হাজার টাকা বেশি পরিশোধ করার ঘটনাও ধরা পড়েছে নিরীক্ষায়।
অবসর সুবিধা বোর্ডের এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এ বি এম আব্দুল হান্নান বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বোর্ডে নানা অনিয়ম হয়েছে। শিক্ষকদের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।’