চার মাসে ১২ ডাকাতি, ৩০ চুরিতে আতঙ্ক—সন্ধ্যা নামলেই লাঠিসোটা নিয়ে পাহারায় গ্রামবাসী
- ২৬ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০৩
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে চুরি–ডাকাতির ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে। প্রশাসন এবং গনমাধ্যমের তথ্যমতে গত চার মাসে উপজেলাজুড়ে ১২টি ডাকাতি ও ৩০টির বেশি চুরির ঘটনা রেকর্ড হয়েছে। হিঙ্গুলী, জোরারগঞ্জ, দুর্গাপুর, খৈয়াছড়া, উপজেলা সদর ইউনিয়ন ও পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক হামলার ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ক্রমবর্ধমান অপরাধের এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় কয়েকটি ইউনিয়নে স্থানীয়ভাবে রাত্রিকালীন গ্রাম পাহারা দেয়া এবং সড়কে বাতি লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছেন।
সর্বশেষ ভয়াবহ ঘটনা ঘটে দুর্গাপুর ইউনিয়নের হাজীশ্বরাই গ্রামে। শুক্রবার গভীর রাতে প্রবাসী আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার বাড়িতে তাঁর মেয়ের বিয়ের সুযোগে ডাকাতদল হানা দেয়। তালা ভেঙে ঘরে ঢুকে সবাইকে বেঁধে ফেলে ডাকাতরা। এরপর ঘরে থাকা স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুট করে দ্রুত পালিয়ে যায়। ভুক্তভোগী আনোয়ার বলেন, 'ডাকাতরা অন্তত ১৫ ভরি স্বর্ণ ও এক লাখ টাকা নিয়ে গেছে।'
এর আগে খৈয়াছড়ার মাছিমেরতালুক এলাকায় আরেকটি বড় ঘটনা ঘটে। অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য সার্জেন্ট আবু সুফিয়ানের বাড়িতে গভীর রাতে অস্ত্র ঠেকিয়ে ১০ ভরি স্বর্ণ, ২৫ হাজার ৭০০ টাকা এবং ৪টি মোবাইল ফোন নিয়ে যায় ডাকাতদল। ঘটনার পর এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তারও আগে হিঙ্গুলীর পূর্ব মেহেদীনগরে নতুন নির্মিত একটি বাড়িতে সন্ধ্যা সাতটার দিকে হানা দেয় অস্ত্রধারী ডাকাত। দরজা খোলার মুহূর্তে তারা এক নারীকে আঘাত করে তাঁর কানের দুল ও চেইন ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায়। গুরুতর আহত ওই নারীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মস্তাননগর হাসপাতালে পাঠানো হয়।
ডাকাতির পাশাপাশি থেমে নেই চুরির ঘটনাও। খৈয়াছড়ার নয়দুয়ারিয়া গ্রামে আব্দুল মজিদের বাড়িতে গভীর রাতে ঢুকে চোররা স্বর্ণ ও টাকা লুট করে পালিয়ে যায়। জোরারগঞ্জের ইছাখালী এলাকায় রাত দুটোর দিকে প্রাইভেটকারযোগে গরু চুরি করে পালানোর চেষ্টা করে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এছাড়া স্কুল থেকে লেপটপ, ফ্যান, নগদ টাকা, মসজিদের দানবক্স ভেঙে টাকা, মোটরসাইকেল, টিউবওয়েল, পানি তোলার মোটর, বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটার, এমনকি ফ্রিজে রাখা মাংস, রান্না করা খাবার, ব্যবহৃত পোশাকসহ নানা ধরনের জিনিসপত্র চুরির অভিযোগ পাওয়া গেছে প্রায় প্রতিদিনই। সর্বশেষ ২৪ নভেম্বর গভীর রাতে জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের মস্তাননগর শাহকালা (রহ.) মাজার সংলগ্ন শহিদ স'মিলে ৩টি ট্রান্সফরমার বিদ্যুতের খুঁটি থেকে খুলে নিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয়দের ধাওয়ায় পালিয়ে যায় চোরের দল। পরে ঘটনাস্থলে আসেন জোরারগঞ্জ থানার টহলটিম।
চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৩ এর মিরসরাই জোনাল অফিসের ডিজিএম আদনান আহমেদ চৌধুরী বলেন, 'রাতের আঁধারে উপজেলা সদরের আমবাড়িয়া গ্রাম থেকে ১টি এবং দুর্গাপুর ইউনিয়ন থেকে দুইটি ট্রান্সফরমার চুরি হয়েছে। প্রতিটি ট্রান্সফরমারের মূল্য প্রায় ৬০ হাজার টাকা থেকে ১ লক্ষ টাকা। এসব ট্রান্সফরমার চুরি হওয়ার পর গ্রাহকরাই এর টাকা তুলে দিতে হচ্ছে। এমতাবস্থায় প্রতিটি এলাকায় ট্রান্সফরমারগুলো পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করা জরুরি হয়ে পড়েছে'।
তিনি আরো বলেন, 'ইতোমধ্যে আমি উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও মিরসরাই থানার ওসিকে এবিষয়ে লিখিতভাবে জানিয়েছি। ভাবে জানিয়েছি। এছাড়া প্রতিটি এলাকায় সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন'।
চুরি ডাকাতিরোধে গত ২০ নভেম্বর জামায়াতের নেতৃস্থানীয় নেতাদের নিয়ে মিরসরাই থানা পুলিশের সাথে নিয়ে মতবিনিময় করেছেন চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনে জামায়াতে ইসলামী মনোনীত সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী, বাংলাদেশ সরকারের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট সাইফুর রহমান। এবিষয়ে তিনি বলেন, পুলিশের যদি জনবল সংকট থাকে পুলিশকে সহযোগিতার জন্য যদি জনবল লাগে প্রতিটি ইউনিয়নে আমাদের সংগঠনের ভাইয়েরা সহযোগিতা করতে রাজি আছে। আমরা বর্তমানে যেভাবে অপরাধ কর্মকাণ্ড চলছে এভাবে মিরসরাইয়ে আর কোনো অপরাধ দেখতে চাই না। পুলিশ অনেক কাজ করেছে তা সত্য কিন্তু ক্রমবর্ধমান যে চুরি, ডাকাতি হয়ে যাচ্ছে এটা বন্ধের কার্যকর পদক্ষেপ তাদের নিতে হবে। প্রশাসন আন্তরিক হলে এসব বন্ধ করা সম্ভব। মিরসরাইবাসী আজ উদ্বিগ্ন। তাই মিরসরাইকে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, চুরি ও ডাকাতি মুক্ত করতে হবে। চোর, ডাকাতদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স শো করতে হবে। পুলিশ প্রশাসন আন্তরিক হলে আমি আশা করছি আগামি ১ সপ্তাহের মধ্যে মিরসরাইয়ে শান্তি ফিরে আসবে।
এদিকে এমন উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতিতে জনমনে তৈরী হয়েছে আতঙ্ক, স্থানীয় বাসিন্দারা এসব ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করার পাশাপাশি সড়কে বাতি জ্বালানোসহ রাগ জেগে গ্রাম পাহারা দিতে শুরু করেছেন। উপজেলার ১৬ নম্বর সাহেরখালী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব ডোমখালী গ্রামের সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিলফুল ফুজুল যুব সংঘ ও স্থানীয় জনসাধারনের উদ্যোগে মাস্টার কবির আহমেদ সড়ক ও আরকাঠি বাড়ি সড়কে ১০টি সোলার স্ট্রিট লাইট লাগানো হয়েছে। অপরদিকে ৮ নম্বর দুর্গাপুর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের শিকারপুর গ্রামে শিকারপুর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং শিকারপুর যুব সংঘের উদ্যোগে চুরি, ডাকাতিরোধে সড়কে ১৬টি লাইট লাগানোর পাশাপাশি রাতজেগে পাহজরা দিচ্ছেন। এছাড়াও ১২ নম্বর খৈয়াছড়া ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের নিজতালুক কানু ফকির সড়কে যুবসমাজের উদ্যোগে ৫০টি সড়কবাতি লাগানো হয়েছে। এভাবে উপজেলার বিভিন্ন সড়কে সড়ক বাতি লাগানো হচ্ছে।
এবিষয়ে হিলফুল ফুজুল যুব সংঘের সাধারণ সম্পাদক মুসলিম উদ্দীন বলেন, 'সাম্প্রতিক সময়ে মিরসরাইয়ে চুরি, ডাকাতি বেড়ে গেছে। তাই স্থানীয় জনসাধারণ ও আমাদের সংগঠনের উদ্যোগে চুরি, ডাকাতি বন্ধে মাস্টার কবির আহমেদ সড়ক ও আরকাঠি বাড়ি সড়কে ১০টি সোলার স্ট্রিট লাইট লাগিয়েছি। এখন কিছুটা হলেও শঙ্কা মুক্ত হয়েছি বলে মনে করছি'। চুরি, ডাকাতি বন্ধে শিকারপুর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং শিকারপুর যুব সংঘের উদ্যোগে সড়কে ১৬টি লাইট লাগানো হয়েছে।
সংগঠনগুলোর সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ বাদশা বলেন, 'কয়েকদিন আগে আমাদের ইউনিয়নের একটি বিয়ে বাড়িতেও ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। চুরি, ডাকাতি থেকে রক্ষা পেতে দুইটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে সড়কে লাইট লাগানোর পাশাপাশি আমরা রাতজেগে পাহারার ব্যবস্থাও করেছি। প্রয়োজনে ভবিষ্যতে আরো লাইট লাগানো হবে'।
গ্রামে একের পর এক চুরি, ডাকাতির ঘটনায় গ্রামের যুবসমাজের উদ্যোগে বিভিন্ন গ্রামে রাত জেগে পাহারা দেওয়া হচ্ছে। তেমনই একটি উপজেলার হিঙ্গুলী ইউনিয়নের আজমনগর। প্রতিরাতে গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ সড়কে লাঠি হাতে পাহারায় বসেন যুবকরা। গ্রামটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে যুবকরা অংশ নেন। এমনকি রাতে ড্রোন উড়িয়ে চোর ডাকাত শনাক্তের চেষ্টা চালাচ্ছেন।
এসব চুরি ডাকাতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন নেতা মেহেদি হাসান বলেন, যেহেতু গ্রামীণ এলাকাগুলোতে বেশি চুরি হচ্ছে তাই ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক নিয়োজিত গ্রাম পুলিশকে সচল করা জরুরি, গ্রামীন এলাকায় তাদের টহল বাড়ানো দরকার।
এবিষয়ে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে উপজেলার সিনিয়র সাংবাদিক এম আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রতিনিয়তই চুরি, ডাকাতির সংবাদ পাচ্ছি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে এসব কর্মকাণ্ডের মূল চক্র পর্যন্ত গিয়ে জড়িত সকলকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা।
পুলিশ জানায়, গত চার মাসে মিরসরাই ও জোরারগঞ্জ থানায় ডাকাতির ঘটনায় মোট ছয়টি মামলা হয়েছে। জোরারগঞ্জ থানার চারটি মামলায় ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা গেলেও মিরসরাই থানায় দায়ের করা মামলায় এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। জোরারগঞ্জ থানার ওসি আবদুল হালিম বলেন, “ডাকাতরা সাধারণত বাইরের এলাকা থেকে এসে দ্রুত সরে পড়ে। তাদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
মিরসরাই থানার ওসি আতিকুর রহমান বলেন, ‘গত এক মাসে চুরি–ডাকাতি নিয়ন্ত্রণে ১০৩ জন দুষ্কৃতকারীকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। এখনো একটি আন্তজেলা ডাকাত দল সক্রিয় রয়েছে। ডিবি ও র্যাবের সহায়তায় তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’