৫ বিভাগের মেডিকেল কলেজের দায়িত্ব থেকে রাবি-চবি-শাবি আউট, ঢাবির খবরদারিত্ব কেন রয়েই গেল?
- ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ১৯:৪১
প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে বিভাগের সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর অধিভুক্তি নিশ্চিত করেছে দেশের ৪ বিভাগে প্রতিষ্ঠিত ৪টি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। স্নাতক পর্যায়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ডিগ্রি প্রদানসহ পরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তবে এখনও ঢাকা, ময়মনসিংহ ও বরিশাল বিভাগের স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধীনে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) অধীনে নিতে বারবার উদ্যোগ নিলেও তা থমকে আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাবির অধীনে বর্তমানে ঢাকার ৪টিসহ মোট ১৩টি সরকারি মেডিকেল কলেজ, ৪০টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, সরকারি-বেসরকারি আরও ১০টি ডেন্টাল কলেজ, ১৭টি নার্সিং কলেজ, তিনটি হোমিওপ্যাথিক, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক এবং ৯টি মেডিকেল ইনস্টিটিউট রয়েছে।
মেডিকেলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাস্থ্য শিক্ষার মতো একটি টেকনিক্যাল শিক্ষাকে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মানিয়ে চলতে কিছুটা ঝঞ্ঝাট পোহাতেই হয়। একাধিক শিক্ষার্থী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, মেডিকেল কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হলেও ঢাবি স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। দেখা গেছে, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত কলেজগুলোতে প্রফেশনাল পরীক্ষা শেষ করে আমাদের সহপাঠীরা ইন্টার্নি শুরু করে দিয়েছে, কিন্তু আমাদের এখনও প্রফের রুটিনই প্রকাশ হয়নি। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদেরকে প্রায়োরিটি দেয় না।
তারা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষার রুটিন দেয় নিজেদের মতো করে। সেখানে দীর্ঘসূত্রতা তো আছেই, সার্টিফিকেট নিয়েও বেশ দীর্ঘসূত্রতা পোহাতে হয়। মেডিকেল বা স্বাস্থ্য শিক্ষার প্রতিষ্ঠান নিয়ে বোঝাপড়াতেও কিছুটা ঘাটতি থাকে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের মাধ্যমে অধিভুক্ত মেডিকেলগুলো পরিচালিত হয়, তারপরও নানান কারণে এই ভোগান্তি এড়ানো যায় না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি চট্টগ্রাম (চমেবি), রাজশাহী (রামেবি), সিলেট (সিমেবি) ও খুলনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (খুমেবি) প্রতিষ্ঠার পর স্ব স্ব বিভাগের পাশাপাশি আশেপাশের বিভাগের প্রতিষ্ঠানগুলোও এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে তুলনামূলক পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় চমেবি। প্রতিষ্ঠার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত স্বাস্থ্য শিক্ষার সকল প্রতিষ্ঠান এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। মূলত বিশ্ববিদ্যালয় আইনেই এ বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১৬ এর ৫১(১) ধারায় বলা হয়েছে, আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইন বা আইনগত দলিলে যা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইন কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৩ এর অধীন স্থাপিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সকল সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, ডেন্টাল কলেজ, নার্সিং কলেজ বা ইনস্টিটিউট বা অন্য কোন মেডিকেল প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হবে। ৫১(২) উপ-ধারায় বলা হয়েছে, সরকার কর্তৃক ভিন্নরূপ কোন সিদ্ধান্ত গৃহীত না হলে চট্টগ্রাম বিভাগ ও সিলেট বিভাগের আওতাধীন সকল সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হবে।
একই ধরনের আইন রয়েছে পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠিত অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১৬ এর ৫১(১) ধারায় প্রাথমিকভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান এবং পরবর্তীতে রাজশাহী, খুলনা ও রংপুর বিভাগের সকল মেডিকেল প্রতিষ্ঠান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির বিধান রাখা হয়।
মেডিকেলগুলো মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে গেলেই সুবিধা বেশি। অনেকগুলো অনুষদ আছে ইউনিভার্সিটির অধীনে, সেক্ষেত্রে যদি মেডিকেল ইউনিভার্সিটির অধীনে যায়, যদি সেই সক্ষমতা তারা তৈরি করতে পারে, তাহলে মেডিকেল ইউনিভার্সিটিই ভাল হবে— অধ্যাপক ডা. মোস্তাক আহমেদ, ডিন, ঢাবি চিকিৎসা অনুষদ
পরে সিলেট ও খুলনায় মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ওই দুই বিভাগের সকল প্রতিষ্ঠান এ দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়, যা সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১৮ এবং খুলনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০২১ এ স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।
সাধারণত মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় স্নাতকোত্তর পর্যায়ের চিকিৎসা শিক্ষার জন্য। বিএমইউসহ ৫ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতার বিষয়ে বলা হয়েছে, চিকিৎসা শাস্ত্রের যে কোন বিষয়ে স্নাতকোত্তর অধ্যয়নে, বিশেষ করে, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে কোন বিষয়ে শিক্ষার ও গবেষণার ব্যবস্থা করা। এ ছাড়া নার্সিংয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর অধ্যয়নের ব্যবস্থা করার কথাও উল্লেখ রয়েছে। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে স্নাতক পর্যায়ের অধ্যয়নের সুযোগ রাখা হয়নি আইনে।
যদিও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তির স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে, তবে বিএমইউর আইনে এমন কোনো স্পষ্ট বিধান রাখা হয়নি। বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৯৮ এর ৮(৫) ধারায় বলা হয়েছে, মেডিকেল কলেজ বা ইনষ্টিটিউটসমূহ পর্যায়ক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে অধিভুক্ত হতে পারবে।
দেখা গেছে, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত কলেজগুলোতে প্রফেশনাল পরীক্ষা শেষ করে আমাদের সহপাঠীরা ইন্টার্নি শুরু করে দিয়েছে, কিন্তু আমাদের এখনও প্রফের রুটিনই প্রকাশ হয়নি। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদেরকে প্রায়োরিটি দেয় না— ঢামেক শিক্ষার্থী
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. মোস্তাক আহমেদ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, অনেক আগে একবার আলোচনা হয়েছিল যে আমরা মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে (বিএমইউ) যাব। তবে মেডিকেল ইউনিভার্সিটির অধীনে অনেকগুলা পোস্টগ্রাজুয়েশন কোর্স আছে, সেজন্য আন্ডারগ্রাজুয়েশন কোর্স পরিচালনার সক্ষমতা রয়েছে কিনা, সেটি বিবেচনায় তেমন আগানো হয়নি। বর্তমানে এটা নিয়ে কোন কথাবার্তা হচ্ছে কিনা, তা আমার জানা নেই।
সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তির সুবিধা-অসুবিধা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মেডিকেলগুলো মেডিকেল ইউনিভার্সিটিতে গেলেই সুবিধা বেশি। অনেকগুলো অনুষদ আছে ইউনিভার্সিটির অধীনে, সেক্ষেত্রে যদি মেডিকেল ইউনিভার্সিটির অধীনে যায়, যদি সেই সক্ষমতা তারা তৈরি করতে পারে, তাহলে মেডিকেল ইউনিভার্সিটিই ভাল হবে।
বিএমইউ যদি সে সক্ষমতা অর্জন করে এবং সরকার যদি মনে করে যে সেটা ভালো হবে, তাহলে যেটা শিক্ষার জন্য ভালো সেটাই করা উচিত— অধ্যাপক ডা. মোস্তাক আহমেদ, ডিন, ঢাবি চিকিৎসা অনুষদ
তিনি বলেন, মেডিকেল প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেডিকেল ইউনিভার্সিটির অধীনে নিয়ে যাওয়াই সরকারের চূড়ান্ত পরিকল্পনা। অন্য ৪ ইউনিভার্সিটির ক্ষেত্রে যেহেতু প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম ছিল, তারা নিয়ে যেতে পেরেছে। এখানে তো অনেকগুলা মেডিকেল কলেজ, আসলে এই মুহূর্তে মেডিকেল ইউনিভার্সিটির সে সক্ষমতা আছে কিনা জানি না।
অধ্যাপক ডা. মোস্তাক আহমেদ বলেন, ওদের (বিএমইউ) এখন যে ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা যে জনবল আছে, ওই হিসাবে এত বড় একটা ফ্যাকাল্টিতে নেওয়ার সম্ভবত সেই ক্ষমতা এখনই হয়নি। ঢাকা ইউনিভার্সিটির অধীনেও ভালই চলছে। তবে মেডিকেল ইউনিভার্সিটি যদি সে সক্ষমতা অর্জন করে এবং সরকার যদি মনে করে যে সেটা ভালো হবে, তাহলে যেটা শিক্ষার জন্য ভালো সেটাই করা উচিত।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, মেডিকেল কলেজগুলোকে বিএমইউতে অধিভুক্তির বিষয়ে আলোচনা চলমান রয়েছে। তবে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। আমরা কথা বলছি।