গণভোট ও নির্বাচনব্যবস্থা যেমন হওয়া উচিত
- ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ১৬:৫৬
বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচনব্যবস্থা বহু দশক ধরে নানা টানাপড়েন, সংঘাত ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। কিন্তু একটি প্রশ্ন বারবার ফিরে আসে— আমরা কি এখনো এমন একটি নির্বাচন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি যেখানে জনগণের ইচ্ছা অবলীলায় প্রতিফলিত হয়? যেখানে প্রার্থী নির্ধারণে দলীয় নেতার সিদ্ধান্ত নয় বরং জনগণের মতই সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায়। যেখানে যোগ্যতা, সততা ও দক্ষতাই নির্বাচনযোগ্যতার প্রধান মানদণ্ড? দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর উত্তর এখনো ‘না’।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক কাঠামো দলীয় মনোনয়নকেন্দ্রিক। একটি আসনে যদি কোনো দলের দশজন বা বারোজন যোগ্য মানুষ মনোনয়ন চান, সেখানে কার্যত সুযোগ পান একজন—যার মনোনয়ন পাওয়ার পেছনে থাকে কখনো পারিবারিক সম্পর্ক, কখনো অর্থের প্রভাব, কখনো আবার দলীয় আনুগত্য। বাকিরা গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা থেকে স্বভাবতই বাদ পড়ে যান। অথচ নির্বাচন করা যেমন নাগরিকের অধিকার, নির্বাচনে অংশ নেওয়াও তেমনি মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার। এ অধিকার দলীয় মনোনয়নের প্রাচীর কোথাও কোথাও সীমিত ও খর্ব করে দিচ্ছে। মনোনয়ন বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি ও অস্বচ্ছতার অভিযোগও নিত্যসঙ্গী।
এই বাস্তবতায় সামনে এসেছে একটি নতুন ভাবনা— দলীয় মনোনয়ন সম্পূর্ণ বাতিল করে নির্বাচনকে জনগণকেন্দ্রিক করে তোলা। প্রস্তাব অনুযায়ী, বাংলাদেশকে আটটি বিভাগের ভিত্তিতে আট ধাপে নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। প্রতিটি বিভাগে একদিনে অনুষ্ঠিত হবে পাঁচ বছরের সব ভোট— রাষ্ট্রপতি, সরকার প্রধান, স্পিকার, সংসদ সদস্য, সিটি কর্পোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ। এতে ভোটাররা একসাথে তাদের সব স্তরের নেতৃত্ব বেছে নিতে পারবেন।
আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— পাঁচ বছরের মেয়াদে কোনো নির্বাচিত পদ শূন্য হলে নতুন নির্বাচন নয়; বরং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থী দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। এতে প্রশাসনিক জটিলতা, অনিশ্চয়তা এবং বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয়— সবই কমে আসবে।
এই মডেলের সবচেয়ে সাহসী অংশ হলো দলীয় মনোনয়ন বাতিল। সব প্রার্থী দাঁড়াবেন স্বতন্ত্রের ন্যায়, কোনো দল কাউকে ‘টিকিট’ দিতে পারবে না। এতে দলীয় বাণিজ্য, মনোনয়ন, কেনা-বেচা, ক্ষমতাকেন্দ্রিক দরকষাকষি এবং বিশেষ গোষ্ঠীর প্রভাব নষ্ট হয়ে যাবে। সাধারণ, যোগ্য, সৎ ও স্বচ্ছ মানুষ রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার আসল সুযোগ পাবেন।
একই সঙ্গে প্রস্তাব উঠেছে পরিবারতন্ত্রবিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণের। দলপ্রধান ও সরকারপ্রধান কখনো একই ব্যক্তি হবেন না এবং দলপ্রধান পদ কোনোভাবেই পারিবারিক উত্তরাধিকার হিসেবে বয়ে যাবে না। এতে রাজনৈতিক দলগুলো ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে যাওয়ার প্রবণতা কমবে এবং দল পরিচালনায় গণতান্ত্রিক চর্চা বাড়বে।
প্রস্তাবিত কাঠামোতে রাজনৈতিক দলগুলো গ্রাম পর্যায় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগ এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়— এই পূর্ণাঙ্গ সংগঠন কাঠামো গঠন করবে। কেন্দ্রীয় কমিটিই দলপ্রধান নির্বাচন করবে এবং সরকার প্রধান প্রার্থী নির্ধারণ করবে। তবে সরকার প্রধান নির্ধারণের শেষ কথা বলবে জনগণই— তারা সরাসরি ভোট দিয়ে দেশের নির্বাহী প্রধানকে নির্বাচন করবে। একইভাবে রাষ্ট্রপতি এবং স্পিকারও নির্বাচিত হবেন জনগণের সরাসরি ভোটে। এর ফলে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি পদ আর কখনো কোনো দলের অভ্যন্তরীণ আলোচনার ফলাফল হবে না; হবে সরাসরি ভোটারদের সিদ্ধান্ত।
আরও পড়ুন: গণভোটের অধ্যাদেশ উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
এ ব্যবস্থা কার্যকর করতে প্রয়োজন হবে একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং দলমুক্ত নির্বাচন কমিশন— যেখানে কোনো রাজনৈতিক দল বা ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপ থাকবে না। নির্বাচন কমিশনই নির্ধারণ করবে নির্বাচন পরিচালনার সব নীতি, ব্যবস্থা ও ফলাফল।
যদি এমন একটি ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হয়, তবে নির্বাচন ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে। বর্তমানে অনেকে পাঁচ বছরে যত আয় করেন, তার তুলনায় নির্বাচনে খরচ করেন বহু গুণ বেশি। এই ব্যয়-নির্ভর রাজনীতি অনেক সময় দুর্নীতি, কালো টাকা এবং অগণতান্ত্রিক শক্তির উত্থানকে প্রশ্রয় দেয়। প্রস্তাবিত মডেল এই অনিয়মগুলোকে প্রকৃত অর্থেই অনেকটা বিসর্জন দেবে।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন থাকে— এটি কি বাস্তবসম্মত? কেউ কেউ বলবেন, এত বড় সংস্কার রাজনৈতিকভাবে কঠিন। আবার কেউ বলবেন, পরিবর্তনের এটি একমাত্র পথ। তবে সত্য হলো— গণতন্ত্র কেবল দলীয় হাতে বন্দি রেখে কখনোই পূর্ণতা পায় না। জনগণের হাতে ক্ষমতার প্রকৃত প্রত্যাবর্তন ছাড়া গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি স্বচ্ছ, সুশাসিত ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্রব্যবস্থার অধিকারী। দলমুক্ত, মনোনয়নমুক্ত এবং জনগণকেন্দ্রিক এই নির্বাচনব্যবস্থা সে পথেই একটি শক্তিশালী সম্ভাব্য পদক্ষেপ হতে পারে। আজ প্রশ্ন হলো— আমরা কি এই পরিবর্তনের সাহস দেখাতে প্রস্তুত?
লেখক: সচেতন নাগরিক।
উল্লেখ্য, লেখাটি সম্পূর্ণই লেখকের ব্যক্তিগত অভিমত।