ভূমিকম্পের ক্ষতি থেকে বাঁচতে আগাম প্রস্তুতি যেভাবে নেবেন
- ২২ নভেম্বর ২০২৫, ১৯:১৫
বাংলাদেশে বেশিরভাগ ভবন এখনও ভূমিকম্প-সহনশীল নয়—এ নিয়ে বহুদিন ধরেই সতর্ক করে আসছেন প্রকৌশলীরা। তাদের মতে, বড় ধরনের ধস ও প্রাণহানির মূল কারণ দুর্বল কাঠামো, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী এবং নিয়ন্ত্রণহীন ভবন নির্মাণ। তাই ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকেই প্রস্তুতি নেওয়ার ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাসা নিরাপদ কি না—সবার আগে তা নিশ্চিত করা জরুরি
প্রকৌশলীরা বলছেন, ভবন নির্মাণ বা সংস্কারের সময় সিসমিক স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলা বাধ্যতামূলক। বাড়িতে কোথাও ফাটল দেখা দিলে দ্রুত মেরামত করতে হবে। বাসার বড় আসবাব—যেমন বুকশেলফ, আলমারি, ফ্রিজ বা আলনা—দেয়ালে শক্তভাবে আটকানো আছে কি না তা নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে। পানির ট্যাংক, সোলার প্যানেল বা গ্যাস সিলিন্ডারের মতো ভারী বস্তু যেন কম্পনে পড়ে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাতে না পারে—সেও নিশ্চিত করা জরুরি।
এ ছাড়া সিঁড়ি ও বহির্গমন পথ সবসময় খোলা ও বাধামুক্ত রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, “বাংলাদেশে ভূমিকম্পে সরাসরি মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলক কম; ভয়াবহতা তৈরি হয় ভবন ধসে পড়ার কারণে। তাই শক্তিশালী কাঠামো নিশ্চিত করাই হওয়া উচিত প্রথম অগ্রাধিকার।”
পারিবারিক প্রস্তুতি সবচেয়ে কার্যকর
ভূমিকম্পে আতঙ্কই বড় ক্ষতির কারণ। তাই পরিবারের সবাইকে নিয়ে আগে থেকেই একটি জরুরি পরিকল্পনা তৈরি করা প্রয়োজন। কোন স্থানে আশ্রয় নেওয়া নিরাপদ, কোন রাস্তা দিয়ে বের হতে হবে—এসব বিষয় পরিষ্কারভাবে জানাতে হবে। সপ্তাহে অন্তত একবার ‘ডাক–ঢাক–ঢুঁকুন’ (Drop, Cover, Hold) ড্রিল করলে শিশু থেকে বয়স্ক—সবারই মানসিক প্রস্তুতি বাড়ে।
ঘুমের জায়গার কাছে জুতা, টর্চলাইট, মোবাইল ও একটি হালকা জরুরি ব্যাগ রেখে দিলে প্রয়োজনে দ্রুত বের হওয়া সহজ হবে।
৭২-ঘণ্টার জরুরি ব্যাগ—জরুরি পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় সহায়তা
ভূমিকম্পের পর বিদ্যুৎ, পানি বা খাবার সরবরাহ ব্যাহত হওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তাই বিশেষজ্ঞরা ৭২-ঘণ্টার একটি জরুরি ব্যাগ সঙ্গে রাখার পরামর্শ দেন। এতে থাকা উচিত—প্রতি ব্যক্তির জন্য অন্তত ৩ লিটার পানি, শুকনা খাবার, প্রাথমিক চিকিৎসার কিট, নিয়মিত ওষুধ, টর্চলাইট, অতিরিক্ত ব্যাটারি, পাওয়ার ব্যাংক, প্রয়োজনীয় কাগজের কপি, নগদ টাকা, বাঁশি, মাস্ক, কম্বল ও স্যানিটারি সামগ্রী।
ভূমিকম্পের সময় কোথায় নিরাপদ?
দৌড়াদৌড়ি না করে যেখানে আছেন সেখানে নিরাপদ জায়গা খুঁজে নিতে হবে। শক্ত টেবিল বা ডেস্কের নিচে; লোড-বেয়ারিং দেয়ালের পাশে; জানালা ও কাচের জিনিস থেকে দূরে এবং রান্নাঘর ও বাথরুমের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা এড়িয়ে নিরাপদ কোণে
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় মাথায় বা শরীরে ভারী বস্তু পড়লে, জানালার কাচ ভেঙে, বা আসবাবপত্রের চাপায়। তাই এসব থেকে দূরে থাকা অত্যন্ত জরুরি।
পাড়া-মহল্লার প্রস্তুতিও গুরুত্বপূর্ণ
শুধু ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নয়—স্থানীয়ভাবে সমন্বয় থাকলে দুর্যোগের পর উদ্ধারকাজ আরও সহজ হয়। প্রতিবেশীদের সঙ্গে ছোট একটি স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করা, ফায়ার সার্ভিস বা রেডক্রসের প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া এবং এলাকার খোলা স্থান বা নিরাপদ জমায়েতস্থল নির্ধারণ করা—এসবই জরুরি প্রস্তুতি।
এ ছাড়া বাসাবাড়ি বা এলাকায় যদি ভবন-নির্মাণবিধি না মানা হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানোর মাধ্যমে সমষ্টিগত চাপ তৈরি করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে ভূমিকম্পের পর সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা হয় গ্যাস লাইনে আগুন ধরে গেলে। তাই—পরিবারের সবাইকে গ্যাস লাইনের মেইন ভালভ চিনিয়ে দিতে হবে; প্রয়োজনে দ্রুত বন্ধ করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে; বৈদ্যুতিক মেইন সুইচ কোথায়—এটিও জানা জরুরি এবং গ্যাস সিলিন্ডার সবসময় ঠাণ্ডা ও নিরাপদ স্থানে রাখতে হবে।
মানসিক প্রস্তুতিকে বিশেষজ্ঞরা সবচেয়ে গুরুত্ব দেন
নিয়মিত ড্রিল করলে আতঙ্ক কমে যায় এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ে। শিশুদেরও খেলার ছলে এসব নিয়ম শেখানো উচিত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের যেসব দেশে ঘন ঘন ভূমিকম্প হয়, সেসব দেশই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ—কারণ তাদের জনগণ ও অবকাঠামো দুটোই প্রস্তুত। বাংলাদেশেও সেই প্রস্তুতি এখন সময়ের দাবি।
তাই এখনই সময় নিজের বাসা, পরিবার এবং আশপাশের মানুষের সঙ্গে মিলিয়ে নিরাপত্তা পরিকল্পনা তৈরি করার। কেননা ভূমিকম্প আগে থেকে জানিয়ে আসে না, কিন্তু প্রস্তুতি প্রাণহানি কমাতে পারে—এটাই সবচেয়ে বড় শিক্ষা।