অ্যাডমিশন টেস্ট ভাগ্যের খেলা, দেড় ঘণ্টা ভালো ব্যাট করলেই সফলতা
- ২০ নভেম্বর ২০২৫, ১৮:৪০
মো. রুহান সরকার। ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটে ৪২তম স্থান অর্জন করেছেন। বর্তমানে আইন বিভাগে অধ্যয়ন করছেন তিনি। সম্প্রতি ভর্তি পরীক্ষায় নিজের সাফল্য ও নতুন ভর্তি পরীক্ষার্থীদের জন্য কিছু টিপস নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের।
আপনার স্কুল-কলেজ ও বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাই
আমার গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার পলাশবাড়িতে। আমার লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় উপজেলার ইউনিক কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে। সেখানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করি। এরপর ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি পলাশবাড়ি এস.এম. মডেল পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে নিজ জেলার গণ্ডি পেরিয়ে চলে আসা রাজধানী ঢাকায়। ভর্তি হই নটরডেম কলেজের মানবিক বিভাগে। এইচএসসিতে পড়ার সময় থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি প্রস্তুতি নিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটে ৪২তম স্থান অর্জন করি। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে অধ্যয়নরত আছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে- এমন চিন্তা কবে মাথায় এসেছিল?
এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সময় পর্যন্ত আমার লক্ষ্য ছিল মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার। এইচএসসিতে বিভাগ পরিবর্তন করে মানবিকে ভর্তি হওয়ার পর স্বভাবতই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছে সর্বাগ্রে মাথায় কাজ করত। কলেজের শিক্ষকদের নিয়মিত উৎসাহ, সঠিক দিকনির্দেশনা এবং আমাদের প্রতি তাদের বিশ্বাস— এসবই আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে লক্ষ্য হিসেবে নির্দ্বিধায় বেছে নিতে প্রভাবিত করেছে।
দিনে কত ঘণ্টা পড়াশোনা করতেন? প্রস্তুতিকালীন আপনার ২৪ ঘণ্টা পড়ার রুটিন কেমন ছিল?
আমার কাছে মনে হয়, ঘড়ি দেখে নয় বরং লক্ষ্যকে স্থির রেখে পড়া, এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত এবং তা হতে হয় ধারাবাহিকতা বজায় রেখে। আমার ক্ষেত্রে যদি বলি, অ্যাডমিশন সময়ে খুব বেশি সময় ধরে টানা পড়তাম এমন নয়, বরং কোচিং-এর প্রতিটা লেকচার বুঝে বাসায় তা অনুশীলন করতাম অধিক। এক্ষেত্রে বিভিন্নজনের ক্ষেত্রে এটা বিভিন্নভাবে কাজ করে। স্বাভাবিকভাবেই যার ভিত্তি তুলনামূলকভাবে একটু শক্ত থাকে, সে সহজেই কম সময়ে তার পড়াগুলো ধরতে পারে।
তুলনামূলকভাবে যারা এক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকে, তাদের সত্যিকার অর্থেই অধিক সময় ইনভেস্ট করতে হবে। সবসময়ই বলি, অ্যাডমিশন একটা ভাগ্যের খেলা। ঐ দেড় ঘণ্টায় যে ভালো ব্যাট করবে, সেই সফল। খুব ভালো প্রস্তুতি নেওয়া আমার ঐ বন্ধুও চান্স নাও পেতে পারে, তুলনামূলক কম পড়াশোনা করা মেয়েটাও ভালো পজিশন নিয়ে চান্স পেতে পারে। এজন্য এতটা হার্ডওয়ার্ক করো যাতে, সৃষ্টিকর্তা তোমাকে নিরাশ করতেও শতবার ভাবতে বাধ্য হন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণত সবচেয়ে বড় বাধা কোনগুলো? সমাধানের উপায় কী?
আমার মতে, এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে প্রতিবন্ধকতাগুলো কাজ করে তা হলো মানসিকভাবে পিছিয়ে পড়া, হীনমন্যতা কাজ করা, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলা প্রভৃতি ব্যাপারগুলো। খেয়াল করলে লক্ষ্য করা যায় যে, বাসা থেকে দূরে গিয়ে অনেকে বিভিন্ন কোচিং-এ ভর্তি হওয়ার ফলে হঠাৎ নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সমস্যা হওয়া বা ভুল সঙ্গদোষে লক্ষ্যচ্যুত হওয়ার আশঙ্কাও প্রবল থাকে। এছাড়াও, সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরিক্ত সময় অপচয়ও অন্যতম বাধা বলে আমি মনে করি। সমস্ত বাধা-বিপত্তিকে সামলে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে নিয়মিত পড়াশোনা ও অধিক অনুশীলন, মানসিক চাপ না রেখে প্রতিটা দিন যথাযথ ব্যবহারই সব বাধাকে অতিক্রম করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে বলে আমি বিশ্বাস করি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পূর্ববর্তী বছরের প্রশ্নগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ? সাধারণত কতটা প্রশ্ন থাকে?
‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ৬০ নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষা হয়। এর মধ্যে বাংলা ও ইংরেজিতে ১৫ করে ৩০ নম্বর ও সাধারণ জ্ঞানে ৩০ নম্বর থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় বিগত বছরের প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি খুব কম হয়। তবে প্রশ্নের ধরন কাছাকাছি হতে পারে। এজন্য যে বিষয়টি জরুরি তা হলো, একটি প্রশ্নব্যাংক কিনে বিগত বছরের সব প্রশ্ন সমাধান করা। এতে করে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় যে, প্রশ্নের ক্যাটাগরি কেমন হয়ে থাকে বা কোন বিশেষ টপিকগুলো তুলনামূলকভাবে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
শেষ সময়ের প্রস্তুতি নিয়ে আপনার পরামর্শ কী?
শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এই সময় সোশ্যাল মিডিয়া, অপ্রয়োজনীয় আড্ডা সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। পড়াশোনার পাশাপাশি যথেষ্ট ঘুম ও বিশ্রামও অপরিহার্য, কারণ ক্লান্ত মন নতুন কিছু শেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। প্রতিদিন অল্প হলেও নিয়মিত অধ্যয়ন করাই সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। একদিনে ১০ ঘণ্টা পড়ার চেয়ে প্রতিদিন ৫ ঘণ্টা পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে পড়া বেশি ফলপ্রসূ। সময় কম থাকলেও সঠিক পরিকল্পনা, ধারাবাহিক অনুশীলন এবং আত্মবিশ্বাস থাকলে ৪০–৪২ দিনের মধ্যে অনেক বিষয় আয়ত্ত করা সম্ভব। যারা সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাদেরই চূড়ান্ত সফলতা আসে।
পরীক্ষার আগে মানসিক চাপ কীভাবে সামলেছেন?
পরীক্ষার আগে মানসিক চাপ মোকাবিলা করা ছিল আমার প্রস্তুতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমি উপলব্ধি করেছিলাম, ভয় বা উদ্বেগ নয়, শান্ত ও স্থির মনই সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। তাই প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট রুটিনে পড়াশোনা করতাম, যাতে ক্লান্তি বা বিশৃঙ্খলা না আসে। প্রস্তুতিকালীন সময়ে কখনো অন্যের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করিনি। নিজের অগ্রগতিকেই মাপকাঠি হিসেবে নিয়েছিলাম।
কোচিং-এ নিয়মিত পরীক্ষায় অংশ নেওয়ায় আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠেছিল। চাপ বেড়ে গেলে কিছু সময় বিশ্রাম নিতাম বা পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতাম। পরীক্ষার আগের রাতে অতিরিক্ত চিন্তা না করে নিজেকে বলতাম, ‘আমি প্রস্তুত, আমি পারব।’ এই বিশ্বাস, ধারাবাহিক অনুশীলন এবং মানসিক দৃঢ়তাই আমাকে আত্মবিশ্বাসী ও সফল হতে সাহায্য করেছে।
প্রস্তুতিকালীন সময়ে ফেসবুক-ইউটিউব তথা সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা মোবাইল ব্যবহারে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা কতটা জরুরি?
এই সময়ে ফেসবুক, ইউটিউব ও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা বিশেষভাবে জরুরি। কারণ এগুলো অজান্তেই সময়কে নষ্ট করে, মনোযোগ কমিয়ে দেয় এবং পড়াশোনার গতিকে বাধাগ্রস্ত করে। অন্যদের সাফল্য দেখে হতাশা তৈরি হতে পারে, যা ঘুম ও মানসিক শান্তিকেও প্রভাবিত করে। তাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ হলো নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা এবং সময়কে সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা। প্রয়োজনীয় পেইজ বা চ্যানেলগুলোর আপডেট নিতেই কেবল ফেইসবুক বা ইউটিউব সীমিত সময়ের জন্য ব্যবহার করা উচিত, অন্যথায় কখনোই এ মুহূর্তে সময় অপচয় বাঞ্ছনীয় নয়।
পরীক্ষার হলে আপনার স্ট্র্যাটেজি কী ছিল? ভর্তিচ্ছুদের জন্য পরামর্শ কী?
ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষার হলে প্রবেশ করে প্রথমেই আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করেছি এবং সেই সব মানুষদের কথা মনে করেছি, যারা আমার সাফল্যের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এত চাপ থাকা সত্ত্বেও আমি স্নায়ু নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিলাম, কারণ মনে করতাম, নার্ভাস হলে আমার দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি বৃথা যাবে এবং আমার সব স্বপ্ন হেরে যাবে। তাই সব টেনশন দূরে রেখে পরীক্ষার প্রশ্ন হাতে নিয়ে সর্বপ্রথম সাধারণ জ্ঞান দাগিয়েছি, এরপর যথাক্রমে ইংরেজি ও বাংলা এমসিকিউ ভরাট করেছি। এটা বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন হতে পারে।
খেয়াল রাখতে হবে বাংলা’র স্থানে ইংরেজি বা সাধারণ জ্ঞানের স্থানে অন্য কোনো অংশ যেন দাগিয়ে না ফেলি। তাহলে সব শেষ! ৩০-৩৫ মিনিটের মধ্যে যত দ্রুত সম্ভব মাথা ঠান্ডা রেখে এমসিকিউ দাগিয়ে, এরপর শিক্ষকের অনুমতি নিলে শিক্ষক এমসিকিউ খাতা জমা নেয় এবং তৎক্ষণাৎ লিখিত খাতা দেয়। একইভাবে সতর্কতা অবলম্বন করে নাম, রোলসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু পূরণ করে লিখিত অংশ শুরু করতে হবে। আমি পরীক্ষার হলে এই স্ট্র্যাটেজিই ফলো করেছি এবং সাফল্য পেয়েছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতে সর্বনিম্ন কত ঘণ্টা না পড়লেই নয়, সর্বোচ্চ কত ঘণ্টা পড়তে হবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পড়ার সময় ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। তবুও আমার মতে, নিয়মিতভাবে দিনে অন্তত ৬–৭ ঘণ্টা অধ্যয়ন করলে যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘নিয়মিত অধ্যয়ন’—পড়াশোনা যেন ধারাবাহিক ও সুশৃঙ্খল হয়।
আপনার সাফল্যের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি কারণ কী বলে মনে করেন?
আমার এই সাফল্যের পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে লেখাপড়ায় ধারাবাহিক থাকা, নিয়মিত অনুশীলন করা এবং আত্মবিশ্বাস ধরে রাখা আমার জন্য সবচেয়ে কার্যকরী হয়েছে। পাশাপাশি পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের দোয়া ও ভালোবাসা এবং মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ কৃপা ছাড়া এই সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হতো না।
বিষয়ভিত্তিক সাবজেক্টগুলো নিয়ে কিছু সাজেশন দিন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় বর্তমানে বিষয়ভিত্তিক সাধারণ জ্ঞান প্রশ্ন খুব কম আসে। সর্বশেষ ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ভূগোল, আইসিটি ও অর্থনীতি বিষয় থেকে কিছু মৌলিক প্রশ্ন হয়েছিল। তবে ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে এটি আর লক্ষ্য করা যায়নি। আমার ধারণা, এর কারণ হলো এই ইউনিটে শুধু মানবিক শিক্ষার্থীরাই নয়, ব্যবসায় ও বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরাও অংশ নিচ্ছে, যাদের জন্য স্বল্প সময়ে মানবিক বিষয়ভিত্তিক সাধারণ জ্ঞান আয়ত্ত করা চ্যালেঞ্জিং।
বাংলা ও ইংরেজির ক্ষেত্রে সিলেবাস অন্তর্ভুক্ত মূল বইয়ের সব অধ্যায় পড়তে হবে। পাশাপাশি সিলেবাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো সম্পর্কে সম্যক প্রস্তুতি আবশ্যকীয়। অন্যদিকে, ‘ক’ ও ‘গ’ ইউনিটে পরীক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে মানবিক শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি ও আইসিটি ছাড়াও অর্থনীতি, ভূগোল, পরিসংখ্যান ও মনোবিজ্ঞান বিষয়গুলোর প্রস্তুতিও জরুরি।