চিকিৎসক সংকট: উপজেলায় চিকিৎসা সেবায় হাহাকার, অপেক্ষায় প্রান্তিক মানুষ

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স © ফাইল ছবি

দেশের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে চিকিৎসক সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। প্রায় অর্ধেক পদ শূন্য পড়ে থাকায় ব্যাহত হচ্ছে জরুরি ও মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা। ফলে সাধারণ অসুস্থতা থেকে শুরু করে মাতৃস্বাস্থ্য—সবক্ষেত্রেই সেবা পাচ্ছেন না প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষ। অন্যদিকে ৪৮তম বিশেষ বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজার চিকিৎসক দ্রুত নিয়োগের অপেক্ষায় থাকলেও নিয়োগ প্রক্রিয়ার অগ্রগতি আটকে রয়েছে।

সরেজমিন অনুসন্ধান এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, ঢাকার নিকটবর্তী কয়েকটি উপজেলা ছাড়া দেশের বেশিরভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই প্রয়োজনীয় সংখ্যার অর্ধেকেরও কম চিকিৎসক কর্মরত আছেন। তথ্য বলছে, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে—সহকারী সার্জন, মেডিকেল অফিসার, ডেন্টাল সার্জনসহ মোট ৮টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে কর্মরত চিকিৎসক মাত্র দুই জন। দেশের অন্যান্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিত্র একই।

এই সংকটের ফলে সবচেয়ে বড় ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন প্রান্তিক এলাকার সাধারণ মানুষ। ছোটখাটো সমস্যা নিয়েও রোগীদের জেলা হাসপাতালে ছুটতে হচ্ছে। সামান্য চিকিৎসাসেবা পেতেও দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করতে হচ্ছে বহু পরিবারের। এতে একদিকে যেমন রোগীরা বাড়তি আর্থিক চাপের মুখে পড়ছেন, অন্যদিকে জেলা সদর হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে।

ছোটখাটো সমস্যা নিয়েও আমাদের জেলা হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। অনেক সময় অ্যাম্বুলেন্সও পাওয়া যায় না। স্বাভাবিক সেবা পেতে হলে দ্রুত চিকিৎসক নিয়োগ ছাড়া উপায় নেই— মো. হেলাল, চিকিৎসা না পাওয়া ভুক্তভোগী।

চুনারুঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক স্বাস্থ্যসেবাকর্মী বলেন, ‘রাতের বেলা জরুরি রোগী এলে অনেক সময় চিকিৎসক পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে রোগীকে সরাসরি জেলা হাসপাতালে পাঠাতে বাধ্য হই।’

উপজেলা পর্যায়ের সেবাগ্রহীতারা বলছেন, চিকিৎসক সংকটের কারণে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে এন্টিবায়োটিক থেকে শুরু করে সাধারণ চিকিৎসা—অনেক কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। প্রসূতিদের ঝুঁকি বাড়ছে, জরুরি বিভাগে চিকিৎসা বন্ধ থাকার মতো পরিস্থিতিও সৃষ্টি হচ্ছে।

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার কয়রার বাসিন্দা মো. হেলাল দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ছোটখাটো সমস্যা নিয়েও আমাদের জেলা হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। অনেক সময় অ্যাম্বুলেন্সও পাওয়া যায় না। স্বাভাবিক সেবা পেতে হলে দ্রুত চিকিৎসক নিয়োগ ছাড়া উপায় নেই।’

স্বাস্থ্যখাতের কর্মকর্তারা বলছেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর চিকিৎসক সংকট দীর্ঘদিনের। তবে এতটা সংকট আগে দেখা যায়নি। একদিকে যেমন অনুমোদিত পদ বৃদ্ধি করা হয়েছে, অন্যদিকে দীর্ঘ সময় ধরে নতুন চিকিৎসক নিয়োগ না হওয়ায় সংকট ভয়াবহভাবে বেড়েছে।

কিশোরগঞ্জের একটি উপজেলার স্বাস্থ্য কেন্দ্রের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘২০২৫ সালের মধ্যে উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালী করার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু চিকিৎসক নিয়োগ না হলে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়বে।’

৪৮তম বিশেষ বিসিএস: নিয়োগ বিলম্বে ক্ষোভ ও অনিশ্চয়তা
উপজেলা পর্যায়ের ভয়াবহ চিকিৎসক সংকট নিরসনে চলতি বছরের শুরুর দিকে সাড়ে তিন হাজার চিকিৎসক নিয়োগের উদ্যোগ নেয় সরকার। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) ৪৮তম বিশেষ বিসিএস (স্বাস্থ্য)-২০২৫-এর মাধ্যমে এ পদগুলোতে নিয়োগ সুপারিশ করে। গত সেপ্টেম্বর মাসে সুপারিশপ্রাপ্তদের তালিকা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠায় পিএসসি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও শীর্ষ কর্মকর্তারা আশ্বাস দিয়েছিলেন—অক্টোবরের মধ্যেই এসব চিকিৎসককে উপজেলায় পদায়ন করা হবে।

কিন্তু নভেম্বরের শেষদিকে এসে এখনো তাদের নিয়োগের গেজেট প্রকাশ হয়নি। ফলে চিকিৎসকদের নিয়োগ প্রক্রিয়া অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছে, আর সংকটগ্রস্ত উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে।

সুপারিশপ্রাপ্ত কয়েকজন চিকিৎসক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, তারা দ্রুত যোগদান করতে চান। বিসিএস নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কেউ কেউ চলমান পোস্টগ্রাজুয়েশন কোর্স স্থগিত করেছেন, আবার অনেকে পূর্বের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে বাসা ছেড়ে দিয়েছেন। কর্মস্থলে যোগ দিতে না পারায় পরিবার নিয়ে নিদারুণ কষ্টে রয়েছেন সুপারিশপ্রাপ্ত চিকিৎসকরা।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে ৪৮তম বিসিএসে একজন সুপারিশপ্রাপ্ত চিকিৎসক বলেন, ‘আমরা দেশসেবার জন্যই বিসিএস দিয়েছি। কিন্তু নিয়োগ বিলম্বে আমরা নিজেও অনিশ্চয়তায় আছি, একই সঙ্গে দেশের প্রান্তিক মানুষ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, এটি আরও কষ্টদায়ক।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের যুগ্মসিচব রহিমা আক্তার দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ৪৮তম বিসিএসের বিষয়টি আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। তবে প্রার্থীদের পুলিশ ভেরিফিকেশ রিপোর্ট জমা না হওয়ায় সেগুলো যাচাই-বাছাই করে গেজেট জারি করা সম্ভব হয়নি। এখন (বুধবার, ১৯ নভেম্বর) ৫০ শতাংশের মতো ভেরিফিকেশন রিপোর্ট জমা হয়েছে। সবগুরো রিপোর্ট জমা হওয়ার পর গেজেট জারি করতে কিছুটা সময় লাগবে।’

প্রান্তিক জনগণের মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে দ্রুত নিয়োগই এখন প্রধান দাবি। চিকিৎসক সংকটে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা কাটাতে যত দ্রুত ৪৮তম বিশেষ বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের নিয়োগ গেজেট প্রকাশ ও পদায়ন জরুরি হয়ে উঠেছে।

সংশ্লিষ্টরা বিলছেন, সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও প্রশাসনিক জটিলতা দূর না হলে সমাধান আসবে না। দীর্ঘদিন ধরে অর্ধেক পদ শূন্য থাকায় স্বাস্থ্যসেবার যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা নিরসনে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন তারা।