সাফল্য ও সাহসের দৃষ্টান্ত নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
- ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ১৮:৩৪
মেঘনা নদীর মৃদু ঢেউ আর সমুদ্রের লবণাক্ত বাতাসের স্নিগ্ধ সুবাসে পরিবেষ্টিত নোয়াখালীর শান্ত ভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে এক উজ্জ্বল স্বপ্ন– নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নোবিপ্রবি)। সময়ের পরিক্রমায় গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠান আজ শুধু উচ্চশিক্ষার কেন্দ্র নয়, হয়ে উঠেছে প্রেরণার বাতিঘর ও সম্ভাবনার ঠিকানা। যেখানে জ্ঞান ও স্বপ্ন মিলেমিশে সৃষ্টি করেছে এক অনন্য পথ। বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় যাত্রার সূচনালগ্ন থেকে বর্তমান অবস্থানের সম্পূর্ণ পটভূমি তুলে ধরেছেন জিয়াউল করিম শামীম।
গৌরবময় যাত্রা ও বিকাশ
২০০৩ সালের ১১ অক্টোবর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে দেশের উপকূলীয় অক্সফোর্ড খ্যাত নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নোবিপ্রবি)। ২০০৬ সালের ২২ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। এটি বাংলাদেশের ২৭তম সরকারি ও পঞ্চম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিল নোয়াখালীবাসীর দীর্ঘদিনের উচ্চশিক্ষার আকাঙ্ক্ষা। ২০০১ সালে জাতীয় সংসদে “নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন” পাসের মাধ্যমে এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয়। বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখর এই ক্যাম্পাস হয়ে উঠেছে উদ্যম ও জ্ঞানের প্রতীক।
নোবিপ্রবির স্থাপনা ও স্বপ্নময় ক্যাম্পাস
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় জেলা শহর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দক্ষিণে, সোনাপুর-চরজব্বার সড়কের পশ্চিম পাশে ১০১ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। সবুজে ঘেরা এই ক্যাম্পাসে আধুনিক স্থাপত্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনন্য সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। ক্যাম্পাসে রয়েছে একাধিক একাডেমিক ভবন, শিক্ষার্থীদের আবাসনের জন্য নির্মিত হয়েছে ছাত্র ও ছাত্রী হল। শিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চার জন্য রয়েছে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার রয়েছে; যেখানে প্রায় ১০ হাজার বই এবং ২ হাজার বৈজ্ঞানিক জার্নাল সংরক্ষিত আছে। এছাড়া সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রমের জন্য রয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ মোহাম্মদ রুহুল আমিন অডিটোরিয়াম। গবেষণা সুবিধার জন্য কেন্দ্রীয় গবেষণাগার, শিক্ষার্থীদের সু-স্বাস্থ্যের জন্য শহীদ মীর মুগ্ধ মেডিকেল সেন্টার এবং খেলাধুলার জন্য আছে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা। প্রশাসনিক ভবন, মসজিদ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ক্যাম্পাসকে সম্পূর্ণ করেছে।
নোবিপ্রবিতে একাডেমিক বৈচিত্র্য ও শিক্ষার মান
নোবিপ্রবি আধুনিক শিক্ষার এক অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত। এখানে বর্তমানে ছয়টি অনুষদ এবং দুটি ইনস্টিটিউটের অধীনে ৩৩টি বেশি বিভাগে স্নাতক (সম্মান) এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি অনুষদ শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, দক্ষতা এবং গবেষণামূলক চিন্তাভাবনার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদে শিক্ষার্থীরা কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং, অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মেসি, মাইক্রোবায়োলজি, ফুড টেকনোলজি অ্যান্ড নিউট্রিশন সায়েন্স, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট, মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান এবং মেরিন সায়েন্সে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। সামাজিক বিজ্ঞান ও মানবিক অনুষদে ইংরেজি, অর্থনীতি, আইন, সমাজবিজ্ঞান এবং ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জন করে। ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম প্রোগ্রামের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ব্যবসা ও ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা অর্জন করে। শিক্ষা বিজ্ঞান অনুষদে শিক্ষা বিভাগ শিক্ষার্থীদের আধুনিক শিক্ষাপ্রযুক্তি ও শিক্ষানীতি সম্পর্কে বিস্তৃত ধারণা দেয়।
গবেষণা ও উদ্ভাবনে নোবিপ্রবি
গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে নোবিপ্রবি ইতিমধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। মৎস্য ও সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বেলাল হোসেন উপকূলীয় অঞ্চল থেকে ছয়টি নতুন অমেরুদণ্ডী প্রাণী প্রজাতি আবিষ্কার করেছেন, যার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামানুসারে Neumania nobiprobia। করোনা শনাক্তকারী কিট উদ্ভাবন টিমে যুক্ত ছিলেন অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ। পাশাপাশি জলবায়ু সহিষ্ণু ফসল, খাদ্য নিরাপত্তা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও ন্যানোটেকনোলজিতে গবেষণা চলছে অব্যাহতভাবে।
শিক্ষার বাইরে সহ-শিক্ষার কার্যক্রম
নোবিপ্রবি কেবল পাঠ্যক্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা, নেতৃত্ব ও সামাজিক দক্ষতা বিকাশে সহশিক্ষার কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ক্যাম্পাসে প্রায় ৪০টি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন নাটক, সংগীত, নৃত্য, বিতর্ক, বিজ্ঞান প্রদর্শনী ও সাহিত্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ডিবেটিং সোসাইটি ও NSTUMUNA শিক্ষার্থীদের যুক্তি, যোগাযোগ ও নেতৃত্ব বৃদ্ধি করে, অন্যদিকে সায়েন্স ও রিসার্চ ক্লাব গবেষণা ও উদ্ভাবনশীল মনোভাব বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখে। কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ ও ক্রীড়ার সুযোগ-সুবিধা শারীরিক সক্ষমতা ও দলগত কাজের মান উন্নত করে। সাংবাদিক সমিতি ও বাংলা সংসদ শিক্ষার্থীদের সাংবাদিকতা ও ভাষা-সংস্কৃতিতে দক্ষ করে। আর বিএনসিসি, রোভার স্কাউটস ও চলো পাল্টাই ফাউন্ডেশন সমাজসেবায় উৎসাহ দেয়।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পথে নতুন মাইলফলক
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষা ও গবেষণার ধারাবাহিক উন্নতির স্বীকৃতিস্বরূপ সম্প্রতি টাইমস হায়ার এডুকেশন (THE) ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাঙ্কিং ২০২৬-এ প্রথমবারের মতো স্থান করে নেয়। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের মাইলফলক। এই র্যাংকিংয়ে নোবিপ্রবি আন্তর্জাতিকভাবে ১২০১–১৫০০ এর মধ্যে অবস্থান করছে। স্থানপ্রাপ্ত দেশের ২৮টি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নোবিপ্রবি ১২তম স্থানে অবস্থান করছে। বিশেষভাবে, গবেষণার গুণগত মানের (Research Quality) ভিত্তিতে নোবিপ্রবি বিশ্বে ৭২২তম স্থান অর্জন করেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নোবিপ্রবি দেশের অন্যান্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান ধরে রেখেছে।
ভবিষ্যতের গবেষণা, উদ্ভাবন ও আধুনিক অবকাঠামোর অগ্রযাত্রা
নোবিপ্রবি ভবিষ্যতের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে শিক্ষার মানোন্নয়ন, গবেষণার প্রসার এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে নিজেকে দেশের অন্যতম আধুনিক ও বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার। গবেষণা ও একাডেমিক অগ্রগতিতে বিশ্ববিদ্যালয়টি ব্লু-ইকোনমি এবং উপকূলীয় উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। বড় উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক সমুদ্র ও সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন, যা হবে বিশ্বের প্রথম একক ইনস্টিটিউট যেখানে সমুদ্রবিজ্ঞান, ডেল্টা গঠন, পরিবেশগত বাস্তুবিদ্যা ও মহাকাশ গবেষণার সুযোগ মিলবে। উন্নত গবেষণার জন্য পরিকল্পনা রয়েছে একটি গ্রিন হাউজ গবেষণা কেন্দ্র এবং পাঁচতলা বিশিষ্ট নতুন গবেষণাগার ভবন স্থাপন। এছাড়াও, রোবোটিক্স, মেকাট্রনিক্স, স্পেস রিসার্চ, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) এবং ন্যানোটেকনোলজিসহ যুগোপযোগী নতুন বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীদেরকে গবেষণার সুযোগ দেওয়া হবে। আন্তর্জাতিক সংযোগের আওতায় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মোবিলিটি প্রোগ্রাম ও শিক্ষাসমন্বয় কার্যক্রমও চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। নোবিপ্রবি লক্ষ্য করছে নিজেকে একটি সেন্টার অব এক্সিলেন্স হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। অবকাঠামোগত উন্নয়নসম্প্রতি ৩৩৪ কোটি টাকার একটি বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদনের শেষপ্রান্তে। এর আওতায় একাডেমিক, প্রশাসনিক, গবেষণা ও সহায়ক অবকাঠামোর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। অসম্পূর্ণ একাডেমিক ভবন-৩ এর দ্রুত সমাপ্তি এবং নোবিপ্রবি স্কুল ও কলেজ ভবন নির্মাণ এই প্রকল্পের অংশ। ক্রীড়া ও অন্যান্য সুবিধার উন্নয়নও পরিকল্পনায় রয়েছে নতুন ভলিবল, টেনিস ও বাস্কেটবল কোর্ট, কেন্দ্রীয় মসজিদ সম্প্রসারণ এবং ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টার চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নোবিপ্রবির সাহসী ও বলিষ্ঠ ভূমিকা
২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নোবিপ্রবি) এবং এর শিক্ষার্থীদের অবদান ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু হওয়া এই গণঅভ্যুত্থানে নোবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছিল এবং ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আন্দোলনের সময় সরাসরি অংশগ্রহণের পাশাপাশি নোবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা তথ্য সংগ্রহ, প্রতিবেদন প্রকাশ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় নিরলস কাজ করেছে। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (নোবিপ্রবিসাস) এই সময় সাহসী ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিল, যার অবদান স্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিশেষ সম্মানে ভূষিত করে।
লেখক: শিক্ষার্থী, পরিবেশ বিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, নোবিপ্রবি