প্রতিকূলতাকে জয় করে পাবিপ্রবি শিক্ষার্থীর বোমা নিষ্ক্রিয়করণ রোবট উদ্ভাবন
- ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:২৩
বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিক্স কিংবা মহাকাশ গবেষণার মতো অগ্রসর প্রযুক্তিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশে সেই অবকাঠামো বা গবেষণা তহবিলের প্রাচুর্য নেই। উন্নত ল্যাব সুবিধা, পর্যাপ্ত অর্থায়ন কিংবা ধারাবাহিক গবেষণা পরিবেশের ঘাটতি এখানে প্রযুক্তিগত বিকাশকে জটিল করে তোলে। তবে এই চ্যালেঞ্জকে একমাত্র চিত্র হিসেবে দেখা হবে ভুল। কারণ, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম সীমিত সম্পদ নিয়েও যে কল্পনাশক্তি, উদ্ভাবনী দক্ষতা এবং অক্লান্ত মনোবল দেখাচ্ছে, তা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য এক নতুন আশার আলো হয়ে উঠেছে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্প-অঙ্গনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠা শুরু করেছে, স্টার্টআপ সংস্কৃতি ধীরে ধীরে শক্তিশালী হচ্ছে, আর একঝাঁক তরুণ তাদের সৃজনশীল প্রয়াস দিয়ে বিশ্বকে চমকে দেওয়ার মতো কাজ করে যাচ্ছে।
এই বাস্তবতার সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ তৈরি করেছেন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পাবিপ্রবি) ইলেকট্রিক্যাল, ইলেকট্রনিক অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইসিই) বিভাগের শিক্ষার্থী তানভীর ইসলাম চৌধুরী। সীমিত সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও তার উদ্ভাবনী উদ্যোগ এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তিনি তৈরি করেছেন বোমা নিস্ক্রিয়করণ রোবট।
চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা তানভীর ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তি নিয়ে খেলতে ভালোবাসতেন। বাবার পেশা ছিল বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে; সেখান থেকে শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ আর দেশপ্রেম শিখেছিলেন তিনি। কিন্তু তানভীরের শৈশবের নেশা ছিল যন্ত্রপাতি খুলে ফেলা, সার্কিট নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা কিংবা নতুন কিছু বানানোর চেষ্টা। পরিবারের অনুপ্রেরণার পাশাপাশি প্রযুক্তির প্রতি এই সহজাত কৌতূহলই তাকে একদিন বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখিয়েছে।
তুরস্কের দ্রুত প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, বিশেষ করে ড্রোন প্রযুক্তির সাফল্য, তানভীরকে ভীষণভাবে অনুপ্রানিত করে। তিনি বলেন, ‘তুরস্ক যেভাবে স্বল্প সময়ে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে বিপ্লব ঘটিয়েছে, তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তখনই ভেবেছিলাম, আমিও এমন কিছু তৈরি করব, যা দেশের কাজে লাগবে।’
তানভীরের হাতে তৈরি রোবটটি একটি অ্যাম্পিবিয়াস রোবট,যা স্থল ও পানিতে সমানভাবে কাজ করতে সক্ষম। পুরো সিস্টেমটি তিনি নিজের হাতে তৈরি করেছেন। এর সার্কিট ডিজাইন করা হয়েছে তানভীরের নিজস্ব লজিক গেট ডিজাইনের মাধ্যমে; কোনো আয়রন ব্যবহার করা হয়নি। বরং ট্রানজিস্টর ও ট্রানজিস্টর-ভিত্তিক উপাদান ব্যবহার করে তিনি নির্মাণ করেছেন জটিল লজিক সার্কিট।
রোবটটি পানিতে প্রবেশ করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্রিয় হয় এর রাডার। বিশেষ সার্কিট ডিজাইন করা হয়েছে এক্সপ্লোসিভ ডিসপোজাল কার্যক্রমের জন্য। রোবটে বসানো হয়েছে একটি রোবোটিক আর্ম, যা মুভ করে বোমা ধরতে ও সরাতে সক্ষম। একাধিক পাওয়ার সাপ্লাই এবং স্বতন্ত্র সার্কিট দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো সিস্টেম যাতে দুর্গম বা ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় মানুষের বদলে রোবটই নিতে পারে প্রধান দায়িত্ব।
বাংলাদেশের মতো দেশে উন্নত প্রযুক্তি তৈরি করা সহজ নয়। ল্যাব সুবিধার ঘাটতি, গবেষণা তহবিলের সীমাবদ্ধতা, কিংবা প্রশিক্ষিত সহায়কের অভাব সবই তানভীরের পথে বাধা ছিল। তবু তিনি থামেননি। তিনি প্রমাণ করেছেন, সুযোগ সীমিত হলেও উদ্ভাবন সীমাহীন।
পাহাড়ি অঞ্চল কিংবা দুর্গম এলাকায় কাজ করার কথাও মাথায় রেখেছিলেন তিনি। তাই রোবটটিকে করেছেন উভচর, যাতে সেনাবাহিনী কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ঝুঁকি না নিয়ে দূর থেকেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সহায়তা করে।
পাবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম আবদুল আওয়াল তানভীরের এই উদ্ভাবন দেখে প্রশংসা করেছেন। পাশাপাশি প্রযুক্তিগত কাঠামো ও কার্যকারিতা আরও উন্নত করার বিষয়ে দিয়েছেন পরামর্শ। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষার্থীরাও এই উদ্ভাবনকে দেখছেন অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে।
তানভীর বলেন, ‘আমি চাই আমার উদ্ভাবন দেশের মানুষের উপকারে আসুক। যদি সেনাবাহিনী কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এটি ব্যবহার করতে পারে, তাহলে আমার স্বপ্ন পূরণ হবে।’ তিনি মনে করেন, প্রযুক্তিই আগামী দিনে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে। নতুন প্রজন্মের দায়িত্ব শুধু স্বপ্ন দেখা নয়, বরং সেই স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেওয়া। তার এই রোবট যেন সেই দায়বদ্ধতার এক প্রতীক।