শেখ হাসিনার বিচারে যা বলেছেন সাক্ষীরা
- ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ০১:৪৬
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহে প্রসিকিউশন আদালতে মোট ৫৪ সাক্ষীর জবানবন্দি উপস্থাপন করেছে। মামলায় আসামি থেকে অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। প্রয়াত লেখক ও গবেষক বদরুদ্দীন উমরও মৃত্যু পূর্বে ট্রাইব্যুনালে লিখিত জবানবন্দি জমা দিয়েছেন।
আন্দোলন দমন এবং গুলি চালানোর সরাসরি নির্দেশ দেওয়ার প্রমাণও আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। একপর্যায়ে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। আন্দোলনের সময় রংপুরে পুলিশের সামনে বুক পেতে গুলি চালানোর শিকার খোকন চন্দ্র বর্মণ, আহতরা, জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
১০ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয়। তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন দমনে ১৪০০ জনকে হত্যার উসকানি, প্ররোচনা ও নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ, ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’ এবং ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ’-সহ মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলার অন্যান্য আসামি ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। মামুন দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়েছেন।
আরও পড়ুন: শেখ হাসিনাসহ ৩ জনের ভাগ্য নির্ধারণ সোমবার
জুলাই আন্দোলনে যাত্রাবাড়ী এলাকায় গুলিবিদ্ধ খোকন চন্দ্র বর্মণ আদালতে তার ক্ষতিগ্রস্ত মুখমণ্ডল প্রদর্শন করে শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান। ২৩ বছর বয়সী খোকনের বাঁ চোখ নষ্ট হয়, নাক ও মুখমণ্ডল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রথমে দেশে চিকিৎসা, পরে রাশিয়ায় চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হয়েছেন।
তিনি আদালতে বলেন, সেনাবাহিনী চলে যাওয়ার পর থানা থেকে পুলিশ বের হয়ে তাদের ওপর ‘পাখির মতো’ গুলি চালায়। আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করার সময় পুলিশ টার্গেট করে গুলি করে। গুরুতর আহত হওয়ার পর ছাত্ররা তাকে উদ্ধার করে এবং পরিবারের কাছে খবর দেয়। তাকে মুগদা ও ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়, পরে মিরপুর ডেন্টাল হাসপাতালে চিকিৎসা সম্পন্ন হয়।
নিহত আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেনও সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, জীবদ্দশাতেই ছেলে হত্যার বিচার দেখতে চান। ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরো সায়েন্স অ্যান্ড হসপিটালের চিকিৎসক মাহফুজুর রহমান জানান, আহতদের চিকিৎসা দিতে চাপ দেওয়া হয়েছিল এবং গুলিবিদ্ধদের সঠিকভাবে ভর্তি করতে বাধা দেয়া হয়েছিল। তাদের বয়স ছিল ১৩ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে এবং অধিকাংশই শিক্ষার্থী।
এছাড়া এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম আদালতে জানিয়েছেন, ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ও ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ আখ্যায়িত করে কোটা প্রথার পক্ষে অবস্থান নেন। ১৮ জুলাই সারাদেশে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আন্দোলন শুরু করলে নেতৃবৃন্দ জীবনের হুমকির মুখে আত্মগোপনে চলে যান।
তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর জানান, আন্দোলন দমনে পুলিশ সারাদেশে ৩ লাখ ৫ হাজার ৩১১ রাউন্ড গুলি ব্যবহার করেছে। ঢাকায় ৯৫ হাজার ৩১৩ রাউন্ড গুলি ব্যবহৃত হয়েছে।
দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান আদালতে বলেন, জাতিসংঘের প্রতিবেদনের বরাতে শেখ হাসিনা হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন এবং লাশ গুম করার নির্দেশ দিয়েছেন। জাতিসংঘের রিপোর্টে প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা গণহত্যা পরিচালনায় সরাসরি নিয়োজিত ছিলেন। তিনি তুলনা করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ফ্যাসিস্ট শাসক মুসোলিনি ও হিটলারের গণহত্যার সঙ্গে এবং বলেন, বাংলাদেশের জনগণ আশা করে, আর কখনও এমন ফ্যাসিবাদী শাসন দেশে ফিরে আসবে না।