কেমন হওয়া উচিত আমাদের শীতকালীন ওয়াজ মাহফিলগুলো
- ১২ নভেম্বর ২০২৫, ২২:০৭
হেমন্তের নরম রোদ আর কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরের আভায় ধ্বনিত হচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। বাংলাদেশের শীতকাল যেন এক বিশেষ ধর্মীয় উচ্ছ্বাস নিয়ে আসে। শহর-শহরতলী থেকে গ্রামে, মসজিদ থেকে মাঠে- শীতের সন্ধ্যা নামলেই কোথাও না কোথাও শুরু হয় ওয়াজ মাহফিল। হামদ-নাতের সুর, তিলাওয়াতের ধ্বনি আর মানুষের ঈমান জাগানো আলেমদের বক্তব্য- এসব মিলেই সৃষ্টি হয় এক অনন্য ধর্মীয় আবেশ। ওয়াজ মাহফিল আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে দ্বীনি শিক্ষা, নৈতিকতা ও সামাজিক বন্ধনের উৎস হিসেবে কাজ করে আসছে। গ্রামের মানুষ বছরজুড়ে অপেক্ষা করে থাকে এই মৌসুমের মাহফিলগুলোর জন্য।
ইসলামের প্রচার-প্রসার, বিস্তৃতি ও স্থায়িত্বে ওয়াজ মাহফিলের অবদান অনস্বীকার্য। সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে ইসলামমুখী করা, ঈমান-আমলের চেতনা জাগানো এবং নৈতিক পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে ওয়াজ মাহফিলের ভূমিকা অনন্য।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ নবুয়তের গুরুদায়িত্ব লাভের পর যখন মানুষের কাছে প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের ঐশী নির্দেশ পেলেন, তখন তিনি মক্কার সাফা পাহাড়ে উঠে গোত্রে গোত্রে নাম ধরে সবাইকে আহ্বান করলেন। সমবেত জনতার সামনে তিনি যুক্তি, প্রমাণ ও হৃদয়স্পর্শী আহ্বানের মাধ্যমে আল্লাহর একত্ববাদ ও পরকালে বিশ্বাসের সত্যতা তুলে ধরলেন। এভাবেই শুরু হয় ইসলামী দাওয়াত ও ওয়াজ মাহফিলের সোনালি ইতিহাসের প্রথম অধ্যায়।
পরবর্তীকালে নবী ﷺ মক্কার বিভিন্ন গণসমাবেশ, উৎসব কিংবা মজলিসে উপস্থিত হয়ে ইসলামের সৌন্দর্য, মানবতার বার্তা ও নৈতিকতার দিকগুলো অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপন করতেন। তিনি নিজে যেমন প্রচার করতেন, তেমনি সাহাবায়ে কেরামকেও দাওয়াত ও ওয়াজের জন্য বিভিন্ন স্থানে পাঠাতেন- কেউ ইয়েমেনে, কেউ মিসরে, কেউবা শামে। সাহাবায়ে কিরামের (আঃ) পর তাঁদের উত্তরসূরি তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈনগণও সেই দায়িত্ব বহন করে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামের সুমহান শাশ্বত বাণী পৌঁছে দেন।
তাঁদের অবর্তমানে যুগে যুগে ইসলামী স্কলার, উলামা-মাশায়েখ ও দাঈ-ইলাল্লাহরা সেই দাওয়াতি মঞ্চকে জীবন্ত রেখেছেন ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমে। ফলে আজও মুসলিম সমাজে ইসলামি চেতনা জাগ্রত রাখার অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ওয়াজ মাহফিল তার আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে রেখেছে। এই ধারাবাহিকতার মাধ্যমেই ইসলাম পৌঁছেছে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে- হৃদয় থেকে হৃদয়ে, ঘর থেকে ঘরে।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই পবিত্র আয়োজনের মাঝে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত প্রবণতা জায়গা করে নিয়েছে, যা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময়ের স্রোতে এই পবিত্র আয়োজনের মধ্যে প্রবেশ করেছে কতিপয় ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী উপাদান- অতিরিক্ত শব্দ, রাতভর আলোচনা, বিলাসী মঞ্চ, বক্তাদের অতি পারিশ্রমিক, এমনকি অর্থ সংগ্রহের নামে শিশুদের মাঠে নামানো পর্যন্ত। এভাবে একসময়ের আল্লাহভীতির মাহফিল অনেক স্থানে পরিণত হচ্ছে প্রতিযোগিতা, লোকদেখানো আর ব্যবসায়িক প্রচারণার মঞ্চে।
তবে হতাশার কিছু নেই- যদি আমরা চাই, এই মাহফিলগুলো পুনরায় হতে পারে দাওয়াতের সত্যিকার ক্ষেত্র, যেখানে ইসলাম শেখার আনন্দ, নৈতিকতার চর্চা এবং সমাজ সংস্কারের প্রেরণা মিলবে। এজন্য দরকার কিছু গভীর উপলব্ধি ও দায়িত্বশীল দৃষ্টিভঙ্গি।
উদ্দেশ্যের বিশুদ্ধতা সবচেয়ে জরুরি
ওয়াজ মাহফিলের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টি ও দ্বীনের প্রচার। কিন্তু বাস্তবে অনেক জায়গায় দেখা যায়, মাহফিল এখন কখনো কখনো লোকদেখানো ও প্রতিযোগিতার রূপ নিচ্ছে। কে বেশি বড় মঞ্চ করবে, কে বেশি আলো-ঝলমলে সাজসজ্জা দেবে, কোন বক্তা বেশি জনপ্রিয়- এসব বিষয় নিয়েই যেন বেশি আলোচনা হয়। অথচ ইসলামের মূল শিক্ষা হলো বিনয়, ইখলাস (খাঁটি নিয়ত) ও পরিমিতিবোধ। আয়োজকদের মনে রাখতে হবে, ওয়াজ মাহফিলের লক্ষ্য মানুষকে বদলানো, মানুষকে অভিভূত করা নয়; হৃদয়ে ঈমানের ছোঁয়া লাগানো, হৈচৈ তোলা নয়।
পাশাপাশি, বর্তমান সময়ে ওয়াজ মাহফিলের সঙ্গে সম্পৃক্ত তিন শ্রেণির- কমিটি, বক্তা ও শ্রোতা- সবাই অনেক ক্ষেত্রেই পরিশুদ্ধ নিয়ত থেকে বিচ্যুত হচ্ছে বলে পরিলক্ষিত হয়। কারও মাঝে থাকে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির প্রবণতা, কারও মাঝে জনপ্রিয়তা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা, আবার কারও মাঝে থাকে কেবল বিনোদন বা কৌতূহল মেটানোর মনোভাব। অথচ ইসলামী দাওয়াতের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং সমাজে সৎ চিন্তা ও সঠিক আমলের জাগরণ সৃষ্টি করা।
অতএব, মাহফিল-সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকেরই উচিত নিজেদের নিয়ত পরিশুদ্ধ করা, অহংকার ও স্বার্থের মিশ্রণ পরিহার করা এবং একান্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন, পরিচালনা ও অংশগ্রহণ করা। তবেই মাহফিল তার প্রকৃত উদ্দেশ্য- ইসলামের দাওয়াত, মানবিক উন্নয়ন ও নৈতিক সমাজ বিনির্মাণ- সার্থকভাবে পূরণ করতে পারবে।
বক্তা নির্বাচনে জ্ঞান ও চরিত্রের মূল্য
ওয়াজ মাহফিলের প্রাণ হচ্ছেন বক্তা। তবে অনেক সময় বক্তা নির্বাচনের ক্ষেত্রে মাহফিল কমিটি ব্যক্তি পরিচিতি, জনপ্রিয়তা বা ইউটিউব ভিউ-এর উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেন, যা দুঃখজনক। অথচ একজন সত্যিকারের আলিমের মূল বৈশিষ্ট্য হলো- দলিলভিত্তিক বক্তব্য, জীবনাচরণে ইসলামের আদর্শ প্রতিফলিত করা এবং মানুষকে বিভাজন নয়, বরং ঐক্যের পথে আহ্বান করা। সৎ আলেমের বক্তৃতা হয় কোমল, যুক্তিসঙ্গত ও আন্তরিক; তার কণ্ঠে থাকে দাওয়াতের সুর, নাটকীয়তার নয়; থাকে দিকনির্দেশনা, ভয় দেখানো বা হুমকি নয়।
দুঃখজনকভাবে অনেক কমিটি আজকের দিনে বক্তা ভাইরাল কি না, বক্তার কণ্ঠের স্বর ও ধ্বনি, বক্তা গান গাইতে বা মানুষকে হাসাতে পারেন কি না, বিভিন্ন বক্তার কণ্ঠ নকল করতে পারেন কি না, বিভিন্ন সুরে আজান দিতে পারেন কি না ইত্যাদি যোগ্যতার ভিত্তিতে বক্তা নির্বাচন করে থাকেন। এভাবে প্রথাগত মর্যাদা ও যোগ্যতা যেমন- মুফতি, মুহাদ্দিস, শাইখুল হাদিস, মুহতামিম, প্রিন্সিপাল বা প্রবীণ আলিম- যোগ্যতর আলিমগণ ক্রমান্বয়ে জনসাধারণ থেকে দূরে সরে যায়। বয়সে কম বা একাডেমিক যোগ্যতায় কম হলেও শুধু ভাইরাল হওয়ার কারণে কাউকে প্রধান বক্তা বানানো হয়।
এমন মনোভাব ও সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা প্রত্যেক মাহফিল কমিটির একান্ত প্রয়োজন। কারণ ওয়াজ মাহফিলের সত্যিকারের উদ্দেশ্য পূরণ হয় কেবল তখনই, যখন বক্তা জ্ঞান, চরিত্র ও নৈতিকতার মাপকাঠিতে উত্তম এবং তার ভাষণে প্রতিফলিত হয় দ্বীনের সৌন্দর্য, মানবিকতা ও সৎ চিন্তার বার্তা।
সময়, পরিবেশ ও মানবিক দিক
অনেক জায়গায় মাহফিল রাতভর চলে। এতে বক্তারা ক্লান্ত হন, আশপাশের অসুস্থ, বৃদ্ধ ও শিশুরা ঘুমাতে পারেন না। ইসলামে এভাবে ধর্মের নামে কাউকে কষ্ট দেওয়া জায়েয নয়। তাই মাহফিলের সময় এমনভাবে নির্ধারণ করা উচিত, যাতে তা সমাজের কারো জন্য বিরক্তির কারণ না হয়। বিকেল থেকে স্থানভেদে সর্বোচ্চ রাত ১১টার মধ্যে মাহফিল শেষ করা সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দিনভিত্তিক বা বিকেলভিত্তিক মাহফিলের প্রচলন এখন বেড়ে চলছে- এটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এতে মানুষের উপস্থিতিও বাড়ে, নিরাপত্তা ঝুঁকি কমে এবং রাতভর শব্দ দূষণ থেকেও মুক্তি মেলে।
শব্দ নিয়ন্ত্রণ ও শালীনতা
ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও শৃঙ্খলা ও সংযম জরুরি। মাইকের আওয়াজ এতটা বেশি হওয়া ঠিক নয় যে আশেপাশের মানুষ বিরক্ত হয়। ইসলাম সবকিছুতেই পরিমিতি শিখিয়েছে। সাধারণত প্যান্ডেল এলাকায় মাইকের শব্দ সীমিত রাখা উচিত; এলাকাভেদে প্যান্ডেলের আশপাশের এলাকায়ও মাইক দেওয়া যায়। কিন্তু সেটি যেন কোনোক্রমেই দূরবর্তী এলাকায় না দেওয়া হয়, বিশেষত ইশার পরের/বিশ্রামের সময়গুলোতে। তদুপরি, মাহফিলের কথা শোনা যাবে এমন পর্যায়ে শব্দ রাখা- এটাই যথেষ্ট। কারণ দ্বীনের দাওয়াত উচ্চস্বরে নয়, প্রভাবিত করে আন্তরিকতার মাধ্যমে। দ্বীনের কথা কেবল মুখ দিয়ে বের হয়ে গলাবাজি হলে কেবলই তা মানুষের কানে পৌঁছে; আর যদি তা নিঃসারিত হয় বক্তার অন্তরাত্মা থেকে, তবে সেটি পৌঁছে যায় শ্রোতার মানসপটে।
সাজসজ্জায় সংযম, পরিচ্ছন্নতা, পর্দা ও নিরাপত্তা
ওয়াজ মাহফিল মানে শুধু মঞ্চ নয়- এটি এক সামাজিক আয়োজন। তাই পুরুষ ও নারীর জন্য আলাদা পর্দার ব্যবস্থা, বসার জায়গা পরিষ্কার রাখা, আলো ও পানির ব্যবস্থা, নিরাপত্তা- সব কিছুতেই যত্ন থাকা দরকার। একটি সুশৃঙ্খল, পরিপাটি মাহফিল আয়োজকদের সুস্থ মানসিকতারই প্রতিফলন।
অনেক জায়গায় মাহফিল আয়োজনের নামে অতিরিক্ত খরচ করা হয়। বিলাসবহুল সাজসজ্জা, অতিরিক্ত আলোকসজ্জা বা অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ইসলামি দৃষ্টিতে অপচয়। বক্তাদের অত্যধিক ফি মেটাতে গিয়ে কখনো কখনো জবরদস্তিমূলক চাঁদা তোলা হয়, এমনকি শিশুদের দিয়েও টাকা সংগ্রহ করানো হয়- এটি খুবই অনুচিত।
মাহফিলের আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি অপরিহার্য
দানের অর্থ নির্ধারিত খাতেই ব্যয় করতে হবে। মাহফিলের নামে অর্থ তুলে অন্য কাজে ব্যবহার করা বা নিজেদের মধ্যে ভাগ করা অনৈতিক ও গর্হিত। ব্যয় শেষে উদ্বৃত্ত অর্থ থাকলে দাতাদের সম্মতিতে কল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা যেতে পারে।
ওয়াজ মাহফিলের অডিও-ভিডিও ধারণেও সতর্কতা জরুরি। বক্তার পূর্ণ সম্মতি ও আয়োজকদের তত্ত্বাবধানে রেকর্ড করা উচিত। ইউটিউব বা ফেসবুকে প্রচারের আগে তা যাচাই করা দরকার। দর্শক টানার জন্য ভুয়া বা দৃষ্টিকটু শিরোনাম ব্যবহারকারী কাউকে রেকর্ডের অনুমতি দেওয়া উচিত নয়।
প্যান্ডেল ও তৎসংলগ্ন এলাকায় বিদ্যুৎ ব্যবহারে বৈধতা নিশ্চিত করতে হবে। অবৈধ সংযোগ ব্যবহার করা সম্পূর্ণ অন্যায়। প্রয়োজনে অনুমতি ও বিল পরিশোধের মাধ্যমে নিরাপদ সংযোগ নিতে হবে।
আলোচকদের সম্মানজনক ইনসাফপূর্ণ হাদিয়া প্রদান।
ইসলামে দাওয়াতি কাজ কখনো বাণিজ্যের বিষয় নয়। এটি হলো খাঁটি নিয়ত, ইখলাস এবং ত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি মাধ্যম। বক্তাদেরও উচিত ওয়াজকে দ্বীনের প্রচারের উদ্দেশ্য হিসেবে দেখা। আলোচকদের মূল দায়িত্ব হলো- দ্বীনের জন্য ওয়াজ করা। ওয়াজকে যদি অন্য পেশার মতো বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে পরিণত করা হয়, তবে তার ফল সীমিত হবে এবং মুসলিম সমাজের জন্য প্রকৃত কল্যাণ আসবে না। তবে যারা দ্বীনি কাজে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন এবং যাদের এ কর্মকাণ্ড দ্বীনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাদের জন্য যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক গ্রহণকে প্রায় সব ইসলামিক স্কলার জায়েজ মনে করেন।
এজন্য মাহফিলে বক্তার যাতায়াত, গাড়িভাড়া বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচের পাশাপাশি সাধ্যমত সম্মানজনক হাদিয়া দেওয়া যেতে পারে। তবে এটি কখনো অতিরিক্ত বা অপচয়মূলক হওয়া উচিত নয়। দর-কষাকষি বা চড়া মূল্য হাঁকানো কখনোই প্রকৃত আলেমের কাজ হতে পারে না।
মোটকথা, আয়োজকদের চেষ্টা থাকবে সাধ্যমত বক্তাকে সম্মানজনক হাদিয়া দেওয়া আর বক্তা-আলোচকদের চেষ্টা থাকবে সম্পূর্ণ ইখলাস সহকারে আলোচনা করার। এভাবে উভয় পক্ষের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সংযমের মাধ্যমে ওয়াজ মাহফিলকে মানুষকে ঈমানমুখী করা এবং সমাজে নৈতিক চেতনা জাগ্রত করার মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়।
ওয়াজের বিষয় হোক বাস্তব ও কল্যাণকর
বর্তমান সমাজে মানুষ যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি- যেমন পরিবারে অশান্তি, অসততা, নৈতিক অবক্ষয়, যুবসমাজের বিপথগামিতা- এসব নিয়েই আলোচনা হওয়া দরকার।
বক্তারা যেন বিভাজন, রাজনীতি বা উস্কানিমূলক বক্তব্যের বদলে ইসলামি মূল্যবোধ, সামাজিক ন্যায় ও মানবিকতার দাওয়াত দেন। ওয়াজের উদ্দেশ্য হলো মানুষকে সচেতন করা, দীনমুখী করা, ভালো কাজে উৎসাহিত করা- এই মূল জায়গায় ফিরতে হবে।
এছাড়াও দেখা যায় একই অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন দিনে ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হলেও ওয়াজের বিষয়বস্তু বক্তাগণ নিজেরা ইচ্ছামত নির্ধারণ করে থাকেন; আলোচনা বিষয় সম্পর্কে শ্রোতাগণ না হলেও অন্ততপক্ষে আয়োজক কমিটির কোনোরূপ পূর্ব ধারনা থাকে না। সেক্ষেত্রে সম্ভব হলে এলাকাভিত্তিক ওয়াজ মাহফিলগুলোর কমিটিগুলো স্থানীয় উলামায়ে কিরামের নেতৃত্বে ও পরামর্শক্রমে নিজেদের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে ওয়াজ মাহফিলের আলোচনার বিষয় নির্ধারণে দূরদর্শী হলে স্থানীয় জনসাধারণ ব্যাপকভাবে উপকৃত হতে পারেন।
যেমন একটি ওয়াজ মাহফিলের একজন বক্তা সন্তানের অধিকার নিয়ে আলোচনা করলে অন্য বক্তা পিতা-মাতার অধিকার নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। পরবর্তী বক্তা প্রতিবেশীর অধিকার নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। কইভাবে কয়েকদিন পরেই অনুষ্ঠিতব্য পাশের গ্রামের আলোচনার বিষয় এভাবে আশেপাশের ওয়াজ মাহফিলের আলোচনাগুলোর সাথে সামঞ্জস্য রেখে ঠিক করা হলে জনসাধারণ বিভিন্ন ইসলামী বিষয়ে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও পরিপূর্ণ ধারণা লাভ করতে পারবেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমান ওয়াজ মাহফিলগুলো থেকে সাধারণত জনসাধারণ কিছু বিচ্ছিন্ন ইসলামী বিষয়ে ধারণা/জ্ঞান লাভ করে থাকেন মাত্র, যেটি কেবল সুস্থ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আরও অধিক ফলপ্রসূ করা যায় বলে আমি বিশ্বাস করি।
ওয়াজ মাহফিল হোক কল্যাণের ক্ষেত্র
ওয়াজ মাহফিল ইসলামের এক মহৎ দাওয়াতি প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে মানুষ শেখে নামাজ, সততা, পরোপকার, আল্লাহভীতি ও মানবতা। তাই এই আয়োজন যেন কেবল প্রচারণা নয়, বরং আত্মশুদ্ধির কেন্দ্র হয়। আয়োজকরা যদি দায়িত্বশীল হন, বক্তারা যদি বিনয়ী ও সত্যবাদী হন, শ্রোতারা যদি মনোযোগী ও শালীন হন- তাহলে ওয়াজ মাহফিল আমাদের সমাজে সত্যিই আলো ছড়াবে। সর্বোপরি, দ্বীনের আহ্বান হৃদয় ছুঁয়ে যাক, শব্দ নয়; আমাদের মাহফিলগুলো হোক নৈতিকতার উৎসব, অহংকারের নয়।
লেখক: মোহাম্মদ আলী হাসান, প্রভাষক, আল-ফিকহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকা।