বাসে অগ্নিসংযোগে চালকের মৃত্যু
হাতে এখনো বিয়ের মেহেদীর রং, অগ্নিদগ্ধ স্বামীর স্মৃতিতে পুড়ছেন জাকিয়া
- ময়মনসিংহ প্রতিনিধি
- ১২ নভেম্বর ২০২৫, ১৮:৪৪
চারদিকে ধানক্ষেত। কুয়াশায় ভিজে রয়েছে কাঁচাপাকা আমন ধান। মাঝখানের একটি টিনশেডের বাড়ি থেকে বিলাপে ভারী হচ্ছে কুয়াশার সকাল। গ্রামের মানুষ ধানক্ষেতের আইল দিয়ে ছুটছে সে বিলাপ করা বাড়ির দিকে। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ভালুকজান এলাকায় আলম এশিয়া পরিবহনের একটি বাসে দুর্বৃত্তদের অগ্নিসংযোগে দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন চালক জুলহাস মিয়া (৩৫)। ঋণের টানাপোড়েনে গাড়িতেই রাত কাটাতেন তিনি। এখন তার টিনশেড ঘরজুড়ে শুধু কান্না—বিলাপ মা, বোন আর মেহেদী রাঙা হাতে স্ত্রীর। অগ্নিদগ্ধ স্বামীর স্মৃতিতে পুড়ছেন স্ত্রী জাকিয়া আকতার।
ফুলবাড়িয়া পৌর সভার ভালুকজার মাদানী মসজিদের নিকবর্তী নিহত জুলহাসের বাড়ি। এক বছর আগে ৬ শতাংশ জমি ৬ লাখ টাকা দিয়ে কিনে তাতে একটি টিনশেডের বাড়ি নির্মাণ করেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ভালুকজান পেট্রলপাম্পের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাসে অগ্নিসংযোগে অঙ্গার ঘুমন্ত চালক জুলহাস মিয়া।
পুলিশ ও এলাকাবাসী জানান, ফুলবাড়িয়া-ঢাকায় চলাচলকারী আলম এশিয়া পরিবহনের একটি বাসের চালক ছিলেন জুলহাস। এক বছর আগে ব্যাংক ও এনজিও থেকে ৬ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ৬ শতাংশ জমি কিনেন। তাতে আধাপাকা টিনশেডের একটি ঘর নির্মাণ করেন। প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা কিস্তি দিতেন জুলহাস। ঋণের টাকার চাপে সে গাড়িতেই রাত্রি যাপন করতেন। সপ্তাহে একদিন সে বাড়িতে আসতেন বলে জানান ছোট বোন ময়না আকতার।
সরেজমিন বুধবার (১২ নভেম্বর) সকালে বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, মাটিতে গড়াগড়ি করে ছেলে শোকে বিলাপ করছেন মা সাজেদা আকতার। তিনি তার সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। কারও কোন কথাই সে শান্ত্বনা পাচ্ছে না।
নিহত জুলহাসের ছোট বোন ময়না আকতার বলেন, ‘আমরা এক ভাই এক বোন। খুব কষ্ট করে দরিদ্র পরিবারে আমরা বড় হয়েছি খেয়ে না খেয়ে। আমাদের ঘাড়ে এখন ৬ লাখ টাকা ঋণের বোঝা। আমাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম নিহত হওয়ায় এখন কী করব, কোথায় যাব।’
নিহতের স্ত্রী জাকিয়া সুলতানা বসে আছে বারান্দায়। কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল শুকিয়ে গেছে তার। মানুষ দেখলেই এখন ফ্যাল ফ্যাল করে থাকিয়ে থাকে। কী করবেন, কোথায় যাবেন, কেন এমন হল এমন হাজারো প্রশ্ন তার মনে। এক বছর আগে দুই পরিবারের সম্মতিতে মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হয় তাদের। স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে ঢুকরে কেঁদে ওঠেন জাকিয়া। মেহেদী রাঙা হাতে চোখ মুছে উঠানে জুড়ো হওয়া মানুষের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকান তিনি।
এদিকে বাসে আগুন দিয়ে চালককে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় মামলা হয়েছে। মামলার সিসিটিভি দেখে আসামি শনাক্ত করে আনোয়ার হোসেন (৩৬) নামের একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার আনোয়ার হোসেন পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তিনি ওই এলাকার মৃত আব্দুর রশিদের ছেলে।
এর আগে মঙ্গলবার রাতে নিহতের ছোট বোন ময়না আক্তার ফুলবাড়িয়া থানায় অজ্ঞাতনামা আসামি করে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ও হত্যা মামলা করেন।
ফুলবাড়ীয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রুজনুজ্জামান জানান, এ ঘটনায় ফুলবাড়িয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল আলিম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। পরে আসামি শনাক্তের পর নিহতের ছোট বোন বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ও হত্যা মামলা দায়ের করেন। অপর দুই আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
এ ঘটনায় নিহত জুলহাসের বাড়িতে সরকারি সাহায্য নিয়ে যান ফুলবাড়িয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আরিফুল ইসলাম। বুধবার (১২ নভেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে উপজলা নির্বাহী অফিসার একটি সেলাই মেশিন ও নগদ ৫০ হাজার তুলে দেন নিহত পরিবারের হাতে।
উপজেলা নির্বাহী বলেন, ‘বাসে আগুন দিয়ে যারাই এমন নির্মম ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের শাস্তির আওতায় হবে। আপনাদের প্রতি আমাদের একটা দৃষ্টি থাকবে। যে কোনো প্রয়োজনে আপনারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।’
উল্লেখ্য, সোমবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে ভালুকজান পেট্রল পাম্পের সামনে তিনজন মুখোশধারী আলম এশিয়া পরিবহনের বাসে আগুন দেয়। আগুনে চালক জুলহাস বাসের ভেতরে পুড়ে মারা যায়।