বিরোধ-সহিংসতায় প্রাণহানি, পরিবর্তন আসতে পারে বিএনপির প্রার্থী তালিকায়

বিএনপির দলীয় পতাকা
বিএনপির দলীয় পতাকা © সংগৃহীত ছবি

বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপির ঘোষিত প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর থেকে সারাদেশে দলের ভেতরে বিরোধ ও উত্তেজনা ক্রমেই প্রকাশ্য রূপ নিচ্ছে। ঘোষিত প্রার্থীদের মাঠপর্যায়ের গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করতে এখন নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান দিয়ে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। যাচাই-বাছাই শেষে প্রাথমিক তালিকায় কিছু পরিবর্তন আসারও ইঙ্গিত দিয়েছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা বলে খবর প্রকাশ করেছে বিবিসি।

আজ সোমবার (১০ নভেম্বর) সন্ধ্যায় ‘‘বিএনপির প্রার্থী তালিকা নিয়ে বিরোধ সামলাতে 'নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের যাচাই'’’ শিরোনামে প্রকাশিত ওই খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির ঘোষিত প্রার্থী তালিকাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে দলের মধ্যে তৈরি হওয়া বিরোধ গত কয়েকদিনে আরো প্রকাশ্যে এসেছে। 

পরিস্থিতি সামাল দেয়ার অংশ হিসেবে যারা মনোনয়ন পেয়েছে মাঠপর্যায়ে তাদের অবস্থান নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান দিয়ে যাচাই করা হচ্ছে বলে দলটির সূত্রে জানা যাচ্ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কেউ কোনো মন্তব্য না করলেও, যাচাই বাছাইয়ের পর ঘোষিত 'প্রাথমিক প্রার্থী তালিকাতে' কিছু পরিবর্তন আসতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন দলটির নেতারা।

আরও পড়ুন: দুই মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ

দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ অবশ্য বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, দল থেকে কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং এর ফলে খুব শিগগিরই দেশের সব আসনে তার দলের নেতারা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন বলে তারা আশা করছেন।

তবে মাঠপর্যায়ে ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। মনোনয়নকে কেন্দ্র করে অন্তত দুটি জেলায় সহিংসতায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, রবিবার ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনে সংঘর্ষে একজন নিহত হওয়ার পর বেশ কয়েকজন স্থানীয় নেতাকে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় বিএনপি। সোমবার মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলায় দ্বন্দ্বের জেরে গুলিতে আরেকজন নিহত হন।

এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে বিক্ষোভ, মানববন্ধন, সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। দলীয় দফতর বিভাগ জানিয়েছে, সহিংসতায় জড়িতদের অনেককেই ইতোমধ্যে বহিষ্কার করা হয়েছে। অন্যদিকে শরিক দলের জন্য আসন ছেড়ে দেয়ার বিষয়েও দলের ভেতরে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

৩ নভেম্বর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৩৭টি আসনের প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেন। পরদিন একটি আসনে মনোনয়ন স্থগিত করা হয়। দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আরও ৬৩টি আসনে পরবর্তীতে প্রার্থী ঘোষণা করা হবে, যার বেশিরভাগই সমমনা বা মিত্র দলকে ছেড়ে দেয়া হতে পারে।

তবে ঘোষণার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। চট্টগ্রামে সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর অনুসারীরা সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে তার পক্ষে মনোনয়ন দাবি করেন। হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মুন্সীগঞ্জ, সাতক্ষীরা, ফেনী, নাটোর, কুড়িগ্রাম, রাজশাহী, শরীয়তপুরসহ বহু জেলায় ঘোষিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় নেতাকর্মীরা মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবি তুলেছেন।

ফেনী-২ আসনে জেলা বিএনপির সদস্যসচিব আলাল উদ্দিন আলাল ক্রিকেটীয় ভাষায় “রিভিউ আবেদন” করে নতুন আলোচনার জন্ম দেন। অন্যদিকে নোয়াখালীর এক প্রার্থী আগে জামায়াতে ইসলামী থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন—এমন তথ্য প্রকাশ পেলে সেখানেও প্রার্থী পরিবর্তনের আলোচনা চলছে।

দলের অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, কয়েকজন প্রার্থী বয়সজনিত কারণে সক্রিয়ভাবে প্রচারণা চালাতে পারছেন না। ফেনী, হবিগঞ্জ, নাটোর, কুষ্টিয়া ও বরিশালের একাধিক আসনে এ ধরনের অভিযোগ উঠেছে। আবার কিছু এলাকায় ভাই-বোন বা স্থানীয় দ্বন্দ্ব মেটাতে প্রার্থী পরিবর্তনের আলোচনা চলছে।

বিএনপির সমমনা একটি দলের একজন নেতা ঢাকায় প্রার্থী হওয়ার কথা থাকলেও এখন নিজ জেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান। তবে তার আসনে ইতোমধ্যে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করায় সেখানে আবারও উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক কেএম মহিউদ্দিন মনে করেন, বিএনপি মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ করেনি, যার ফলে অভ্যন্তরীণ বিরোধ বেড়েছে। দলটির পার্লামেন্টারি বোর্ড বসে প্রার্থী তালিকা করার নিয়ম থাকলেও তা হয়নি। ফলে যারা বাদ পড়েছেন তারা সিদ্ধান্ত মানতে রাজি নন। এই প্রতিযোগিতা এবং ক্ষোভই সহিংসতার জন্ম দিচ্ছে।

তার মতে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সম্ভাবনার কারণে বিএনপির নেতাকর্মীরা মনে করছেন দল নিশ্চিতভাবে ক্ষমতায় আসছে, তাই প্রতিটি আসনেই মনোনয়ন পেতে লড়াই তীব্র হয়েছে। শরিক দলের জন্য আসন ছাড়ার সময় সংকট আরও বাড়বে। এসব কারণে নির্বাচনের সময়ও সহিংসতা বাড়তে পারে।

দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, ঘোষিত ২৩৬ জন প্রার্থীর মধ্যে যাদের নিয়ে বিতর্ক বা প্রশ্ন রয়েছে, তাদের অবস্থান মাঠপর্যায়ে নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা হচ্ছে। পূর্বেও এলাকা ভিত্তিক জরিপ করা হয়েছিল, কিন্তু এবার প্রাপ্ত প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় নতুন করে বিশ্লেষণ চলছে। যাচাই শেষে কিছু আসনে প্রার্থী পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছে না বিএনপি।