তিন প্রজন্মের শিক্ষার্থীর স্মৃতির পাতায় ঢাবির ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
- ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ২২:০৬
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ৭৫ বছর পূর্তি উৎসব উদযাপন এবং বিভাগটির প্রাক্তন ছাত্র সমিতির গ্র্যান্ড রি-ইউনিয়ন অনুষ্ঠান ৮ নভেম্বর টিএসসিতে অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেছিলেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। অনুষ্ঠানে উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান পিএইচডি। অনুষ্ঠানে বিভাগের বিভিন্ন প্রজন্মের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মিলন মেলা রূপ নেয় এক আবেগঘন পরিবেশে। দীর্ঘদিন পর একে অপরকে পেয়ে তারা খোশগল্পে মেতে উঠেন। ঐতিহ্যবাহী এই বিভাগের তিন প্রজন্ম অর্থাৎ স্বাধীনতা পূর্ববর্তী, স্বাধীনতা পরবর্তী ও একবিংশ শতাব্দীতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কথা শুনে লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজমুস সালেহীন বিন সাইফ।
পানির ট্যাংকে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করি
আমি ১৯৬৬ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে পাকিস্তান আর্মিতে জয়েন করার ইচ্ছে পোষণ করি। আমার উচ্চ ব্লাড প্রেসার থাকায় পাকিস্তানের আইএসএসবির পরীক্ষা থেকে বাদ দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে ঐ বছরের জুলাই মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে অনেক সিট খালি ছিল। আমি সেখানে ভর্তি হয়ে যাই। তবে এই সাবজেক্ট আমার পছন্দ ছিল না। সত্যি বলতে আমার বেশির ভাগ বন্ধুবান্ধব ছিলো অর্থনীতি বিভাগে। বিভাগে আমার প্রিয় শিক্ষকদের ভেতর ছিলেন এবিএম হবিবুল্লাহ, সিরাজুল ইসলাম, লতিফা আকন্দ, আব্দুল আলিম, সুফিয়া ম্যাডাম ও আশরাফুদ্দিন আহমেদ।
১৯৭১ সালের সালের ১ মার্চ আমার এমএ পরীক্ষা শেষ হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের রেজাল্ট প্রকাশিত হয়। আমার আবাসিক জীবন কেটেছে জিন্নাহ হলে (বর্তমানে সূর্যসেন হল)। আমার মনে পড়ে, সকাল বেলায় ১ টাকা দিয়ে দুইটা ডিম, মাখন, রুটি, কলা ও এক কাপ চা কিনে নাস্তা করতাম। ছাত্র জীবনে আমি এনএসএফ করতাম। ঐ সময় পূর্ব পাকিস্তানে এনএসএফ জমির আলী ও দোলন গ্রুপ নামে দুইভাগে বিভক্ত ছিলো। ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আমিসহ মোট ৪ জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনশন করি (১৮-২২ ফেব্রুয়ারি)। পরে শেখ মুজিব জেল থেকে মুক্তি পেয়ে আমাদের অনশন ভাঙান। পুরো ছাত্র জীবনে একটা স্মরণীয় ঘটনা আছে আমার, যেটা উল্লেখ না করলেই নয়। ১৯৬৯ সালের ১৮ জানুয়ারি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন ক্যাম্পাসে তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলনে আমি নিজেও যুক্ত ছিলাম। সেসময় ইপিআর জিন্নাহ হলে ঢুকে শিক্ষার্থীদের উপর ধরপাকড় চালায়। অনেক শিক্ষার্থীকে ইপিআর আটক করে নিয়ে যায়। আমি ঐ সময় ৭ তলার ছাদের উপরে পানির ট্যাংকে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করি।
যাহোক, ১৯৭২ সালে আমার শিক্ষকতা জীবন শুরু হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে জয়েন করার পিছনে বহু ঘটনা রয়েছে। আমি উর্দু ভাষী ছিলাম। তাই আমাকে সেসময় বাংলাদেশপন্থি সনদ আনতে বলা হয়েছিল। চবিতে শিক্ষকতার পর ১৯৭৩ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জয়েন করি। পরবর্তীতে আমি প্রফেসর হিসেবে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর, Independent University, Bangladesh (IUB), কানাডার ভ্যানকুভার-এ অবস্থিত University of British Columbia, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই রাজ্যের security studies at the Asia - Pacific Center for Security Studies ( APCSS ) কাজ করি।
আমার প্রথম বই বাংলায়,‘ঔপনিবেশিক বাংলা’ (কলকাতা প্যাপিরাস প্রকাশনী,১৯৮৫ সাল)। আমার ছয়টা অ্যাকাডেমিক বই Macmillan, Routledge, SAGE, Westview Press প্রকাশ করেছে, যেগুলো Oxford ও Harvard এর মতো ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো হয়। এই পাবলিশারগুলো পৃথিবীর দশটা সেরা পাবলিশারের অন্তর্গত। আমি Oxford University তে post-doc fellow ছিলাম, যা বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে আমার জন্য খুবই গৌরবের। আমি ১৯৯৭ সালে Royal Asiatic Society of Great Britain and Ireland - এর একজন Fellow হিসেবে মনোনীত হই। FRAS হবার জন্য চিঠি দিয়ে আমন্ত্রণ করা হয়। পৃথিবীতে জীবিত ৫/৭শত জন এ ধরনের অর্জনের অধিকারী। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, সৌভাগ্যক্রমে বাংলাদেশি মোট তিনজনের ভেতর আমার এ বিরল সম্মান জুটেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান ও নোবেলজয়ী বাঙালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর FRAS ছিলেন।
বর্তমানে, আমি কানাডায় অবসর জীবনযাপন করছি এবং আমার ইউটিউব চ্যানেলে (Taj Hashmi's World) বাংলাদেশ ও বিশ্বের সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কথা বলি। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ৭৫ বছরের পূর্তি অনুষ্ঠান হচ্ছে শুনে আমি বেশ আনন্দিত। এজন্য আমি ছাত্র, শিক্ষক ও অ্যালামনিদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।
ড. তাজুল ইসলাম হাশমী (১৯৬৬-৬৭ সেশন)
প্রাক্তন অধ্যাপক, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর ও এপিসিএসএস, হাওয়াই, যুক্তরাষ্ট্র।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সেশন ১৯৬৭-৬৮। সেকালে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় বেশ চ্যালেঞ্জ ছিলো। আমার বাবা আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য বেশ উৎসাহ দিতেন। তিনি ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে এমপি হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, আমার বাবা শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ও অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর পিএ হিসেবে কাজ করেছিলেন। বাবা চাইতেন, আমি শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হই। তিনি ইতিহাসবিদ এবিএম হাবিবুল্লাহ ও মমতাজুর রহমান তরফদার সম্পর্কে জানতেন।
তবে আমার পড়ার ইচ্ছে ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি বিভাগে। বাবার আগ্রহে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ভর্তি হই। কিন্তু এই সাবজেক্টের উপর মন বসছিল না আমার। অবশ্য বিভাগের শিক্ষকগণ আমাকে এ ব্যাপারে বেশ উৎসাহ দিলেন। আমি এমএ-তে ইসলামিক আর্ট এন্ড আর্কিওলজিতে ভর্তি হয়েছিলাম। রোকেয়া হলে আমার আবাসিক জীবন শুরু হয়। সুযোগ পেলেই আমি ঢাকা বাদে অন্য জেলার বান্ধবীদের এলাকায় ঘুরতে যেতাম। সে সময় রোকেয়া হলের ভেতর বড় একটি পুকুর ছিল। এখন প্রযুক্তির যুগ। সবাই গুগল ও এআই ব্যবহার করে জ্ঞান অর্জন করেন। কিন্তু ঐ সময় হাতে বই এলে আমাদের আনন্দের সীমা থাকতো না।
যাহোক, আমার কর্মজীবন শুরু হয় জগন্নাথ কলেজ দিয়ে। পরে চারুকলা কলেজে পদ খালি হলে আমি সেখানে বদলি হই। চারুকলা কলেজ ১৯৮৪ সালে চারুকলা ইনস্টিটিউটে রূপান্তরিত হয়। আমি পরবর্তীতে নিজ বিভাগে ২০০১ সালে অধ্যাপক হিসেবে জয়েন করি। আমি পুরো জীবনে বেশ কিছু সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম। বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ ও বাংলাদেশের এশিয়াটিক সোসাইটিতে সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছি। বর্তমানে আমি বাংলাদেশ স্টাডি, সোসাইটি অ্যান্ড কালচার সমিতির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আমি ইসলামিক আর্টস অর্গানাইজেশনের সভাপতি ছিলাম। এ পর্যন্ত আমার লেখা ৫০টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। আমার তত্ত্বাবধানে এ পর্যন্ত ৬টা পিএইচডি ও ৫টা এমফিল হয়েছে।
আমার শিক্ষা জীবনের শেষ দিকে একটি স্মরণীয় ঘটনা রয়েছে। এসময় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। চেয়ারম্যান তখন এবিএম হবিবুল্লাহ স্যার। তিনি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে দ্রুত আমাদের আমি পরীক্ষা শেষ করে দেন। আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে ট্রেনিং নিই। যদিও আমার মা আমাকে বাধা দিয়েছিলেন। তবে আমার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ হয়নি। ১৯৭১ সালের বেশিরভাগ সময় আমাদের পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। তখন আমাদের কেউই থাকার জায়গা দিতেন না। আমাদের বলা হতো ‘ওর বাবা ও ভাই মুক্তিযুদ্ধে গেছে, এদের জায়গা দেওয়া যাবে না।’ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমার বাবাকে পাকিস্তানের এমপি হওয়ার প্রস্তাব দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। আমরা সেই চিঠি ছিঁড়ে ফেলি।
ইসলামী ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ ৭৫ বছর পার করল। বিভাগের সাথে আমার একটি আত্মার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বিভাগের সাথে সুদীর্ঘ এই পথ চলায় যার অবদান আজ স্মরণ করতে হয় তিনি হলেন আমার স্বামী মুহাম্মদ মাসুম খান মজলিস। তিনি আমাকে সবসময় অনুপ্রেরণা দিয়ে এসেছেন। সবাইকে বিভাগের প্লাটিনাম জয়ন্তীর শুভেচ্ছা।
অধ্যাপক ড. নাজমা খান মজলিস
সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাক্তন অধ্যাপক, চারুকলা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ক্যাম্পাস জীবনে মধুর সময় কেটেছে, তবে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কারণে সেশনজটের শিকার হয়েছিলাম
আমার পছন্দের তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম ছিল না। আমার এক কাজিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। সে সুবাদে ১৯৮৭-৮৮ সেশনে সেখানে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে যাই। প্রকৃতপক্ষে তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারিনি। যাহোক, রাবিতে আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে ১ মাসের মতো অধ্যয়ন করেছিলাম। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বড় ভাইয়ের পরামর্শে ভর্তি হই। আমি এই সিদ্ধান্তটিকে আমার জীবনের মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা বলতে পারি। বিভাগ জীবনের কিছু স্মৃতির কথা বলা যাক। আসলে আমি ছিলাম গ্রাম থেকে আসা একজন মানুষ। তাই প্রথমদিকে সেসময় বিভাগে পড়া আমার সেশনের নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের সচেতনভাবে এড়িয়ে চলতাম। পরবর্তীতে অবশ্য তাদের সাথে আমার সুসম্পর্ক তৈরি হয়। অনার্সের ফলাফলে আমি প্রথম স্থান লাভ করেছিলাম। আমি এমএতে আধুনিক মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের ইতিহাস গ্রুপের শিক্ষার্থী ছিলাম। সেখানেও আমি প্রথম হই। আমার জানা মতে, এটি ঐ গ্রুপের এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ফলাফল।
আমি সূর্যসেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলাম। বন্ধু বান্ধবের সাথে ক্যাম্পাস জীবনে মধুর সময় কেটেছে। এফ রহমান হলেও অনেক সময় রাতে থেকেছি। আমার পড়াশোনার শেষের দিকে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী লড়াই সংগ্রাম শুরু হয়। আমি সেখানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের কারণে আমাদের সেশনজট হয়েছিল। ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলাম। আমি সেসময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্বৈরাচার বিরোধী লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিই। বহু ছাত্র জনতার শাহাদাতের মাধ্যমে একই বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটে।
আমি বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ বিভাগে পাঠদান করছি। এটি আমার জন্য একই সাথে গৌরবের ও সম্মানের। নতুন বাংলাদেশে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ ৭৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান আয়োজন করছে। আমি সত্যিই আবেগ আপ্লুত! আজকের আনন্দের এই দিনে আমার শ্রদ্ধেয় মুসা আনসারী স্যারকে স্মরণ করছি। সবার জন্য আমার শুভ কামনা।
অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান খান (১৯৮৭-৮৮ সেশন)
ডিন, কলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি।
মা-বাবা চাননি ঢাবিতে ভর্তি হই
লে. জেনারেল এরশাদের পতনের প্রাক্কালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে আমার পিতামাতা তেমন রাজি ছিলেন না। তবে পাশে গ্রামের বড় ভাই সত্যজিৎ রায় আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। আমার জিয়া হলে এলটমেন্ট পড়েছিল কিন্তু আমি প্রথম ৬ মাস থাকতে পারিনি। আমাদের সময়ে পুরোদমে এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলছিল। সদ্য ভর্তি হওয়া একজন শিক্ষার্থীর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় আসলে নতুন এক পরিবেশ, নতুন এক জীবন। বিভাগের তেমন ভালো ছাত্র না হলেও শিক্ষকদের সাথে আমার বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। বিভিন্ন সময়ে বিভাগের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। দেখতে দেখতে বিভাগের ৭৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান চলে আসল। এই বিশ্ববিদ্যালয় তথা বিভাগ আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে।
আজকে আমি একজন ব্যবসায়ী হিসেবে ব্যস্ত সময় পার করছি। আমি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার দরুন নতুন নতুন অভিজ্ঞতা শিখতে সক্ষম হয়েছি।
আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশের নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা রাখেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমার বেশ কয়েকটি স্মৃতিচারণ রয়েছে। এর মধ্যে আমি একটি উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করছি। এরশাদ সরকারের সময় ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাদের কাছে আমি অস্ত্রের ঝনঝনানি দেখেছি। পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে ছিলো আতঙ্কজনক অবস্থা। আমি সর্বদা নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ার স্বপ্ন দেখতাম। সেজন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্যাম্পাসে কর্মরত এক পুলিশ অফিসারকে বিষয়টি অবহিত করি। কিন্তু তিনি আমাকে নিজের অসহায়ত্ব তুলে ধরেন এবং এক পর্যায়ে আমাকে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে বলেন। সেই স্মৃতি আজও আমার মনে উঁকি দিয়ে বেড়ায়। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ ৭৫ বছর পাড়ি দেওয়ায় আমি খুবই আনন্দিত। প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের বন্ধন আরও সুদৃঢ় হোক, সেটাই আমি কামনা করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অসংগতি আমাকে বেশ পীড়া দেয়। নতুন বাংলাদেশ পরবর্তী সময়ে ঢাবি সিনেটে কথা বলার জন্য সুদক্ষ নেতৃত্ব খুবই প্রয়োজন। পরিশেষে সবার জন্য আমার শুভ কামনা রইলো।
জাহিদ মিলন (১৯৮৯-৯০ সেশন)
চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
মাইক্রোম্যাড কোম্পানি লিমিটেড।
যখন টাকা ধার লাগবে চলে আসবা
আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে দুই বন্ধুর বিশাল অবদান ছিলো। তাদের একজন আজিজুল হক (বর্তমানে বাংলাদেশ পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির কর্মকর্তা) যিনি ঢাবির জসীমউদ্দিন হলের ছাত্র। অন্যজন হলেন জামান (বর্তমানে মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক) যার সাথে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছিলাম। দুজনেই আমাকে নানাভাবে সহায়তা করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলে উঠার এক বছর পর আমি সিট পেয়েছিলাম। আমাদের সময় হলের পরিবেশ খুবই নিয়ন্ত্রিত ছিলো। সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের দাপুটে আচরণে সবাইকে বেশ তটস্থ থাকতে হতো। বলতে গেলে ‘গণরুম প্রথার’ স্বর্ণযুগ আমাদের সময়টাকেই বলা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনে পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখা ২০২০ সাল থেকে কিন্তু সাংবাদিকতা শুরু ২০২১ সালে। ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময়কালে সাংবাদিকতায় জড়িত ছিলাম। ‘বিজয় একাত্তর হলে ধরে ধরে শিক্ষার্থী পেটানোর অভিযোগ’ শীর্ষক শিরোনামে দৈনিক কালবেলায় প্রকাশিত রিপোর্টটি আমিই করেছিলাম। এই নিউজটি এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, সেসময় সাংবাদিকগণ উত্তপ্ত ক্যাম্পাসের অন্য তথ্য সংগ্রহ করতে বেশি ব্যস্ত ছিলেন, কিন্তু হলপাড়ার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যেতে বাধা দেওয়া হচ্ছিল -তা নজর কম ছিলো। যাহোক, ক্যাম্পাসের সব হল বন্ধ করে দেওয়া হয় ১৭ জুলাই। এদিন দুপুরে আমি হল ত্যাগ করি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে স্মৃতির ক্যাম্পাসে সেসময়কার অনেক ঘটনা জমে আছে। একটি স্মৃতিচারণ না করলেই নয়। আমার সৌভাগ্য এই যে, নিজ বিভাগে কয়েকজন দুর্লভ শিক্ষকের সান্নিধ্য লাভ করেছিলাম। তাদের মধ্যে এক মহান শিক্ষকের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। ইতিহাস চর্চার প্রতি অনুরাগ, মানবিক মূল্যবোধ অর্জন ও বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে জীবন গড়ার অনুপ্রেরণা আমি সেই শিক্ষকের কাছ থেকে পেয়েছিলাম। ছাত্রজীবনের শেষ দিকে একবার জরুরি কাজে আমার বেশ কিছু টাকার প্রয়োজন হয়েছিল। সেসময়কার চাকুরিজীবী এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে ধার চাই। ফলাফল খালি হাতে ফেরা। অথচ সেই বন্ধুটির দেবার মতো সামর্থ্য ছিলো। অনেকটা বেদনাহত হয়ে স্যারের দ্বারস্থ হই। স্যার টাকা ধার দিলেন এবং বললেন, ‘বিপদে পড়লে যখনই টাকা ধার লাগবে তখনই আমার কাছে চলে আসবা!’ আমার এখনও মনে আছে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বেশ কয়েকবার সেই মানবতাবাদী শিক্ষকের কাছে টাকা ধার নিয়ে ফেরত দিয়েছিলাম।
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ আমার শতজনমের ভালোবাসা। বিভাগের ক্লাস করা, পিকনিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আমি বেশ উপভোগ করতাম। পড়াশোনায় বেশ সিরিয়াস থাকায় শিক্ষক মহোদয়দের সাথেও বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। দেখতে দেখতে ইসলামের ইতিহাস ও বিভাগ ৭৫ বছর পাড়ি দিয়েছে। শুভদিনে বিভাগটি প্রতিষ্ঠাতায় যারা অবদান রেখেছেন আমি তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। আমি মনে করি, বিভাগের সোনালী অর্জনের ‘ মুকুটের’ একটি পালক ‘ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সমিতি’। তারাও এই আয়োজনের অন্যতম সহযোগী। আমার প্রত্যাশা সমিতি কেবল প্রাক্তনদের নিয়ে নয়, বর্তমান পড়ুয়াদের সার্বিক সমস্যার দিক গুলো নিয়েও কাজ করবে। আল্লাহ হাফেজ।
মো: জামিন মিয়া (২০১৬-১৭ সেশন)
গবেষণা সহযোগী
বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি
ই-মেইল: mdjaminmia.du@gmail.com
১৭ জুলাই বিকেলে হল ত্যাগ করি
আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াটায় ছিল এক মিরাক্কেল। আমি ২০১৬ সালে যখন এইচএসসি পরীক্ষা দেই তখনও জানতাম না আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেব। মূলত আমার মরহুম বাবা এবং বড়ভাই ফিরোজ খান-এর পরামর্শে কোচিং-এ ভর্তি হই। আমি কমার্সের ছাত্র হলেও ডি ইউনিট থেকে আমার প্রাণপ্রিয় ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ভর্তি হই। স্বাভাবিকভাবে কমার্সের ছাত্র হওয়ায় মানবিকে এসে মনটা খারাপ ছিল। যাহোক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুজিব হলে থাকার ব্যবস্থা হয় আমার। এসময় গণরুমে ব্যাপক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনের শুরু থেকেই আমি বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে যুক্ত হই। বিশেষ করে বাঁধন তার মধ্যে অন্যতম। এছাড়াও বিএনসিসি, স্কাউট ও পিতিবিএফ-এর সাথেও যুক্ত ছিলাম। আমি এই পর্যন্ত নিজে ৩৩ বার রক্ত দিয়েছি। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে আমি সরাসরি যুক্ত জড়িত ছিলাম। সেসময় ক্যাম্পাস বেশ উত্তপ্ত ছিল এবং ১৭ জুলাই সব হল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এদিন বিকালে আমি হল ত্যাগ করি।
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ আমার ভালোবাসার বিশেষ এক জায়গা। সত্যি বলতে প্রথমদিকে এই বিভাগে এসে আমি খাপ খাওয়াতে পারছিলাম না। ফলে আমার সিজিপিএ কম যায় অবশ্য পরে সেটা পুষিয়ে নিয়েছিলাম। আমাদের ব্যাচের গালা নাইটের উদযাপনে আমিই নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। পরে অনেকেই আমার উদ্যোগে ও প্রোগ্রামের আয়োজন সফল হওয়ায় প্রশংসা করেছিলেন। একসময় যে বিভাগের পড়াশোনা করেছি আজ আমি সেই বিষয়ের প্রভাষক! ঐ যে বললাম জীবন কারো জন্য থেমে থাকেনা, আমিও থেমে নেই। হাঁটি হাঁটি করে ইসলামের ইতিহাস ও বিভাগ ৭৫ বছর পাড়ি দিয়েছে। এই ধরনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পেরে সত্যিই আমি আনন্দিত।আমি বিভাগের বর্তমান, প্রাক্তনসহ তাদের পরিবার পরিজনের মঙ্গল কামনা করছি।
এইচ.এম. ফেরদাউস খান (২০১৬-১৭ সেশন)
প্রভাষক, বগুড়া করোনেশন ইনস্টিটিউশন অ্যান্ড কলেজ ও সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা, এনআরবি ব্যাংক পিএলসি
ইমেইল: hmferdaus2042@gmail.com