৭ নভেম্বর: জাতীয় সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের দিন

 প্রফেসর ড. সাইফুল ইসলাম 
প্রফেসর ড. সাইফুল ইসলাম  © টিডিসি সম্পাদিত

বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর এক অনন্য উজ্জ্বল অধ্যায়। এটি শুধু রাজনৈতিক পালাবদলের দিন নয়—এটি ছিল জাতীয় সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারের ঐতিহাসিক বিপ্লব। এই দিনে সিপাহী ও সাধারণ জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশকে এক গভীর সংকট থেকে রক্ষা করেছিলেন। আর এই গণবিপ্লবের নেতৃত্বে আবির্ভূত হন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম — যিনি ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক, এক সাহসী সেনাপতি এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের সফলতম রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ইতিহাসে অমর।

জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘উই রিভোল্ট' (We Revolt) মন্ত্রে প্রথম সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ সূচনার ঘোষণা দেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। দেশকে তিনি দেখেছেন সবার উপরে, নিজের স্ত্রী-সন্তানদের বাড়িতে রেখে গেছেন যুদ্ধের ময়দানে। তাঁর ঘোর শত্রুরাও কখনও তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলতে পারেনি। তিনি 'উচ্চ চিন্তা, সাধারণ জীবন' (High Thinking, Simple Living) নীতি অনুসরণ করে গেছেন। আজও তিনি জনমানুষের হৃদয়ে বিতর্কের ঊর্ধ্বে এক চিরন্তন ও শাশ্বত নেতা হিসেবে সমুজ্জ্বল। দলের মধ্যেও তাঁর স্থান প্রশ্নাতীতভাবে সর্বোচ্চ।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে গণতন্ত্র, ন্যায় ও সমতার প্রতিশ্রুতি নিয়ে একটি নতুন রাষ্ট্র গঠিত হলেও বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। দেশে তখন দুর্ভিক্ষ, প্রশাসনিক দুর্নীতি, আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি, ভয় ও অনিশ্চয়তায় মানুষ ছিল দিশেহারা। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, নাগরিক স্বাধীনতা সীমিত করা হয়েছিল এবং এক-দলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে গণ-আন্দোলনের মূল চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তন পরবর্তী সেনা অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান ও ক্ষমতার শূন্যতা জাতীয় পরিসরে এক ভয়াবহ বাস্তবতার জন্ম দেয়। ঠিক এই সময়ে দেশের সর্বক্ষেত্রে, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় দিক থেকে, জাতীয় সার্বভৌমত্বের অস্তিত্বই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়।

এমনই এক চরম অনিশ্চিত প্রেক্ষাপটে ৭ নভেম্বর ভোরে শুরু হয় ইতিহাসের সেই অবিস্মরণীয় বিপ্লব। দেশের সাধারণ সৈনিক এবং জনগণ “দেশ রক্ষার” অদম্য সংকল্প নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। তারা বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেন জিয়াউর রহমানকে—যিনি ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনাপতি এবং সৈনিকদের আস্থার প্রতীক। সেদিনের আন্দোলন নিছক কোনো সামরিক অভ্যুত্থান ছিল না—এটি ছিল একটি জাতীয় আত্মরক্ষার সূচনা। সৈনিক ও জনগণের ঐক্য, যা “সিপাহী-জনতার সংহতি” নামে পরিচিত, এই বিপ্লবকে এক অনন্য গণ-আন্দোলনের রূপ দিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে, বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন: “November 7 is an unforgettable historic day in the national life of our country. On this day in 1975, motivated by patriotism, the military and the people took to the streets with an unprecedented commitment to safeguard national independence and restore lost democracy.” (bnpbd.org) তিনি আরও উল্লেখ করেছেন: “As long as the forces in support of Bangladesh remain united, no one can threaten the country’s independence.” এই উক্তিগুলো স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে—৭ নভেম্বরের বিপ্লব কেবলই ইতিহাস নয়, এটি আজও জাতীয় চেতনার উৎস হিসেবে বিবেচিত।

বিপ্লব এবং গণ-আন্দোলনের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে আমরা বিভিন্ন ভাবনার প্রতিফলন দেখতে পাই। যেমন—মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র (Martin Luther King Jr.) বলেছেন: “Power at its best is love implementing the demands of justice. Justice at its best is love correcting everything that stands against love.” এই উক্তিটি বোঝায় যে ক্ষমতা শুধু বলপ্রয়োগ নয়, যা মানুষের অধিকার রক্ষা করে এবং জনগণের স্বার্থে কাজ করে। ৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার ঐক্য এই ধারণাকেই মূর্ত করেছিল। অন্যদিকে, মার্গারেট মীড (Margaret Mead) বলেছেন: “Never doubt that a small group of thoughtful, committed citizens can change the world. Indeed, it is the only thing that ever has.” এই উদ্ধৃতিটি দেখায় যে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও জনগণের একাগ্রতা ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরিবর্তন সম্ভব। ৭ নভেম্বরের ঘটনাই এই ভাবনাকে বাস্তব দৃশ্যে পরিণত করেছিল। অর্থাৎ, এই বিপ্লব শুধু সেনা-রাজনৈতিক ঘটনার নাম নয়—এটি জন-শক্তির, ঐক্যের, ও সার্বভৌম অধিকারের পুনর্জাগরণের নাম।

বিপ্লবের পর জিয়াউর রহমান ধীরে ধীরে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত করার পাশাপাশি উন্নয়নমূলক রাজনীতির চেতনা প্রবর্তন করেন। সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা ওঠে, বহুদলীয় রাজনীতি ফিরে আসে এবং জনগণ কথা বলার অধিকার ফিরে পায়। অর্থনীতিতে আত্মনির্ভরতা, কৃষির উন্নয়ন ও রপ্তানি-উদ্যোগ তাঁর হাত ধরে এগিয়ে আসে। তিনি বিশ্বাস করতেন—‘উন্নয়ন মানে মানুষের ক্ষমতায়ন’ কারণ ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রামীণ উন্নয়ন, বৈদেশিক কর্মসংস্থান, নারী ক্ষমতায়ন ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সক্রিয় করার মতো যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেওয়া হয়। জিয়াউর রহমান শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয়—আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের মর্যাদা উজ্জ্বল করে তুলেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে দেশ মধ্যস্থতার ভূমিকায় আসে, আঞ্চলিক সংহতি গঠনে উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করে একটি স্বাধীন ও মর্যাদাবান রাষ্ট্র হিসেবে। এ প্রসঙ্গে, রাজনৈতিক বিবেকচেতনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়: “The primal principle of democracy is the worth and dignity of the individual.” (Edward Bellamy) এই স্তরে বোঝা যায়—জাতীয় সার্বভৌমত্ব শুধু সামরিক দখল নয়, এটি মানুষের মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।

যোগ্য নেতাকে ইতিহাস কখনও ভুলে রাখে না। তবে ইতিহাসের লেখক ও স্মৃতিচিহ্ন কখনও কখনও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরিবর্তিত হয়। তারেক রহমান একবার উল্লেখ করেছেন: “...the defeated group of November 7, 1975 is again illegally clinging to the power of the new BAKSHAL government. The country’s sovereignty is constantly being weakened... Democracy and people’s freedom of speech are exiled today।” (bnpbd.org) এই মন্তব্য দেখায়—৭ নভেম্বরের চেতনা শুধু অতীতের ঘটনা নয়, আজও তা রাজনৈতিক বিবাদের কেন্দ্রবিন্দু। আজ, যখন বাংলাদেশ আবারও রাজনৈতিক বিভাজন, মতপ্রকাশের সংকট ও গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি, তখন ৭ নভেম্বরের চেতনা নতুন করে আহ্বান জানায়। “It is very important to unite all nationalist forces in the spirit of November 7 to ensure the progress of democracy and protect the independence and sovereignty of the country.” তারেক রহমানের এই আহ্বান নিছক রাজনৈতিক নয়—এটি ইতিহাসের ধারাবাহিকতা পুনরুদ্ধার করার একটি সামাজিক ও সাংগঠনিক নির্দেশ।

জিয়াউর রহমানের জীবন ও মৃত্যু বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মহাকাব্য। ১৯৭১-এ স্বাধীনতার ঘোষক, ১৯৭৫-এ বিপ্লবের নেতা এবং ১৯৮১-এ শহীদ রাষ্ট্রনায়ক—এই তিন পর্বে তিনি প্রমাণ করেছেন, সত্যিকারের নেতা কেবল রাজনৈতিক প্রতিভাধর নয়, জনগণের হৃদয়েরও অধিনায়ক। “People are the source of power. Those who will be elected by the people will rule the government,”—জিয়াউর রহমানের এই কথা গণতান্ত্রিক সরকারের মৌলিক নীতিকে স্পষ্ট করে। ১৫ আগস্টের পরবর্তী বিশৃঙ্খলায় তাঁর ভূমিকা সেই মানুষের শক্তিকে রাজনৈতিক দৃশ্যে আরও ব্যাপকতা দিয়েছিল। ৭ নভেম্বর কেবল অতীতের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নয়; এটি আমাদের জাতীয় আত্মপরিচয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই দিনটি প্রমাণ করেছে—বাংলাদেশের মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে, বিদেশি প্রভাবের বিরুদ্ধে ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে জানে। আসলে ৭ নভেম্বর আমাদের শেখায়, নেতৃত্ব মানে ত্যাগ; স্বাধীনতা মানে দায়িত্ব; আর সার্বভৌমত্ব মানে আত্ম-মর্যাদা।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে সামনে রেখে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বারবার ৭ নভেম্বরের চেতনায় এবং বিএনপি’র প্রাণ জিয়াউর রহমানের আদর্শে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। ৭ নভেম্বর মানে ঐক্য, ৭ নভেম্বর মানে সার্বভৌম দেশের জয়গান।  এই দিনে আমাদের প্রত্যয় হোক—বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও মানুষের মর্যাদা যেন চিরদিন অক্ষুণ্ন থাকে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন প্রজন্ম যেন ইতিহাসের এই মহিমান্বিত দিনটির প্রকৃত তাৎপর্য হৃদয়ে ধারণ করে।

লেখক: সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়