মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়
স্কুল রং করতে শ্রমিকের পেছনে ব্যয় এক কোটি ৩০ লাখ
- মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে ব্যাপক অনিয়ম
- দুই মাসে উন্নয়নের নামে সাড়ে ৪ কোটি টাকা ব্যয়
- শিহাব উদ্দিন
- ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ১০:২৮
রাজধানীর মিরপুরের মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে রঙের কাজে শ্রমিক ভাতা ও মজুরি হিসেবে এক কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন ‘উন্নয়ন’ খাতে খরচ করা হয়েছে দুই মাসে সাড়ে ৪ কোটি টাকার বেশি। কোনো প্রকার দরপত্র আহবান ছাড়াই এসব ব্যয় করা হয়েছে। মানা হয়নি সরকারি ক্রয়বিধিও (পিপিআর)। সম্প্রতি পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্ত প্রতিবেদনে এসব অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। শিক্ষক নিয়োগ-প্রক্রিয়াতেও অনিয়ম হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ২০ ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকার বেশি উন্নয়ন ব্যয় দেখানো হয়। তবে এসব কাজের কোনো দরপত্র আহবান করা হয়নি এবং কাজের অনুমোদনও পাওয়া যায়নি। ব্যয়ের মধ্যে শুধু রঙের কাজে শ্রমিকের পেছনে এক কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. আখলাক আহম্মদের নেতৃত্বে অনুমোদনহীন কমিটি উন্নয়ন উপকমিটির বৈঠক করে ৫ কোটি ৭১ লাখ টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেয়। পরে তার মধ্যে ৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকার কাজ সম্পন্ন দেখানো হয়। কিন্তু সরকারি ক্রয়বিধি অনুযায়ী দরপত্র আহবান না করে ‘মেসার্স শিলা এন্টারপ্রাইজ’, ‘তানভীর এন্টারপ্রাইজ’, ‘বান্না এন্টারপ্রাইজ’ ও ‘মেসার্স মোল্লা ওয়েল্ড’ নামের চার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ করানো হয়।
‘ডিআইএর প্রতিবেদন হাতে এসেছে। প্রতিবেদনটি আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’— প্রফেসর বি এম আব্দুল হান্নান, মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের
তদন্তে উপস্থাপিত ব্যয়ের স্বতঃস্ফূর্ত তালিকায় দেখা যায়—রাজমিস্ত্রি, কাঠ ও স্যানিটারি (লেবার) কাজে খরচ দেখানো হয়েছে ৬১ লাখ ২০ হাজার ৪৬০ টাকা। রং কাজের (লেবার) খাতে ব্যয় দেখানো হয়েছে এক কোটি ৩০ লাখ ৯২ হাজার ৯৭৭ টাকা। টাইলস, মোজাইক ও ইলেকট্রিক কাজে ৫০ লাখ ৯৯ হাজার ৮৯৮ টাকা; গ্রীল ও অন্যান্য কাজে ১২ লাখ ৪৮ হাজার ১৪৩ টাকা এবং সরাসরি নগদে মালামাল ক্রয়ের খাতে এক কোটি ২৩ লাখ ৭৪ হাজার ৪৩৭ টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
এসব কাজের জন্য পত্রিকায় দরপত্র বা প্রয়োজনীয় টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়েছে। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে কেবল উপকমিটির মাধ্যমে এই ধরনের বড় অঙ্কের ব্যয় প্রশাসনিক ও আর্থিক অনিয়ম হয়েছে বলে জানিয়েছে ডিআইএ।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যয়ের মধ্যে ৩ কোটি ১২ লাখ ১৮ হাজার টাকা ইতিমধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে; কিন্তু পরিশোধকৃত টাকার রাজস্ব খাতের ভ্যাট এবং আয়কর স্ট্যাম্প বা জমা করা হয়নি। পরিশোধিত টাকার ওপর ভ্যাট বাবদ ২৩ লাখ ৪১ হাজার ৩৫০ টাকা এবং আয়কর বাবদ ১৫ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরতযোগ্য। এছাড়া মোট ব্যয়ের মধ্যে অপরিশোধিত এক কোটি ৫৩ লাখ ৯০ হাজার ৪৯১ টাকা রয়েছে—যা পরিশোধের সময় ভ্যাট ও আয়কর পরিশোধ করতে হবে বলে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তদন্তে আরও উঠে এসেছে—প্রতিষ্ঠানটিতে নিয়মিত গভর্নিং বডির অভাব দীর্ঘ সময় ধরে বিরাজ করছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত নিয়মিত গভর্নিং বডির মেয়াদ ২০২০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর শেষ হলেও এরপর থেকে কোনো নিয়মিত বডি গঠন করা হয়নি; ফলে বারবার এডহক কমিটির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে।
‘ঘটনাটি আমার সময়ের না। এলজিইডির এক কর্মকর্তা যখন এডহক কমিটির সভাপতি ছিলেন, তখন এসব অনিয়ম হয়েছে। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।’—অধ্যাপক তাহমিনা আক্তার, সভাপতি অ্যাডহক কমিটি, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ
শিক্ষক নিয়োগ-প্রক্রিয়াতেও অনিয়ম হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর এডহক কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০২৫ সালের ৮ জানুয়ারি লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে ৯ জনকে শিফট ইনচার্জ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে শিফট ইনচার্জ নিয়োগের ক্ষেত্রে এমন লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার কোনো বিধান নেই—এটি ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্নিং বডি প্রবিধানমালা, ২০২৪-এর লঙ্ঘন।
ডিআইএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের নির্দেশ অমান্য করে পূর্ববর্তী কমিটির মাধ্যমে কোটি টাকার উন্নয়নের নামে কাজ করানো, টেন্ডারবিহীন ক্রয়, ভ্যাট–আয়কর জমা না করা ও শিক্ষক-কর্মচারীদের হয়রানি—এসব অভিযোগ প্রমাণিত। রাজস্ব খাতের বকেয়া ভ্যাট ও আয়কর দ্রুত সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে এবং এসব অনিয়মের সাথে জড়িত প্রধান শিক্ষকসহ দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রফেসর বি এম আব্দুল হান্নান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ডিআইএর প্রতিবেদন হাতে এসেছে। প্রতিবেদনটি আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নতুন অ্যাডহক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক তাহমিনা আক্তার দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ঘটনাটি আমার সময়ের না। এলজিইডির এক কর্মকর্তা যখন এডহক কমিটির সভাপতি ছিলেন, তখন এসব অনিয়ম হয়েছে। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।’
এসব অনিয়মের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. আখলাক আহম্মদের বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।