সোনালী অনুপাত একটি স্বর্গীয় সংখ্যা
- ০২ নভেম্বর ২০২৫, ২০:১১
গণিত শুধু সংখ্যা বা সূত্রের সমষ্টি নয়, বরং একটি ভাষা বিভিন্নভাবে যার প্রয়োগ প্রকৃতিকে আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর রূপে সজ্জিত করে তুলেছে। আর প্রাকৃতিক এই সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে চলেছে গাণিতিক একটি বিশেষ সংখ্যা—‘সোনালী অনুপাত’। সোনালী অনুপাত একটি আনুপাতিক সংখ্যা যাকে ‘সোনালী সংখ্যা’ অথবা ‘স্বর্গীয় সংখ্যা’ও বলা হয়ে থাকে। সংখ্যাটির পরিমাণ প্রায় ১.৬১৮০৩৩৯৮৮৭, যা সাধারণত গ্রিক বর্ণ ‘ফাই (φ)’ দিয়ে প্রকাশ করা হয়। দুইটি পুর্ণসংখ্যাকে ভাগ করে এই সংখ্যাটি পাওয়া যায় না (অমূলদ সংখ্যা) এবং এর দশমিকও বিরতিহীন। সংখ্যাটি ফিবোনাচ্চি ক্রমের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। ফিবোনাচ্চি ক্রম এমন কতকগুলো সংখ্যার ক্রম, যেখানে শূন্য ও এক থেকে শুরু হয়ে প্রত্যেকটি সংখ্যাই পূর্ববর্তী দুটি সংখ্যার সমষ্টি।
গাণিতিকভাবে, সোনালী অনুপাতকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়- একটি রেখাকে বড় ও ছোট দুটি অংশে বিভক্ত করলে রেখাটির সম্পূর্ণ দৈর্ঘ্যের সাথে বড় অংশটির দৈর্ঘ্যের অনুপাত, বড় অংশটির সাথে ছোট অংশটির দৈর্ঘ্যের অনুপাতের সমান হয়। আবার, একটি বৃত্তের ৩৬০ ডিগ্রিকে ১৩৭.৫ এবং ২২২.৫ অংশে ভাগ করা হলে বড় ও ছোট অংশের অনুপাত সোনালী অনুপাতের সমান হয়। এক্ষেত্রে ১৩৭.৫০-কে ‘সোনালী কোণ’ বলা হয়। তেমনি একটি ‘সোনালী আয়তক্ষেত্র’ পাওয়া যায় যদি এটির প্রস্থ ১ ও দৈর্ঘ্য ১.৬১৮ হয়, অঙ্কে প্রকাশ করলে যা দাঁড়ায়, দৈর্ঘ্য/প্রস্থ = (দৈর্ঘ্য + প্রস্থ)/ দৈর্ঘ্য। ‘সোনালী আয়তক্ষেত্র’-এর একটি বৈশিষ্ট্য হলো এটির কোন একটি ধার থেকে বর্গাকার একটি অংশ কেটে নেয়া হলে বাকী অংশটিও একটি ‘সোনালী আয়তক্ষেত্র হবে এবং অনুপাতও হবে আগেরটির মতই। এই প্রক্রিয়াটি অসীম পর্যন্ত চালিয়ে গেলে বর্গক্ষেত্র সংশ্লিষ্ট কোণগুলো ‘স্বর্ণালী সর্পিল’ আকৃতির ওপর বিন্দুর একটি অসীম ক্রম তৈরি করবে।
সোনালী অনুপাতের সাথে প্রকৃতির নান্দনিক সৌন্দর্যের অদ্ভুত সম্পৃক্ততা, দৃশ্যমান সাদৃশ্যতাগুলো পরিস্ফুরণ করে তোলার ক্ষমতা ও সর্বব্যাপিতা যুগ যুগ ধরে সংখ্যাটির ব্যাপারে বড় বড় গণিতজ্ঞ, শিল্পী, সজ্ঞীতজ্ঞ, ঐতিহাসিক ও স্থপতিদের ভাবিত, মুগ্ধ ও সেইসাথে আগ্রহী করে তুলেছে। বিশ্ব বিখ্যাত গণিতজ্ঞ প্রাচীন গ্রিসের পিথাগোরাস এবং ইউক্লাড, ইতালির মধ্যযুগীয় গণিতজ্ঞ লিওনার্দো এবং রেনেসাঁস যুগের বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ জোহানস্ কাপলার থেকে শুরু করে বর্তমান সময়কার অক্সফোর্ডস্থ বিখ্যাত পদার্থবিদ রোজার পিনরোজ এই সংখ্যাটি ও এর বৈশিষ্ট্যসমূহ নিয়ে প্রচুর চিন্তা, গবেষণা ও অনুসন্ধান চালিয়েছেন। বলা যায় গণিতের ইতিহাসে এমন আর কোন সংখ্যা নেই যা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে বিশেষজ্ঞদের এত কৌতূহলী করে তুলতে পেরেছে।
নিজস্ব নক্শা প্রণয়নের মাধ্যমে কোণ বিষয়বস্তুকে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সঠিক অনুপাতে সুবিন্যস্ত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে বলে সংখ্যাটিকে শিল্প, স্থাপত্য, সৌন্দর্য ও সৃজনশীল কাজের ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য ও অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। সৃষ্টিজগতের অতি ক্ষুদ্র থেকে আরম্ভ করে মহাজাগতিক অতি বৃহদাকার বস্তু পর্যন্ত এটির ব্যবহার সর্বব্যাপী।
বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা যায় সর্পিল আকৃতির ক্ষেত্রগুলো সোনালী অনুপাতের ভিত্তিতে একটি সুনির্দিষ্ট গাণিতিক নকশা মেনে চলে। তাই মহাজাগতিক ও প্রাকৃতিক অনেক বস্তুর গাঠনিক ও কার্যপ্রক্রিয়ার মধ্যেই এর প্রয়োগ দেখা যায়। মহাকাশের গ্যালাক্সিগুলোর সর্পিল আকৃতি, সৌর জগতে গ্রহগুলোর বিন্যস্ততা, বস্তুর মৌলিক উপাদান, পরমাণুর মধ্যস্থ কিছু প্রক্রিয়া, ধ্বংসাত্মক হারিকেনের মধ্যস্থ ঘূর্ণিঝড়, সাগর সৈকতে আঁচড়ে পড়া ঢেউ, ধূমকেতুর গুচ্ছ-লেজে, ঘূর্ণায়মান ¯স্রোতের পাকে পর্যন্ত সংখ্যাটির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদের গাঠনিক রূপ প্রদানের ক্ষেত্রেও সংখ্যাটির গুরুত্ব দেখা যায়। বৃক্ষরাজির পত্র-পল্লবের বিন্যাস্ততার ক্ষেত্রে সংখ্যাটির প্রয়োগ স্থান ও সূর্যের আলোর সর্বোত্তম ব্যবহার অনেকটা নিশ্চিত করে। সূর্যমুখী, ডেইজি ইত্যাদি ফুলের বীজ বিন্যাসে সংখ্যাটির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। সূর্যমুখী ফুলের বীজগুলো দুটি পরস্পর বিপরীতমুখী কুন্ডলিকৃত সারিতে বিন্যস্ত থাকে। এই সারিগুলো বিপরীত দিক থেকে গণনা করা হলে দেখা যায় এদের সংখ্যার অনুপাত ছোট ফুল হলে ৩৪ এবং ৫৫, মাঝারি আকৃতির ফুলে ৫৫ এবং ৮৯ এবং বড় আকৃতির ক্ষেত্রে ৮৯ এবং ১৪৪। পাইনগাছের ডিম্বাকৃতির ফলের প্যাঁচানো আকৃতির সারিগুলোর মধ্যেও এই অনুপাতটি দেখা যায়।
অনেকের মতে সংখ্যাটির সহজাত একটি দক্ষতা বা স্থায়িত্ব বৃদ্ধির ক্ষমতা আছে, যা এটিকে প্রাকৃতিক কোণ বৃদ্ধি প্রক্রিয়া বা স্ব-অনুলিপি তৈরি প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও অধিক গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। আর তাই জীবন পরিকল্পনার প্রতিচিত্র বা নীল নকশা ‘ডিএনএ’ তেল সংখ্যাটির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ‘ডিএনএ।’- এর গাঠনিক কাঠামো ডাবল হলেক্সি বা প্যাঁচানো সিঁড়ির মতো অংশটির দৈর্ঘ্য ৩৪ অ্যাংস্ট্রম (১ অ্যাংস্ট্রম = ০.১ ন্যানোমিটার) এবং প্রস্থ বা ব্যাস ২১ অ্যাংস্ট্রম যার অনুপাত প্রায় সোনালী অনুপাতেরই কাছাকাছি।
মানুষের শারীরিক গঠনের সাথে এই সংখ্যাটির সম্পৃক্ততা থেকেও প্রকৃতির মধ্যে অঙ্কের নিয়ম মেনে চলার প্রবণতার প্রকাশ ঘটে। মানুষের মুখের বিভিন্ন অংশের অনুপাত যখন এই সংখ্যার কাছাকাছি হয় তখন তার সৌন্দর্য তত বেশী ফুটে ওঠে বলে ধারণা করা হয়। একজন মানুষের শরীরের দৈর্ঘ্যের সাথে তার বাহুর দৈর্ঘ্যের অনুপাত, শরীরের দৈর্ঘ্যের সাথে নাভি থেকে পদতল পর্যন্ত দৈর্ঘ্যের অনুপাত, নাকের সাথে মুখের প্রস্থতার অনুপাত, নাকের সাপেক্ষে চোখের দূরেেত্বর অনুপাত, শ্রবণশক্তি সম্পর্কীয় কানের ভেতরন্থ ‘কাক্লীঅ’ নামক সর্পিল আকৃতির গহŸর, বাহু ও হাতের অনুপাত, কাঁধ থেকে কনুই-এর দূরত্ব আর কনুই থেকে কবজির দূরত্বের অনুপাত, এমনকি হাতের আঙুলের হাড়গুলোর দৈর্ঘ্যের অনুপাতও অনেক ক্ষেত্রে সোনালী সংখ্যার কাছাকাছি হতে দেখা যায়।
মানুষ ছাড়া অন্যান্য জীব-জন্তুর মধ্যেও ‘সোনালী অনুপাত’-এর উপস্থিতি দেখা যায়। ঝিনুকের সর্পিল আকৃতির খোলসে, সি-হর্সের (ঘোড়ার মুখবিশিষ্ট ছোট এক ধরনের সামুদ্রিক মাছ) কুণ্ডলী আকৃতিবিশিষ্ট লেজে, কোন কোন মাকড়সার জালের বুননে, ডলফিনের ডানা এবং লেজের পুরুত্বের সাথে শরীরের দৈর্ঘ্যের অনুপাতে, প্রজাপতির ডানা, বিশেষ করে সর্পিল আকৃতির শুঁড়ে, ‘স্টার ফিসের’ পঞ্চভূজাকৃতির মধ্যে, পেঙ্গুইনের শরীরের অনুপাতে, এমনকি বাঘের মুখের আকৃতির সাথেও সংখ্যাটির সম্পর্ক দেখ যায়।
সংখ্যাটি অন্য যে কোনো অনুপাতের তুলনায় শৈল্পিকভাবে অনেক বেশি আকর্ষণীয় ও প্রশান্তিদায়ক হওয়ায় প্রাচীন গ্রিক ও মিসরের স্থপতিদের শিল্পকর্মে, এমনকি বিশ^বিখ্যাত শিল্পী লিওনারডো দা ভিঞ্চি, ভ্যান গফ, ভারমিয়ারসহ অনেক শিল্পীর শিল্পকর্মে সংখ্যাটির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মিশরের পিরামিড, গ্রীসের বিখ্যাত প্রাচীন উপাসনালয় ‘পারথেনন’-এ, আগ্রার তাজমহলসহ প্রাচীন অনেক শিল্পকর্ম, দরজা-জানালার নকশায় এবং বিভিন্ন ভাস্কর্যেও এর ব্যবহার দেখা গেছে। নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘের সুবিস্তৃত ভবনটির নকশাতেও এই সংখ্যাটি ব্যবহার করা হয়েছে।
আধুনিক বিশ্বের বিভিন্ন শিল্পকর্মে ও দৈনন্দিন ব্যবহার্য অনেক দ্রব্য-সামগ্রীর নকশায় সোনালী অনুপাত ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যায়। ক্রেডিট কার্ড, পোস্ট কার্ড, তাস, রাইটিং প্যাড, লাইটের সুইচ বোর্ড ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রে সোনালী আয়তক্ষেত্রের ব্যবহার হয়ে আসছে। ইদানীং গ্রাফিক ডিজাইনাররা ডিজিটাল মিডিয়াতে তাদের সৃষ্টিকে আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন করে তুলতে এই অনুপাতটি ব্যবহারের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
সংগীতবিষয়ক অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি বিশ্বাস করেন যে গানের ভাব, সুর, তাল, লয়ের মধ্যকার সময়গুলোর মধ্যে যদি স্বর্ণালী অনুপাতকে সম্পৃক্ত করা যায় তবে তা অত্যন্ত শ্রুতিমধুর হয়ে ওঠে। বিথোভেন, বারটক, গারল্যান্ডের মদো বিশ্ববিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞরা গান রচনার ক্ষেত্রে স্বর্ণালী অনুপাতকে গুরুত্ব দিয়েছেন বলে জানা যায়।
যদিও প্রকৃতিতে সোনালী অনুপাতের ব্যাপক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয় তবে কোন কোন ক্ষেত্রে সংখ্যাটির অনুপাতে কিছুটা পরিবর্তন ঘটিয়েও সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা বৃদ্ধির প্রবণতাও দেখা যায়।
লেখক: পরমাণু বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, সিএসসি ডিপার্টমেন্ট, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি