বিষধর সাপে কাটা ছাত্রীকে ডাক্তারের উল্টো প্রশ্ন ‘জঙ্গলে কেন গেছিলি?’, ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে রক্ষা
- ০১ নভেম্বর ২০২৫, ২১:২৫
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) সাপে কাটার পর এক ছাত্রী মেডিকেল সেন্টারে দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ভুক্তভোগী ছাত্রীকে বিষধর সাপে কাটার ওষুধ হিসেবে দেওয়া হয়েছে নাপা আর স্যালাইন। এ ছাড়া ভুক্তভোগী ছাত্রীকে পরোক্ষভাবে স্লাটশেমিং করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করছেন তারা।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী মৌমিতা দাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে অধ্যয়নরত। শুক্রবার (১ নভেম্বর) বিকেল ৪টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাপের দংশনের শিকার হন তিনি। বর্তমানে মৌমিতা ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। অপরদিকে অভিযুক্ত চিকিৎসক নিংটম সিংহ দৈনিক ভিত্তিতে মেডিকেল সেন্টারে কর্মরত।
মৌমিতা দাশের সহপাঠী এবং পরিবেশ ও প্রাণী অধিকারকর্মী সৈয়দা অনন্যা ফারিয়া দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, শুক্রবার বিকেল ৪টার দিকে সাপে কামড় দেয় মৌমিতাকে। কিন্তু তিনি বিষয়টি বুঝতে পারেননি। পরে সন্ধ্যা ৭-৮টার দিকে মাথা ব্যথা শুরু হলে মেডিকেল সেন্টারে যান। এ সময় দুর্ব্যবহারের শিকার হন তিনি। পরে তাকে ঢামেকে নেওয়া হয়। তাকে বিষধর সাপে কেটেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। অ্যান্টিভেনম দেওয়ার পর কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের চিকিৎসক নিংটম সিংহের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে অনন্যা ফারিয়া বলেন, ‘তিনি বিষধর সাপে কাটা রোগীকে নাপা এবং স্যালাইন দিয়েছেন। একই সাথে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করেছেন, তোর ফ্রেন্ডরা আসে নাই? আর জঙ্গলে কেন গেছিলি?’
তিনি বলেন, ‘যেখানে জীবন-মরণের প্রশ্ন, সেখানে নূন্যতম ব্লাড টেস্টটাও করা হয়নি। ডাক্তারের মনে হয়েছে এটা জোঁকের কামড়, তাই তিনি বলেছেন, কিছু হবে না, মন চাইলে এনামে (সাভারের বেসরকারি এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) যেতে পার। অথচ রক্ত পরীক্ষায় বিষ ধরা পড়লে এক ডোজ অ্যান্টিভেনম দিয়ে ক্যাম্পাসের অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে রওনা করিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। এই দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য জবাবদিহিতা পাব কিনা? মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে সে দায়িত্ব কে নিত? আর এই ইনডিরেক্ট স্লাটশেমিং, তুই-তোকারির সাহস কে দিয়েছে ডাক্তারকে?’
সৈয়দা অনন্যা ফারিয়া বলেন, ‘দেশে প্রাথমিক ব্লাড ক্লটিং টেস্টের মাধ্যমে রক্তে বিষ আছে কিনা শনাক্ত করা হয়। যদিও এটি শতভাগ কার্যকরী না, তবে নিউরোটক্সিনের ক্ষেত্রে কার্যকর। দেশে এটাই বহুল প্রচলিত সহজ একটি টেস্ট। ৫-৭ মিলিলিটার রক্ত নিয়ে টেস্টটিউবে রাখা হয় ২০ মিনিট। যদি জমাট বাঁধে, ধরে নেওয়া হয় বিষ নেই। যদি জমাট না বাঁধে তাহলে ধরে নেওয়া হয় বিষ আছে। রক্ত জমাট না বাঁধলেও ২৪ ঘন্টা অবজারভেশনে রাখা হয়। শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার স্বার্থে আমাদের মেডিকেল সেন্টারে ন্যূনতম এই টেস্টের সিস্টেম থাকা জরুরি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. শামসুর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমাদের অ্যান্টি-স্নেক ভেনম নাই। আর অ্যান্টি-স্নেক ভেনমের নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে, কার্ডিওলজিসহ আরও নানান জটিল ফ্যাসিলিটিজের প্রয়োজন হতে পারে। ফলে যেখান-সেখানে এটা রাখা হয় না। এজন্য রোগীকে যত দ্রুত হসপিটালাইজ করা যায়, সেটাই আমরা কনফার্ম করি। আমি জেনেছি, রোগীকে রেফার করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বিষধর সাপের ক্ষেত্রে ১০ মিনিটের মধ্যেই প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। ফলে এমন রোগীকে দ্রুত পেইন-কিলার (ব্যথানাশক) বা সিম্পটমিক ট্রিটমেন্ট (উপসর্গ দেখে চিকিৎসা) দিয়ে সাথে সাথে অ্যান্টিভেনম ফ্যাসিলিটিজ থাকা হাসপাতালে রেফার করা হয়। জোঁকের কামড় হোক বা যা-ই হোক। যদি সন্দেহভাজন কেইস হয়, তাহলে রেফার করে দিতে হবে। মুশকিল হল, বিভিন্ন রোগেই এই ব্যাথানাশক ওষুধগুলো দেই আমরা, এটা নিয়ম। কিন্তু সবাই ওই প্যারাসিট্যামলের নাম শুনলেই অন্য কিছু মনে করে। কিন্তু এটা তো আসল ট্রিটমেন্ট না, এটা কমপ্লেইনের ভিত্তিতে দেওয়া।’
তুই-তোকারি এবং স্ল্যাটশেমিংয়ের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ওই চিকিৎসক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্য। এখানে ভাষাগত কোনো জটিলতা হয়েছে কিনা আমরা ভাবছি। যদিও আমরা জিজ্ঞাসা করলে তিনি অস্বীকার করেছেন।’
জানতে চাইলে অভিযুক্ত চিকিৎসক ডা. নিংটম সিংহ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘মেয়েটির হাতে ফ্যাং মার্ক (ছিদ্র বা দাগের রেখা) ছিল। সাধারণত পেশেন্ট এসেই ক্লেইম করে যে কিসে কেটেছে। ও বলেছে, হাতে আগে জোঁকে কামড় দিয়েছিল, ওই রকমই দাগ। আমি বলেছিলাম যে এটা তো ফ্যাং মার্ক, বিষধর কিছু হতে পারে-নাও হতে পারে। সে কিছু বলতে পারেনি। আর কামড়ের তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা পর আসায় আমার কাছে চিহ্ন বিষধর মনে হয়নি। বিষধর কিছুর কামড়ে আরও দ্রুত প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। ও আবার বলছিল যে, ওর একটু মাথা ব্যথা ছিল। মাথা ব্যথা, তন্দ্রাভাব অনেক সময় এনজাইটি থেকেও হয়। ফলে আমি বলেছিলাম, যদি বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা বা এরকম কোনো সাইন আসে, সাথে সাথে এনামে যাবা। প্রয়োজনে আমাদের ফোন দিবা। আমরা কথা বলব।’
তিনি বলেন, ‘আমি প্যারাসিটামল দিয়েছিলাম, আর বলেছিলাম যেন রেস্টে থাকে। তারপরও যদি সমস্যা তৈরি হয়, তাহলে যেন এনামে যায়, সেটি বলেছিলাম। ভেনোমাস সাইন থাকলে ওই মুহূর্তেই রেফার করতাম। এনামে বলেছিলাম, কারণ সেটা (বিষের চিহ্ন) ছিল না। তারপরেও যদি সমস্যা হয়, তাহলে যেন দ্রুত ওখানে গিয়ে প্রাথমিক ট্রিটমেন্ট নিতে পারে।’
স্লাটশেমিং এবং দুর্ব্যবহারের অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার সাথে তো আসলে ওই রকম কোন ধরনের কথা হয়নি। আমি অপরিচিত কাউকে তুই-তোকারি করার কথা না। আর রোগী ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট। আমার সাথে যদি ওরকম কিছু হত, আনফেয়ার লাগলে তো ডিরেক্টলি রাফ বিহেভ করতে পারত। আমি ২০২২ সাল থেকে এখানে চাকরি করি, আগেও কখনও এ ধরনের অভিযোগ আসেনি আমার নামে। আর অ্যাম্বুলেন্স না পেলেও শিক্ষার্থীরা আমাদের চার্জ করে। সেখানে এত বড় ইস্যু, আমাকে কিছুই বলে গেল না।