মাহালি ভয়েসেস

রাজশাহী অঞ্চলের বিপন্ন মাহালি ভাষা সংরক্ষণে আইইউবির উদ্যোগ

আইইউবি ক্যাম্পাসে মাহালি ভয়েসেস বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়
আইইউবি ক্যাম্পাসে মাহালি ভয়েসেস বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হয় © সংগৃহীত

রাজশাহীর বিপন্ন মাহালি জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণে উদ্যোগ নিয়েছে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ (আইইউবি)। বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রকাশ করেছে গবেষণাভিত্তিক গ্রন্থ ‘মাহালি ভয়েসেস’, যেখানে সংরক্ষিত হয়েছে মাহালি ভাষায় লেখা লোককাহিনি ও কবিতা। বুধবার (২৯ অক্টোবর) আইইউবি ক্যাম্পাসে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়।

বইটি যৌথভাবে প্রকাশ করেছে আইইউবি ও অ্যাডর্ন পাবলিকেশন। এর রচয়িতা আইইউবির ইংলিশ অ্যান্ড মডার্ন ল্যাংগুয়েজেস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদ বিন মুজাফফর, লেখক ও গবেষক হারুনুজ্জামান এবং মাহালে সম্প্রদায়ের সদস্য সন্তোষ হেমরম। 

মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আইইউবির সাশিন সেন্টার ফর মাল্টিলিংগুয়াল এক্সেলেন্স (এসসিএমএলই) এবং ডিপার্টমেন্ট অব ইংলিশ অ্যান্ড মডার্ন ল্যাংগুয়েজেস।

বাংলাদেশের বিপন্ন ও বিলুপ্তপ্রায় ভাষা নথিবদ্ধ ও সংরক্ষণে কাজ করে ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠিত এসসিএমএলই। মাহালি ভয়েসেস গ্রন্থে মাহালি ভাষা, বাংলা ও ইংরেজি– এই তিন ভাষায় সংকলিত হয়েছে মাহালি সম্প্রদায়ের ২৬টি লোককাহিনি এবং ২৪টি কবিতা। মাহালি ভাষার নিজস্ব কোনো বর্ণমালা না থাকায় গবেষকরা রোমান হরফে ভাষাটি লিপিবদ্ধ করেছেন। গবেষণা, সংকলন ও অনুবাদের কাজে সময় লেগেছে তিন বছরের বেশি।

তৌহিদ বিন মুজাফফর বলেন, ‘মাহালি জনগোষ্ঠীর মানুষ নিজেদের ভাষায় যে গল্প-কবিতা বলে, সেগুলোকেই আমরা তুলে আনতে চেয়েছি। বাইরের কারও ব্যাখ্যা নয়, বরং তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির ভাষাই এখানে স্থান পেয়েছে। এভাবে নথিবদ্ধ হওয়ায় মাহালি ভাষার সাহিত্য এখন শুধু বাংলাদেশের পাঠকের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছেও পৌঁছে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হলো।’

ইউনেসকোর ২০০৩ সালের ল্যাংগুয়েজ ভাইটালিটি অ্যান্ড এনডেঞ্জারমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক বলছে, ঘরোয়া বা পারিবারিক পরিসরে কোনো ভাষার ব্যবহার কমে গেলে তা আর পরের প্রজন্মের কাছে পৌঁছায় না। তখনই ভাষাটি বিপন্ন হওয়া শুরু করে। শিক্ষা, চাকরি ও সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সুবিধা পেতে অনেক পরিবার ধীরে ধীরে বেশি প্রচলিত ভাষা বেছে নেয়; আর সেখান থেকেই নিজস্ব ভাষা হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়। 

সহরচয়িতা হারুনুজ্জামান বলেন, ‘এই বইটি যেমন একটি উদযাপন, তেমনি ভাষাটিকে বাঁচিয়ে রাখার আহ্বানও। ভাষা টিকে থাকা মানে আমাদের মানবিক সত্তা ও সাংস্কৃতিক পরিচয় টিকে থাকা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভাষাগত ঐতিহ্য সংরক্ষণে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।’

ইউনেসকোর অ্যাটলাস অব দ্য ওয়ার্ল্ডস ল্যাংগুয়েজেস ইন ডেঞ্জার বলছে, কোনো ভাষার ব্যবহার যদি পরিবারিক পরিসর, শিক্ষাদান, সংস্কৃতি কিংবা জনজীবনে কমে যেতে থাকে, তাহলে সেই ভাষার সঙ্গে হারিয়ে যেতে থাকে সেই জনগোষ্ঠীর অনন্য ইতিহাস, জ্ঞান ও নিজস্ব পরিচয়।

মাহালি সম্প্রদায়ের সদস্য ও সহরচয়িতা সন্তোষ হেমরম বলেন, ‘এই বই পড়লে আমাদের সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনযাপন, ঘরবাড়ির ধরন, সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা – সবকিছুই জানা যাবে। আমাদের নিজের কোনো বর্ণমালা ছিল না; তাই লিপিবদ্ধ করতে আমরা নিজেরাই চেষ্টা করেছি। তিন ভাষায় বইটি প্রকাশিত হওয়া আমাদের জন্য গর্বের বিষয়, কারণ এখন শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের মানুষও মাহালে ভাষা সম্পর্কে জানতে পারবে।’

ইউনেসকো চেয়ার ইন ল্যাংগুয়েজ ইকোলজি এবং এসসিএমএলইয়ের পরিচালক অধ্যাপক ড. বখতিয়ার আহমেদ বলেন, ‘এই বইয়ে তিন ভাষাকে একসঙ্গে নিয়ে আসা হয়েছে। মাহালি ভাষাকে কেন্দ্র করে বাংলা ও ইংরেজিতে অনুবাদ রাখা হয়েছে। এতে মাহালি সম্প্রদায়ের নতুন প্রজন্মের কাছে নিজেদের ভাষা যেমন পরিচিত হবে, তেমনি বাংলা ও ইংরেজির সঙ্গে সংযোগও তৈরি হবে। তৌহিদ বিন মুজাফফর দীর্ঘ ১২ বছর ধরে বাংলাদেশের বিপন্ন ভাষা নিয়ে কাজ করছেন; তার গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল হলো মাহালি ভয়েসেস।’

অনুষ্ঠানে আইইউবি উপাচার্য অধ্যাপক ম. তামিম, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড্যানিয়েল ডব্লিউ লুন্ড, ইংলিশ অ্যান্ড মডার্ন ল্যাংগুয়েজেস বিভাগের প্রধান ড. নওরীন রাহনুমা, ইউনেসকো গ্লোবাল টাস্কফোর্সের সদস্য সমর সরেন, মাহালি সম্প্রদায়ের নেতা সিষ্টি টুডু, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মুস্তফা কামাল আকন্দ এবং অ্যাডর্ন পাবলিকেশনের প্রধান সম্পাদক, সিইও ও প্রকাশক সৈয়দ জাকির হোসাইন বক্তব্য দেন।

মাহালে ভয়েসেস বইটি রকমারি এবং BanglaREADS–এর অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পাওয়া যাচ্ছে।