তারেক রহমানের শিক্ষা ভাবনা এবং বিএনপির ৩১ দফা রূপরেখার কৌশলগত মূল্যায়ন

তারেক রহমান ও প্রফেসর ড. সাইফুল ইসলাম
তারেক রহমান ও প্রফেসর ড. সাইফুল ইসলাম © টিডিসি সম্পাদিত

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ২৫ অক্টোবর (২০২৫) কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় একটি অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে ঘোষণা করেন যে, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনী প্রযুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আগামী দিনের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে বিএনপি কাজ করছে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য, তিনি জানান, দলের পক্ষ থেকে শিক্ষাবিদদের একটি বিশেষজ্ঞ টিম ইতিমধ্যে প্রচলিত শিক্ষা কারিকুলামকে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাজিয়ে তুলতে 'অনেক কাজ এগিয়ে নিয়ে গেছেন'। তিনি শিক্ষার্থীদের মনে করিয়ে দেন যে, বিশ্ব এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) যুগে প্রবেশ করছে এবং এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে সম্মানের সঙ্গে টিকে থাকার জন্য ব্যবহারিক ও কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ হওয়া অপরিহার্য । তার এই প্রস্তাবনা, বিশেষত 'ক্ষমতায় এলে স্কুলপর্যায়ে কারিগরি শিক্ষা যুক্ত করবো' ঘোষণাটি, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বিদ্যমান কাঠামোগত দুর্বলতা ও গুণগত মান হ্রাসের পটভূমিতে কৌশলগত তাৎপর্য বহন করে।

শিক্ষার পদ্ধতি অনেকরকম। কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, বরং পারিবারিক শিক্ষা (Familial Education) শিশুদের নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশে মুখ্য ভূমিকা পালন করে । শিক্ষাবিদদের মতে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতা ও মানবিক গুণাবলি গড়ে তুলতে পরিবারকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে, কারণ পরিবারেই এসবের বীজ প্রোথিত হয়। সমাজ ও পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ, সহমর্মিতা ও সততার মতো মানবিক গুণাবলির শিক্ষা দিতে পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষকদেরকেও ছাত্র-ছাত্রীদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে । এছাড়াও, সামাজিক কৃষ্টি-কালচার, রীতি-নীতিও শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ সৃষ্টিতে প্রভাব ফেলে।   

একটি জাতি গঠনে শিক্ষা ও সংস্কৃতির (শিক্ষা-সংস্কৃতি) ভূমিকা অপরিসীম । দেশের কৃষ্টি-কালচার, রীতি-নীতি ও ঐতিহ্যকে শিক্ষার সকল স্তরে নিয়মিত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে । বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিশুরা এখন আর শুধু বাংলাদেশের নাগরিক নয়, তারা আন্তর্জাতিক নাগরিক। যোগাযোগ, যাতায়াত ও অর্থনীতির দিক বিবেচনায় বিশ্ব একীভূত হওয়ায় আন্তর্জাতিক নাগরিক হয়ে ওঠার জন্য অন্যান্য ভাষা চর্চা করা প্রয়োজন, যা শিশুদের দেশের জন্য আগামীতে বড় সম্পদে পরিণত হবে। প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে মাতৃভাষায় একটি মজবুত ভিত্তি গড়ে তুলতে এবং একই সাথে ইংরেজিতে মৌলিক দক্ষতা নিশ্চিত করতে চেষ্টা করতে হবে।   

রেনেসাঁর পর ইউরোপ এবং আমেরিকায় শিক্ষা ও জ্ঞানের যে অগ্রগতি হয়েছিল, বাংলাদেশ ৪০০/৫০০ বছরে সেভাবে এগোতে পারেনি। এর কারণ অনুসন্ধান এবং শিক্ষার ভেতরকার প্রতারণা দূর করে একটি জ্ঞান ও মেধাভিত্তিক রাষ্ট্র ও সরকার গঠনে বিএনপি তাদের ৩১ দফা রাষ্ট্র গঠনের রূপরেখায় একটি সুদূরপ্রসারী কৌশল অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই প্রস্তাবটি দলের বিস্তৃত ৩১ দফা রূপরেখার (যা ভিশন ২০৩০ হিসেবে পরিচিত) সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, যেখানে শিক্ষার মাধ্যমে একটি 'জীবনমুখী, ডিগ্রিমুখী নয়' সমাজ গঠনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে । রূপরেখা অনুযায়ী, বিএনপি উচ্চতর শিক্ষায় জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষে জোর দেবে এবং কারিকুলাম ঢেলে সাজানোর জন্য শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনের অঙ্গীকার করেছে । এই লক্ষ্যে, শিক্ষাবিদদের মতে, মালয়েশিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোর উদাহরণ অনুসরণ করে শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি করা সম্ভব, যা দ্রুত অর্থনৈতিক রূপান্তর ঘটাতে সহায়তা করবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক অঙ্গীকার হলো, শিক্ষাখাতে জাতীয় বাজেটের পরিমাণ বৃদ্ধি করে জিডিপির ৫% অর্থ ব্যয় করা হবে।   

২.
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বর্তমানে যে সংকট বিরাজ করছে, তা কেবল পাঠ্যক্রমের সমস্যা নয়, বরং এটি প্রাতিষ্ঠানিক নৈরাজ্য ও রাজনৈতিক দলীয়করণের সরাসরি ফল। রাজনীতিবিদরা এই ব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন যে শিক্ষায় চরম নৈরাজ্য চলছে । অভিযোগ রয়েছে যে শেখ হাসিনা আমলে গত ১৬ বছরে শিক্ষায় দলীয়করণের কারণে শিক্ষকদের ছত্রছায়ায় ছাত্ররা সন্ত্রাস করেছে এবং শিক্ষকরা তাদের দ্বারাই লাঞ্ছিত হয়েছেন, যা শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করেছে।

এই নৈরাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শিক্ষার গুণগত মানের ক্রম অবনমন। বিএনপির নেতারা উল্লেখ করেছেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শিক্ষা র‍্যাংকিংয়ে দেশের কোনো সরকারি বা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শীর্ষ ৫,০০০-এর মধ্যেও নেই। গবেষণা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে গুরুতর ঘাটতি থাকায় এই অবনমন ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপালের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে, যা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান নিয়ে আরও গভীর প্রশ্ন তোলে। এই পরিস্থিতি স্পষ্টতই নির্দেশ করে যে শিক্ষা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো জ্ঞান সৃষ্টির পরিবর্তে দলীয় রাজনীতির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। শিক্ষাবিদরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরা গুণগত মান নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছেন, এবং এই ব্যবস্থা কেবল ডাক্তার বা প্রকৌশলী তৈরি করছে, কিন্তু "মানুষ" তৈরি করছে না। এই প্রাতিষ্ঠানিক দলীয়করণ এবং শিক্ষার পরিবেশে সৃষ্ট নৈরাজ্য প্রমাণ করে যে, রাজনৈতিক সুশাসন নিশ্চিত না হলে কেবল কারিকুলাম পরিবর্তন করে শিক্ষা সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা অর্জন করা সম্ভব হবে না।

৩.
শিক্ষার মাধ্যমে একটি জাতির উত্থান ও অগ্রগতির উদাহরণ হিসেবে বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী জাপানের দৃষ্টান্ত উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারত ও পাকিস্তান শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত মনোযোগ দিতে পারেনি, ফলে তাদের অগ্রগতি মন্থর ছিল। অন্যদিকে, ১৯৪৫ সালের ধ্বংসযজ্ঞের পরেও জাপান দ্রুত গতিতে এগিয়েছে প্রধানত শিক্ষার কারণে—বিশেষত প্রযুক্তি ও নৈতিকতাভিত্তিক শিক্ষার শক্ত ভিত্তি স্থাপনের মাধ্যমে। এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে কেবল পাঠ্যক্রম পরিবর্তন নয়, বরং একটি জাতীয় দর্শনের অংশ হিসেবে ঢেলে সাজানোর জন্য তারেক রহমানের প্রস্তাব একটি জরুরি পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত।

বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুতর ব্যর্থতা হলো এটি বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত বেকার তৈরি করছে। বিবিএস-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ১৮-২০ লাখ নতুন চাকরিপ্রত্যাশী জব মার্কেটে প্রবেশ করে, কিন্তু দেশে-বিদেশে মিলিয়ে মাত্র ৫-৬ লাখের কর্মসংস্থান হয়; বাকিরা শিক্ষিত বেকার থেকে যায়। বিএনপি রাজনীতিবিদরা প্রশ্ন তুলেছেন যে, যে শিক্ষা ব্যবস্থা বেকারত্ব তৈরি করে এবং কর্মবিমুখ, সেই শিক্ষাকে কেন পরিবর্তন করে কর্মমুখী করা হচ্ছে না। এই সমস্যাটি গভীর দক্ষতা-ঘাটতি (Skill Gap)-এর ইঙ্গিত দেয়। বাংলাদেশে বাস্তব কর্মক্ষেত্র থেকে প্রায়ই প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবলের অভাবের কথা বলা হয়। ফলে ভারতসহ বহু দেশের লোক এ দেশে কাজ করছেন এবং বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছেন। এই বাস্তবতা প্রমাণ করে যে প্রচলিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিল্প উৎপাদনের চাহিদা মাফিক দ্রুত, দক্ষ ও কারিগরি মানবসম্পদ তৈরি করতে পারছে না। তারেক রহমানের স্কুলপর্যায়ে কারিগরি শিক্ষা প্রবর্তনের প্রস্তাব এই কর্মবিমুখ শিক্ষাব্যবস্থাকে জীবনমুখী করে তোলার একটি অপরিহার্য কৌশলগত পদক্ষেপ। 

৪.
বিশ্বজুড়ে যখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (4IR) শুরু হয়েছে, তখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI), ব্লক চেইন, রোবটিকস, ন্যানো টেকনোলজি এবং মাইক্রোপ্রসেসর ডিজাইনের মতো ক্ষেত্রগুলোতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির গুরুত্ব অপরিসীম। পুনরুক্তি হলেও বলতে হয়, আগামী দিনের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে বিএনপি কাজ করছে জানিয়ে তারেক রহমান বলেছেন, প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে সম্মানের সঙ্গে টিকে থাকতে হলে ব্যবহারিক ও কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ হতে হবে । 4IR-এর সঙ্গে তাল মেলাতে হলে শিক্ষা কার্যক্রমে প্রযুক্তি সংযুক্তকরণ, শিক্ষকদের কার্যকর প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের উচিত এই বিষয়ে আরও বিনিয়োগ করা এবং একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা, যাতে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারে এবং দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথকে সুগম করতে পারে।  তারেক রহমানের কারিগরি শিক্ষার প্রস্তাবটি মূলত এই বৈশ্বিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে দেশের বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করার কৌশল হিসেবে বিবেচিত। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ (TVET) খাতে বড় বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরি এবং দক্ষ মানবসম্পদ গঠন করা টেকসই উন্নয়নের জন্য জরুরি । স্কুলপর্যায়েই যদি দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়, তবে তা 4IR-এর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করতে পারে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ক্ষমতায় এলে প্রচলিত শিক্ষা কারিকুলামকে ব্যবহারিক এবং কারিগরি শিক্ষা প্রদান করে ঢেলে সাজানোর জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর মূল লক্ষ্য হলো শিক্ষাকে ‘ডিগ্রিমুখী নয়, জীবনমুখী’ করে তোলা । এই ঘোষণাটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বেকারত্বের হার হ্রাস এবং দ্রুত দক্ষ জনবল তৈরির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয় । স্কুলপর্যায়ে কারিগরি শিক্ষা প্রবর্তন শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের বৃত্তিমূলক কাজে প্রাথমিক ধারণা দেবে এবং দৈনন্দিন ছোটখাটো কারিগরি কাজ শেখার সুযোগ সৃষ্টি করবে । কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়, হাতে-কলমে (Hands-on) শিক্ষাই শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনের জন্য অপরিহার্য দক্ষতা প্রদান করবে, যার জন্য অন্যান্য উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে মডেল হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। তারেক রহমানের মতে, এ জন্য দলের পক্ষ থেকে শিক্ষাবিদদের একটি বিশেষজ্ঞ টিম ইতিমধ্যে অনেক কাজ এগিয়ে নিয়ে গেছেন।   

বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম এবং বর্তমান সরকারও দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে এই খাতে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে । কারিগরি শিক্ষায় এনরোলমেন্টের হার ২০২০ সালে ১৭.২৫% ছিল এবং সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে এই হার ৩০% এ উন্নীত করার কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে । ইতোমধ্যে, সারা দেশে ১০,৪৫২টি অনুমোদিত সরকারি ও বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে ৬৪টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ (টিএসসি) এবং নতুন প্রতিষ্ঠিত ৩৫টি টিএসসি রয়েছে । ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে প্রাক্-বৃত্তিমূলক শিক্ষা চালু করার উদ্যোগও নিয়েছে।   

তবে, সম্প্রসারণের এই পরিসংখ্যান সত্ত্বেও, কাঙ্ক্ষিত গুণগত মানের দক্ষতা অর্জন সম্ভব হচ্ছে না । একটি গোলটেবিল বৈঠকে উঠে এসেছে যে কারিগরি শিক্ষার গুণগত মান উন্নত করা এবং কোর্সসমূহকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের স্বীকৃতি লাভের চেষ্টা এখনও সফল হয়নি । মানসম্মত কারিগরি শিক্ষার জন্য অবকাঠামো ও ল্যাবগুলোর উন্নয়ন প্রয়োজন । যদি বিএনপি কেবল বিষয়টি স্কুল কারিকুলামে যুক্ত করে, কিন্তু গুণগত মান নিশ্চিত করতে না পারে, তবে তা বর্তমান ব্যর্থ উদ্যোগগুলোর মতোই দুর্বল হয়ে থাকবে। গুণগত পরিবর্তন আনতে হলে ইন্ডাস্ট্রির সাথে সরাসরি সংযোগ (ইন্ডাস্ট্রি-ইনস্টিটিউট লিংকেজ) এবং এর জন্য সরকারি বাজেট সুনির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন ।   

কারিগরি শিক্ষা প্রসারে সবচেয়ে বড় প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জ হলো এর প্রতি সমাজের নেতিবাচক ধারণা। সমাজে এটি প্রায় প্রতিষ্ঠিত যে, কারিগরি শিক্ষা আর্থিকভাবে এবং শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে পড়াদের শিক্ষা। আর্থিকভাবে সক্ষম পরিবারগুলো সাধারণত সন্তানদের ডিপ্লোমা কোর্সে না পাঠিয়ে বরং বেসরকারি উচ্চশিক্ষায় পাঠান। এই সামাজিক হীনতার কারণে কারিগরি শিক্ষার্থীরা ডিপ্লোমা শেষে উচ্চশিক্ষা (বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং) লাভে সীমিত সুযোগ পান। ডুয়েটে আসন সংখ্যা কম এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক কারণে অনেকের পক্ষে পড়া সম্ভব হয় না । ফলস্বরূপ, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের উপর চাকরির প্রবল পারিবারিক চাপ থাকে এবং দীর্ঘ কর্মঘণ্টার কারণে তারা সান্ধ্যকালীন কোর্সেও বিএসসি করতে পারেন না, যা তাদের শিক্ষাকাল দীর্ঘ করে এবং ক্যারিয়ারে অযথা সময় নষ্ট হয় । এই চক্র ভাঙতে হলে তারেক রহমানের পরিকল্পনা অনুযায়ী কেবল শিক্ষা যুক্ত করাই যথেষ্ট নয়; শিক্ষকদের সম্মান নিশ্চিত করা এবং কারিগরি শিক্ষার মানোন্নয়নের মাধ্যমে এর সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য।   

স্কুলপর্যায়ে কারিগরি শিক্ষা বাধ্যতামূলকভাবে প্রবর্তন করার মূল যৌক্তিকতা হলো দেশের বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীকে তাদের শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করা। তবে এর বাস্তবায়নে জটিল চ্যালেঞ্জ রয়েছে:  নতুন কারিগরি বিষয় পড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত দক্ষ শিক্ষক তৈরি করা একটি বিশাল কাজ। কারিগরি শিক্ষকদের জন্য ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ অপরিহার্য। তৃণমূল পর্যায়ে সকল স্কুলে (বিশেষ করে মাদ্রাসায়) কারিগরি শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ল্যাবরেটরি ও সরঞ্জামাদি স্থাপন করতে বিপুল অর্থ ও সময় প্রয়োজন হবে। বেসরকারি কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে।  শিক্ষা সংস্কার কমিশনকে এমনভাবে কারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে যাতে সাধারণ শিক্ষার (যেমন মানবিক, বিজ্ঞান) সাথে কারিগরি শিক্ষার ভারসাম্য রক্ষা হয়। প্রচলিত পাঠ্যক্রমকে ঢেলে সাজিয়ে ব্যবহারিক শিক্ষাকে কেন্দ্রে আনা কমিশনের প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।   

৫.
অতীতের শিক্ষা কমিশনগুলো, বিশেষত ১৯৭৪ সালের ড. কুদরত-ই-খুদা কমিশন, নীতিগতভাবে দূরদর্শী হলেও , তাদের সুপারিশ কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে মুজিব সরকার ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়েছিল। এই ব্যর্থতার মূল কারণগুলি বহুমাত্রিক এবং কাঠামোগত, যা ভবিষ্যতের নীতি প্রণয়নকারী কমিশনকে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। কুদরত-ই-খুদা কমিশন (১৯৭৪) প্রাথমিক শিক্ষাকে পাঁচ বছর থেকে আট বছর মেয়াদী অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষায় উন্নীত করার সুপারিশ করেছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল দেশপ্রেম, নাগরিকতাবোধ, শ্রম ও ন্যায়নিষ্ঠা ইত্যাদি গুণাবলীর সম্যক বিকাশ সাধন করা। কমিশন একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের সকল নাগরিকের জন্য একটি অভিন্ন ভিত্তি তৈরি করতে চেয়েছিল।   

কিন্তু এই মৌলিক সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। সরকার আট বছর মেয়াদী একমুখী শিক্ষা প্রবর্তন করেনি, বরং শিক্ষা ব্যবস্থা বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম, ইংরেজি ভার্সন এবং মাদ্রাসাশিক্ষা—এই চার ধারায় বিভক্ত থেকে যায় । একমুখী শিক্ষার লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ায় সমাজে শিক্ষাভিত্তিক বৈষম্য বজায় থাকে। এই নীতিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত না হওয়ার মূল কারণ ছিল রাষ্ট্রের আর্থিক সক্ষমতা এবং রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যেকার বিশাল ব্যবধান; আট বছর মেয়াদী বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তনের জন্য যে বিপুল আর্থিক ও অবকাঠামোগত বিনিয়োগ (পর্যাপ্ত সংখ্যক উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক এবং শ্রেণিকক্ষ) প্রয়োজন ছিল, তা রাষ্ট্র সরবরাহ করতে পারেনি। শিক্ষাসংস্কার বাস্তবায়নে ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ হলো শিক্ষা খাতে সরাসরি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয় । ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের শক্তি বাড়িয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার উদ্দেশ্যে পেশাজীবীদের সংগঠনগুলোকে দলীয় ব্যানারে নিয়ে আসতে শুরু করে। 

গত ১৬ বছরে শাসকদলের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের ফলে শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের পরিবর্তে রাজনৈতিক পরিচয়ের ওপর ভিত্তি করে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে । শিক্ষকদের একটি বড় অংশ ভুয়া সনদপত্রের মাধ্যমেও নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছে, যা শিক্ষার মানের মেরুদণ্ডকে দুর্বল করেছে। শিক্ষকদের সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ পেশাগত প্রতিশ্রুতি ও নৈতিকতার পরিপন্থী । নিয়োগপ্রাপ্ত দলীয় লোকজনেরা শিক্ষাদানের পরিবর্তে সরকারি দলের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা ও নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে চেষ্টা করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, কোনো প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিমুক্ত না হলে তার দায় প্রতিষ্ঠান প্রধানকে নিতে হয়।   

শিক্ষানীতিগুলো প্রায়শই ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মভিত্তিক শিক্ষার আদর্শিক সংঘাতের শিকার হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো বিশ্বাস করে যে পাঠ্যপুস্তককে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে শিক্ষার্থীদের 'ধর্মকে' অনুসরণ করানো যাবে বা দলীয় মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করা যাবে। এর ফলস্বরূপ, শিক্ষার রূপান্তর একটি আদর্শিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে বিজ্ঞানমনস্ক ও ধারাবাহিক সংস্কার অসম্ভব। রাজনৈতিক মতাদর্শ অনুযায়ী পাঠ্যবইয়ের ইতিহাসের অংশগুলো ঘন ঘন পরিবর্তন করা হয়। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মনে জাতীয় ইতিহাস এবং চেতনার বিষয়ে স্থায়ী ও অভিন্ন ধারণা তৈরি হয় না।  ঘন ঘন শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের ফলে শিক্ষা ব্যবস্থায় অস্থিরতা দেখা দেয়। এর ফলে শিক্ষার লক্ষ্য 'শিশুর সামগ্রিক ব্যক্তিত্বের বিকাশ' থেকে সরে গিয়ে কেবল 'পরীক্ষামুখী' হয়ে ওঠে।   

নীতি বাস্তবায়নের জন্য একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো অপরিহার্য হলেও, অতীতের কমিশনগুলো আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়হীনতার কারণে ব্যর্থ হয়েছে। দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে গুরুতর সমন্বয়হীনতার অভাব রয়েছে, যার ফলে একই কাজের পুনরাবৃত্তি এবং দ্বৈত ব্যবস্থাপনার সৃষ্টি হয়। এই দ্বিমুখী ব্যবস্থাপনার কারণে কালক্ষেপণ হয় এবং শিক্ষার উন্নতিতে স্থবিরতা তৈরি হয়। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য দক্ষ শিক্ষকের পাশাপাশি কার্যকর পরীবিক্ষণ (মনিটরিং) ও জবাবদিহিতারও অভাব বিদ্যমান । জবাবদিহিতার অভাবের সঙ্গে যুক্ত হয় শিক্ষকদের মধ্যে পেশাগত উদ্দীপনার অভাব। শিক্ষা সংস্কার সংক্রান্ত বড় প্রকল্পগুলির বাস্তবায়ন পর্যায়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রায়শই বিলম্ব হয়। অদক্ষ প্রশাসন ও আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা নীতিকে কার্যকরভাবে মাঠ পর্যায়ে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, যার ফলে নীতির বাস্তবায়ন সময়ের সাথে সাথে বিলীন হয়ে যায়।
৬.
বিএনপি'র ভিশন ২০৩০-এর একটি মৌলিক এবং উচ্চাভিলাষী অঙ্গীকার হলো, শিক্ষাখাতে জিডিপির ৫% অর্থ ব্যয় করা হবে। বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুসারে, ইউনেস্কো শিক্ষা খাতে জিডিপির ৪% থেকে ৬% এবং জাতীয় বাজেটের ২০% বরাদ্দ দেওয়ার সুপারিশ করে । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের জনৈক অধ্যাপক জোর দিয়ে বলেছেন, ইউনেস্কোর চাওয়া অনুযায়ী বাংলাদেশে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে না এবং গুণগত মান বাড়াতে হলে বরাদ্দ বাড়িয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে। বিগত বছরগুলোতে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ জিডিপির ১.৬৯% থেকে ২.৫% এর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল (যেমন ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১.৭৬% এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১.৭%)। জাতীয় বাজেটের হিসাবে, এই বরাদ্দ দীর্ঘদিন ধরে ১২ শতাংশের বৃত্ত থেকে বের হতে পারেনি । শিক্ষাবিদরা বলছেন, এই বরাদ্দ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড তো নয়ই, বরং স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশে শিক্ষায় বরাদ্দ তলানির দিকে রয়েছে।   

জিডিপির ৫% বরাদ্দের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হলে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান উন্নয়নে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে। এই পরিমাণ বরাদ্দ কেবল ব্যয় নয়, বরং এটি একটি কৌশলগত বিনিয়োগ। শিক্ষাবিদদের মতে, শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলে মাহাথির মোহাম্মদ ১০ বছরে মালয়েশিয়ার চেহারাই বদলে দিয়েছিলেন। দক্ষিণ কোরিয়াও একসময় পিছিয়ে ছিল, কিন্তু শিক্ষার উন্নতি করে দেশটি উন্নত দেশের তালিকায় উঠেছে। এই বিনিয়োগের মাধ্যমে—বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত; এই বরাদ্দ বাড়লে রিসার্চ ফ্যাসিলিটিজ এবং বিজ্ঞান শিক্ষাকে বিস্তার করা সম্ভব হবে।   TVET খাতে বড় বিনিয়োগ করা সম্ভব হবে, যা কর্মসংস্থান তৈরি এবং দক্ষ মানবসম্পদ গঠনে সহায়তা করবে। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা আকর্ষণীয় করা যাবে, যা মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করবে এবং মেধা পাচার রোধ করবে।   

তবে এই বিশাল আর্থিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য সুস্পষ্ট কৌশল প্রয়োজন। সরকারের রাজস্ব কাঠামো বজায় রেখে রাতারাতি এই লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন। এই প্রতিশ্রুতি অর্জনের জন্য প্রয়োজন হবে রাজস্ব আহরণের নতুন ও কার্যকর কৌশল এবং জাতীয় বাজেটে অন্যান্য খাত থেকে বরাদ্দ পুনর্বিন্যাস। যদি এই আর্থিক অঙ্গীকার পূরণের জন্য একটি বিস্তারিত এবং বিশ্বাসযোগ্য রাজস্ব মডেল প্রকাশ করা না হয়, তবে এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য অর্জনের পথে আর্থিক স্থবিরতা একটি বড় হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।   

তারেক রহমান শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণসহ তাদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে শিক্ষকদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণে বিএনপি কাজ করছে। জনগণের ভোটে বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেলে শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণে উচ্চ পর্যায়ের কমিশন গঠন করা হবে, যা রাষ্ট্রের সামর্থ্য অনুযায়ী বিষয়টি ইতিবাচক বিবেচনার জন্য কাজ করবে। এই পদক্ষেপ মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, কারণ শিক্ষকতা মেধাবীদের প্রথম পছন্দ হওয়া উচিত। এই কমিশন বেসরকারি শিক্ষকদের বঞ্চনার বিষয়টি সমাধান করতে পারে। যেমন, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকরা, যাদের বেতন মাত্র ১৫০০ টাকা থেকে ৩০০০ টাকা, তারা দীর্ঘকাল ধরে জাতীয়করণের ন্যায্য দাবি জানাচ্ছেন এবং বর্তমানে তারা উপেক্ষিত । বিএনপি’র এক নেতা ইবতেদায়ী শিক্ষকদের বেতন-ভাতার বিষয়টি অন্যায্য বলে উল্লেখ করে তাদের সমস্যাকে 'জেনুইন' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের দাবি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো সকল এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করতে হবে। জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত একটি বিশাল রাজনৈতিক ও সামাজিক দাবি পূরণ করবে, তবে কমিশনকে অবশ্যই এর বিশাল আর্থিক প্রভাব বিশ্লেষণ করতে হবে এবং এটি যেন কেবল সরকারি কোষাগারের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি না করে তা নিশ্চিত করতে হবে।   

শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের সামাজিক মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখা শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য একটি 'অদৃশ্য' কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ শর্ত । তারেক রহমান স্বীকার করেছেন যে শিক্ষকরা যদি সমাজে প্রতিনিয়ত সম্মান নিয়ে টানাপড়েনে থাকেন, তবে তাদের পক্ষে শিক্ষার্থীদের সামনে নিজেকে আদর্শ রোল মডেল হিসেবে উপস্থাপন করা কঠিন হয়ে পড়ে।   

৭.
বিএনপি প্রচলিত শিক্ষা কারিকুলামকে ঢেলে সাজানোর জন্য একটি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করতে চায়, যার অগ্রাধিকার হবে ব্যবহারিক এবং কারিগরি শিক্ষা প্রদান । এই কমিশনকে এমন শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে যা ডিগ্রি অর্জনের পরিবর্তে দক্ষতাভিত্তিক সাক্ষরতা প্রদান করবে এবং শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনে দক্ষ করে তুলবে। অতীতে বিভিন্ন শিক্ষা কমিশন গঠিত হলেও, অন্তর্বর্তীকালীন ড. ইউনূস সরকারের সময় একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়নি, যা শিক্ষার ত্রুটি-বিচ্যুতি সঠিকভাবে নিরূপণ করতে পারত । শিক্ষা কমিশন গঠন না করে এবং জিডিপির ৫% বরাদ্দের মতো মৌলিক বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায়, ড. ইউনূস সরকার শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা দূরীকরণে ব্যর্থ বলে সমালোচিত। এই ব্যর্থতা প্রমাণ করে যে, কেবল প্রশাসনিক পরিবর্তনের মাধ্যমে মৌলিক সংস্কার সম্ভব নয়।  তাই, বিএনপি'র প্রস্তাবিত কমিশনকে অবশ্যই পূর্ববর্তী ব্যর্থতার কারণগুলো চিহ্নিত করে একটি অরাজনৈতিক, কার্যকর এবং টেকসই রোডম্যাপ প্রণয়ন করতে হবে।   

শিক্ষাব্যবস্থায় সুশাসন নিশ্চিত করা বিএনপির রূপরেখার একটি মূল ভিত্তি। শিক্ষা প্রশাসনে দুর্নীতির অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে, বিশেষত বেসরকারি শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। এই দুর্নীতি রোধ করা না গেলে শিক্ষা খাতে জিডিপির ৫% বরাদ্দের মতো বিশাল বিনিয়োগের অপচয় হবে ।   

তারেক রহমান দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক বিপ্লব গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন, যা প্রশাসনিক স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধির মাধ্যমে শুরু হতে পারে। বিএনপি'র কমিশনকে অবশ্যই এই প্রক্রিয়াটিকে শক্তিশালী করে দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে শিক্ষক নিয়োগ মেধাবীদের জন্য প্রথম পছন্দ হতে পারে। প্রশ্নপত্র ফাঁস একটি গুরুতর সমস্যা যা শিক্ষার গুণগত মান এবং জনগণের আস্থার ভিত্তি দুর্বল করে দিচ্ছে। বিএনপি'র কমিশনকে অবশ্যই একাডেমিক ইন্টিগ্রিটি পুনরুদ্ধারে প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক উভয় সমাধানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।   

৮.
বিএনপি’র শিক্ষা রূপরেখাটি বিদ্যমান কাঠামোগত দুর্বলতা মোকাবেলায় একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রচেষ্টা। তারেক রহমান একটি উন্নত ধারণা প্রবর্তন করতে চাইছেন। তবে এই ধারণার বাস্তবায়ন সফল হবে কিনা, তা নির্ভর করবে অসুস্থ রাজনীতি দূর করে দলের অভ্যন্তরে শিক্ষা ও গবেষণা নিয়ে কাজ করার মতো একটি শক্তিশালী ও বিশেষজ্ঞ টিম গঠনের ওপর। যদি দলের ভেতরে শিক্ষা নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা না থাকে এবং কেবল রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে বিষয়টি ব্যবহার করা হয়, তবে এই মহৎ ধারণা বাস্তবে রূপ দেওয়া কঠিন হবে।   

বিএনপি'র শিক্ষাবিষয়ক রূপরেখাটি প্রচলিত ডিগ্রিমুখী শিক্ষাব্যবস্থাকে কর্মমুখী করে তোলার জন্য একটি শক্তিশালী প্রত্যয়। তারেক রহমানের স্কুলপর্যায়ে কারিগরি শিক্ষা প্রবর্তনের ঘোষণাটি ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আংশিক উদ্যোগের তুলনায় আরও সুসংগঠিত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এই পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আর্থিক সক্ষমতা এবং দলের ভেতরে একটি সুসংগঠিত বিশেষজ্ঞ দলের প্রমাণ দেওয়া অপরিহার্য। দলীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বিএনপি বিশ্বাস করে, ২০২৬ সালে গঠিত বিএনপি সরকারই পারবে তাদের ৩১-দফা রূপরেখা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই ব্যর্থতার চক্র ভাঙতে এবং একটি জ্ঞানভিত্তিক, মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে।

লেখক: সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়