অর্থ নয়, ক্যান্সার চিকিৎসায় আসল বাধা দুর্নীতি আর জটিল সিস্টেম: স্বাস্থ্য উপদেষ্টা
- ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ২১:০১
অর্থ নয়, দুর্নীতি আর জটিল ‘সিস্টেম’ই ক্যান্সার চিকিৎসার মূল প্রতিবন্ধক বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। আজ সোমবার (২৭ অক্টোবর) সকালে মহাখালীতে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ‘ক্যান্সার সচেতনতা মাস’ উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন। এ সময় ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত মেশিনের ক্রয় প্রক্রিয়া নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেন, আগে প্রিভেনশনের (প্রতিরোধ) জন্য যে বাজেট ছিল, সেটা কমে যাচ্ছে। আমরা কোথায় যেন প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে অবহেলা করছি। ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কার্যকর লড়াই শুরু করতে হলে আগে থেকেই মানুষকে সচেতন করতে হবে। ক্যান্সার একদিনে হয় না, বছরের পর বছর তামাকের সংস্পর্শে, অস্বাস্থ্যকর খাবারে, জীবনযাপনে তৈরি হয়। স্কুলের মেয়েদের যদি এ শিক্ষা দেওয়া যেতো, তাহলে তারা ঘরে গিয়ে মাকে, দাদিকে বলত। এতে রোগ আগেভাগে ধরা পড়তো। লজ্জা নয়, সচেতনতা বাড়ানোই এখন জরুরি। প্রিভেনশন তো লজ্জার বিষয় নয়। এটা জয় করতে হবে। প্রত্যেকের ঘরে নারী আছে, তাদের সচেতন করি মমতার সঙ্গে।
ক্যান্সার রোগীদের দুর্ভোগের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, আজ নিচে যখন পেশেন্টদের পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলাম, বুঝলাম ক্যান্সার শুধু রোগীর নয়, পুরো পরিবারের দুর্যোগ। একজন স্তন ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসায় ২৬ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে; সে নিজের থেকে নয়, ধার করে এসেছে। এই ব্যথা আমাদের বোঝা উচিত।
তিনি বলেন, তামাকের কারণে অনেক ক্যান্সার হয়, কিন্তু প্রতিরোধে আমরা কার্যকর হতে পারিনি। আমি প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, টোব্যাকো থেকে আমরা যে রাজস্ব পাই, তার চেয়ে চিকিৎসায় খরচ করি বেশি। তামাক বন্ধ করা সম্ভব, কিন্তু পারছি না। এজন্য সময় ও সঠিক পরিকল্পনা দরকার।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ত্রুটির দিকেও ইঙ্গিত করেন। ক্ষোভ প্রকাশ করেন অব্যবস্থাপনা নিয়েও। তিনি বলেন, একটা মেশিনের দাম ২৪ কোটি, আরেকটার ৩৮ কোটি—দুইটার কোয়ালিটি একই অথচ দামের এত পার্থক্য! কেন? কারণ আমাদের সিস্টেমে গলদ আছে। যারা প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করে, তারা আন্তর্জাতিক টেন্ডারে সরাসরি কিনতে পারে, কিন্তু সরকার পারে না—এটা কেন হবে? আমাদের টাকার স্বল্পতা আছে, কিন্তু আজ যে সমস্যাগুলো দেখছি সেগুলো শুধু অর্থের নয়, সিস্টেমের। সিস্টেমটা না ভাঙলে আমরা এগোতে পারব না। কারণ সিস্টেমে এমন কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়, যা বাস্তবে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। আমাদের ভাবতে হবে, এ সিস্টেম থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায়। কারণ এ সিস্টেমটাই রোগীর চিকিৎসা বিলম্বিত করছে, জনগণের টাকা নষ্ট করছে।
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বলেন, ক্যান্সার চিকিৎসায় আসল বাধা অর্থ নয়, বরং দুর্নীতি আর জটিল সিস্টেম। ১৪ কোটি টাকায় কী ঢুকলো প্রশ্নটি কেবল একটি যন্ত্রের নয়, পুরো ব্যবস্থার প্রতীক। অপচয় বন্ধ করে সেই অর্থ যদি রোগীর চিকিৎসার জন্য খরচ করা যায়, সেটাই হবে আসল উন্নয়ন।
এ সময় হাসপাতালের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও পরিবেশ নিয়েও মন্তব্য করেন নুরজাহান বেগম। বলেন, হাসপাতালকে হাসপাতালের মতো রাখতে হবে। একজন রোগীর সঙ্গে অনেক এটেন্ডেন্ট আসে—এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা, করিডরে ঘুমানো; এসব বন্ধ করতে হলে রোগীদেরও শিক্ষিত করতে হবে।
তিনি বলেন, আজ আপনারা ক্রেস্ট ও ফুল দিলেন। এগুলোর দরকার নেই। এই টাকা রোগীর পেছনে খরচ করতে পারি। একটা ফুলের তোড়ায় ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা খরচ হয়, অথচ এ টাকায় অন্তত একজন রোগীর ওষুধ কেনা যেত। আরও অনেক কিছু পরিবর্তনের আছে। পরিবর্তন করতে হলে সঙ্গী সাথী সে রকম লাগে। সেটা আমাদের তৈরি হয়নি। ট্রাস্ট তৈরি হয়নি। এটা তৈরি করতে হবে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য সচিব মো. সাইদুর রহমান বলেন, বেশির ভাগ মানুষ সেবার বাইরে থাকে ৷ স্ক্রিনিং দেরি হওয়ার কারণে চিকিৎসাও দেরি হয়। তাতে অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। এদিকে আবার ১৭ কোটি মানুষের একটা মাত্র হাসপাতাল। সবার নির্ভরতা এটার ওপর। মানুষ সুদূর গ্রাম থেকে আসেন, সিরিয়াল পান না। এখানে এসে রাস্তায় শুয়ে বসে থাকেন। দিনের পর দিন অপেক্ষায় থেকে সেবা নেন।
তিনি বলেন, আমার বড় বোন ক্যান্সারে মারা গেছেন। আমাদের পরিবারের কেউ আক্রান্ত হলে মনে করি, এটা নিয়ে কাজ করতে হবে। অথচ আমাদের এখনই সবার একসঙ্গে কাজ করা উচিত। যে কোনো সময় ক্যান্সারে আক্রান্তের তালিকায় আমাদেরও যোগ দিতে হতে পারে। এজন্য আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বলেন, অসংক্রামক ব্যাধিতে ৭১ শতাংশ মানুষ মারা যাচ্ছে। এর মধ্যে ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। দিন দিন এ সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। এটার প্রতিরোধ ও প্রতিকারে আমাদের সবার সচেষ্ট হতে হবে।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর কবির বলেন, আমাদের শুধু অবকাঠামো ও মেশিনারিজ হলেই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন দক্ষ জনবল। আমরা ৩০০ বেডের হাসপাতালের জনবল দিয়ে ৫০০ বেডের কাজ চালাচ্ছি। জনবলের প্রস্তাব এরই মধ্যে পাঠিয়েছি। এটি এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ে আছে। আশা করি, শিগগির আমরা জনবল বাড়াতে পারবো।
তিনি বলেন, অধিকাংশ ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমাদের দেশে বিশ্ব মানের ক্যান্সার চিকিৎসা হয়। কেমোথেরাপি ফ্রি দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।