নতুন নাম আর দৃশ্যমান ক্যাম্পাস নিয়ে এক যুগে বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি
- ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ১৭:৪৪
দেশের একমাত্র মেরিটাইম বিষয়ক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি এক যুগ পূর্ণ করতে যাচ্ছে নতুন নাম ও দৃশ্যমান স্থায়ী ক্যাম্পাসের হাতছানিতে। ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর যাত্রা শুরু করা এই বিশেষায়িত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি এখন স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ, নাম পরিবর্তন ও একাডেমিক সম্প্রসারণের মাধ্যমে এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করছে।
বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অন্য যেকোনো বারের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। এটি কেবল একটি ক্যালেন্ডারের পাতা ওল্টানো নয়, বরং দীর্ঘদিনের দুটি বড় অপূর্ণতা ঘুচিয়ে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সন্ধিক্ষণ। নতুন পরিচয়ে স্থায়ী ক্যাম্পাসের স্বপ্নপূরণের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এক যুগ পূর্তি উদযাপন করবে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
চব্বিশের ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সাল বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির জন্য একটি ঐতিহাসিক বছর। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি যা গত বছরও শিক্ষার্থীদের স্লোগানে সীমাবদ্ধ ছিল, এই বছর তা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছে। শিক্ষার্থীদের দাবি ও সরকারি পর্যালোচনার পর, এ বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি' করা হয়েছে।
অস্থায়ী ঠিকানা থেকে স্বপ্নের গন্তব্য
প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ এক যুগ রাজধানী ঢাকার মিরপুর-১২, পল্লবীতে দুটি ভাড়া করা ভবনে চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম। এই দীর্ঘ পথচলায় সবচেয়ে বড় আক্ষেপ ছিল একটি স্থায়ী ক্যাম্পাস না থাকা। চট্টগ্রামের বাকলিয়ার হামিদচরে ১০৬.৬ একর জমি বরাদ্দ হলেও তা দীর্ঘদিন ছিল কেবলই বালুকাময় প্রান্তর। কিন্তু সেই চিত্রে আমূল পরিবর্তন এসেছে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত যা ছিল শুধুই অপেক্ষা, ২০২৪ সালের মার্চে সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় বিশাল নির্মাণযজ্ঞ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ মুসা এই নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। বর্তমানে সেখানে পুরোদমে চলছে একাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, ছাত্র-ছাত্রীদের পৃথক হল এবং রেস্ট হাউসসহ অন্যান্য ভবনের নির্মাণ কাজ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্ব
বিশ্ববিদ্যালয়টির গুরুত্বপুর্ন পদগুলোতে দায়িত্বে থাকেন নৌবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। প্রথম উপাচার্য রিয়ার অ্যাডমিরাল এ এস এম বাতেনের হাত ধরে শুরু হওয়া এই প্রতিষ্ঠানের অগ্রযাত্রা এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে। বর্তমানে পঞ্চম উপাচার্য রিয়ার এডমিরাল খন্দকার আখতার হোসেন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই স্থায়ী ক্যাম্পাস প্রকল্পকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন। তিনি নিয়মিত প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে কাজে গতিশীলতা এনেছেন। এ ছাড়া কমোডর খন্দকার তৌফিকুজ্জামানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রেজিস্ট্রার ও কমোডর এ এন এ রেজাউল হককে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ট্রেজারার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে। ১২ বছর পর বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত আছেন কমোডর মোহাম্মদ এহসান উল্লাহ খান এবং ট্রেজারার হিসেবে দায়িত্বে আছেন কমোডর মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম। প্রশাসনের এই ধারাবাহিকতায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আশাবাদী- সব ঠিক থাকলে ২০২৬ সালের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়টি তার স্থায়ী ঠিকানা চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত হতে পারবে। তবে ঘনঘন প্রশাসনিক রদবদলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন কিছুটা হলেও ব্যাহত হয়। সে বিষয়ে নজর দেওয়ার জন্য ইউজিসি, সরকার ও বাংলাদেশ নৌবাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছেন শিক্ষার্থীরা।
সাফল্যের ক্যানভাস
ক্লাসরুম থেকে বিশ্বমঞ্চ
শুধু ইট-পাথরের উন্নয়ন নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল প্রাণ এর শিক্ষার্থীরা। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য প্রথম ভর্তি পরীক্ষা নেয় বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি। মেরিটাইম ইউনিভার্সিটিতে বর্তমানে মেরিটাইম গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি, শিপিং অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, আর্থ অ্যান্ড ওশান সায়েন্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদের অধীনে ৫টি স্নাতক প্রোগ্রাম চলমান। এই চারটি ফ্যাকাল্টিতে প্রতিবছর ২০০ শিক্ষার্থী স্নাতকে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। এ ছাড়া মোট ৭টি অনুষদের অধীনে ৩৮টি বিভাগ রয়েছে। এগুলোর স্নাতকোত্তর প্রোগ্রাম চালু রয়েছে এবং কিছু বিভাগের কার্যক্রম স্থায়ী ক্যাম্পাসে চালু হবে বলে আশাবাদী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি ব্যাচেলর অব মেরিন সায়েন্সও চালু রয়েছে মেরিন ক্যাডেটদের জন্য। এর বাইরে কিছু অতিরিক্ত বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিও দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে এক হাজারের বেশি শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পড়াশোনা করছেন।
অস্থায়ী ক্যাম্পাসের সীমাবদ্ধতার মাঝেও এই এক যুগে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় অর্জন এর গ্র্যাজুয়েটরা। তারা এরই মধ্যে দেশি-বিদেশি শিপিং সেক্টরে অভাবনীয় সাফল্য রাখতে শুরু করেছেন। শুধু চাকরির বাজারেই নয়, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও শিক্ষার্থীরা পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা বর্তমানে স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাস্টার্স ও অন্যান্য প্রোগ্রামে গবেষণার সুযোগ পাচ্ছেন।
দক্ষতা ও অর্জন মুখর ক্যাম্পাস
একাডেমিক শিক্ষার বাইরেও রাজনীতি মুক্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে ক্যাম্পাসজুড়ে সক্রিয় আছে বিভিন্ন ক্লাব ও সংগঠন। এর মধ্যে সায়েন্স ক্লাব, কালচারাল ক্লাব, হাইকিং ক্লাব, বিজনেস অ্যান্ড ক্যারিয়ার ক্লাব, স্পোর্টস ক্লাব, ফটোগ্রাফি ক্লাব, সাংবাদিক সমিতি, স্টুডেন্টস প্ল্যাটফর্ম, ডিবেটিং সোসাইটি, ল অ্যান্ড মুট কোর্ট ক্লাব, হাল্ট প্রাইজ, রক্তদানের সংগঠন ‘রক্ত’, ইয়ুথ ম্যাপার্স অন্যতম। বিশেষায়িত পড়াশোনার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমকে প্রসারিত করছে এসব ক্লাব ও সংগঠন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও বিভিন্ন অর্জন রয়েছে ক্লাব ও সংগঠনগুলোর। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় মুট কোর্ট প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, আইডিয়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছে বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির ক্লাবগুলো। এছাড়া শিক্ষার্থীরা নিয়মিতভাবে বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম ‘হাল্ট প্রাইজ’ ‘ইয়ুথ ম্যাপার্স’-এ অংশগ্রহণ করে নিজেদের উদ্ভাবনী ধারণা ও দক্ষতা তুলে ধরছেন।
এর পাশাপাশি বিশেষায়িত শিক্ষার বাইরেও শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনে দক্ষ করে তুলতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যুগোপযোগী নতুন উদ্যোগ নিয়েছে। সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের জন্য সাঁতার এবং ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কোর্স চালু করা হয়েছে। এছাড়া প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে বিভিন্ন বিভাগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও সম্পর্কিত শর্ট কোর্সও নিয়মিত চলছে। আগামী বিশ্বের জন্য প্রস্তুত করে তুলতে চাইনিজ, জাপানিজ ও অন্যান্য ভাষা প্রশিক্ষণ নিয়েও কাজ চলছে।
প্রতিবন্ধকতা ও আগামীর সম্ভাবনা
অবশ্য এই পথচলা পুরোপুরি মসৃণ ছিল না। ভাড়া করা দুটি ভবনে ক্লাসরুম সংকট, ল্যাবের অপর্যাপ্ততা, দক্ষ শিক্ষক সংকট এবং অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় অত্যধিক সেমিস্টার ফি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দীর্ঘদিনের অসন্তোষ ছিল। তবে শিক্ষার্থীরা এ নিয়ে সক্রিয় ছিলেন। দীর্ঘদিনের দাবি ও ধারাবাহিক আন্দোলনের মুখে ২০২৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেমিস্টার ফি কিছুটা হলেও কমাতে বাধ্য হয়, যা শিক্ষার্থীদের জন্য স্বস্তি হিসেবে আসে। তবে সরকারের সঠিক সহযোগিতা পেলে ও স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হলে সেমিস্টার ফি আরো কমে আসবে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীদের জন্য দুটি ছাত্র হল, একটি ছাত্রী হল, একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, দুইটি লাইব্রেরি ও ক্যাফেটেরিয়া রয়েছে। হল দুটি মিরপুর ডিওএইচএসে অবস্থিত। সীমিত পরিসরে হলেও ভাড়া ক্যাম্পাস ও আবাসিক হল দুটিতে অত্যাধুনিক সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে ভাড়া নেওয়া ভবন হওয়ায় অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যাল়গুলোর চেয়ে হলের ভাড়া অনেক বেশি।
সব কিছু মিলিয়ে মেরিটাইম গ্র্যাজুয়েটদের জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধকতা এখনো রয়ে গেছে। দেশের বিভিন্ন বন্দর ও মেরিটাইম সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ পরীক্ষায় এখনো পুরোনো ধাঁচের সিলেবাসে পরীক্ষা হওয়ায় বিশেষায়িত বিষয়ে স্নাতক করেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য কাজ করছেন বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন
এক যুগ পূর্তিতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি এখন একটি নতুন ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে। নতুন নাম, নতুন নেতৃত্ব আর দৃশ্যমান স্থায়ী ক্যাম্পাসের হাতছানি—এই তিনে মিলে আগামীর এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মতে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরে আন্তর্জাতিক মানের এই স্থায়ী ক্যাম্পাস চালু হলে এটি কেবল দেশের নয়, বরং পুরো অঞ্চলের মেরিটাইম শিক্ষার বাতিঘর হয়ে উঠবে এবং দেশের সুনীল অর্থনীতি অর্জনে প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম যুগ পূর্তি উপলক্ষে জমকালো আয়োজনের পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি। এ উপলক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় আলোকসজ্জা ও অন্যান্য কর্মসূচি পালন করবে। দেরিতে হলেও নভেম্বরে এক যুগ উপলক্ষে বিভিন্ন আয়োজন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করার পরিকল্পনা করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।