বন্ধের পর হঠাৎ ফিরে আসল ‘সুইজারল্যান্ড প্রবাসী’ পেজ, এর পেছনে আসলে কারা?

সুইজারল্যান্ড প্রবাসী পেজের তিন চরিত্র ওসমান গনি,আবুল কালাম প্লাম্বার ও কামরুজ্জামান কামরুজ্জামান
সুইজারল্যান্ড প্রবাসী পেজের তিন চরিত্র ওসমান গনি,আবুল কালাম প্লাম্বার ও কামরুজ্জামান কামরুজ্জামান © সংগৃহীত

‘সুইজারল্যান্ড প্রবাসী’ নামের জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পেজটি তৈরি করা হয় ২০২৩ সালের জুলাই-অগাস্টের দিকে। শুরু থেকেই ব্যঙ্গ, স্যাটায়ার আর সময়োপযোগী মন্তব্যে পেজটি দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। তখন  কিন্তু জনপ্রিয়তার কিছুদিন পরই এক ঘোষণার মাধ্যমে হঠাৎ করে এর কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এরপর আবারও অনেকটা হঠাৎ করেই ২০২৪ সালের অগাস্ট মাসের শুরুতে পেজটি চালু হয়। বর্তমানে এই পাতার দুই লাখ ৮০ হাজার ফলোয়ার রয়েছে। কামরুজ্জামান কামরুজ্জামান, ওসমান গনির মতো চরিত্রদেরও আলাদা আলাদা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। পাতাটির পরিচয় অংশে লেখা আছে, 'মাতৃভূমি সুইজারল্যান্ডকে ভালোবাসি । হৃদয়ে সুইজারল্যান্ড'।

অনেকের জানা নেই, সুইজারল্যান্ড প্রবাসী নামে পরিচিত হলেও এই পাতাটি আসলে সুইজারল্যান্ড থেকে পরিচালিত হয় না, সেখানকার কেউ পাতাটির সাথেও নেই। এভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ কী এবং পুনরায় ফিরে আসার পেছনে কারণ কী—সে বিষয়ে মুখ খুলেছেন ‘সুইজারল্যান্ড প্রবাসী’ পেজের কারিগর।

এই পাতাটির পেছনে রয়েছেন প্রবাসী একজন বাংলাদেশি ও তার দল। তিনি নিজের বা দলের সদস্যদের নাম প্রকাশ করতে চাননি। পাঠকদের সুবির্ধার্থে আমরা তাকে 'সুইজারল্যান্ড প্রবাসী' বা কখনো কখনো শুধুমাত্র 'প্রবাসী' বলে বর্ণনা করবো।

সুইজারল্যান্ড প্রবাসী পাতার এই নির্মাতা বলছিলেন, এই পাতার সবাই কাল্পনিক চরিত্র হলেও তারা আসলে প্রবাসে থাকা বিভিন্ন বাংলাদেশি চরিত্রের আদলে তৈরি করা হয়েছে, যাদেরকে প্রবাস জীবনের নানা পর্যায়ে তিনি দেখতে পেয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘আমি আসলে যে দেশে থাকি, এখানে আমার আশেপাশে যে মানুষজন, তাদের মধ্যে সুইজারল্যান্ড প্রবাসীর ক্যারেক্টারগুলোর অনেক মিল আছে। যেমন ধরুন আমি যদি একজন স্টুডেন্ট হই, তারা আমাকে নানাভাবে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করবে। বলবে অমুকের সাথে মেশা যাবে না, অমুকের কাছে যাওয়া যাবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখানে আবার গ্রুপও আছে। কেউ সিলেট থেকে আসা সিলেটি কম্যুনিটি, কেউ ইটালি থেকে আসা বা কেউ পর্তুগাল থেকে আসা, এক গ্রুপের সাথে আরেক গ্রুপের ঝামেলা। এটা সবাই যে করে তা, বেশিরভাগ এরকম করে।’

অদ্ভূত সব কর্মকাণ্ডের জন্য পাঠকদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত হয়ে উঠেছেন কামরুজ্জামান কামরুজ্জামান, ওসমান গণি, আবুল কালামের মতো চরিত্রগুলো। তারা কি বাস্তব জীবনে আসলেই আছেন? জানতে চাইলে সুইজারল্যান্ড প্রবাসীর কারিগর জানান, সরাসরি না হলেও এই ধরনের চরিত্র বর্তমানেও আছে। নামটা হয়তো ভিন্ন, ছবিগুলোও হয়তো মডিফাই করা, কিন্তু এ ধরনের মানুষ প্রত্যেকেই তাদের আশেপাশে আছে।

তিনি বলেন, ‘যারা ধর্ম নিয়ে সমালোচনা করছেন, কবিতা লিখছেন বা নারী বিদ্বেষী কথাবার্তা বলছেন, এরা প্রত্যেকেই আছে আমাদের আশেপাশে’। কিন্তু পাতাটির সাথে যারা সংশ্লিষ্ট, তারা কেউ দেশবিরোধী, সাম্প্রদায়িক বা নারী বিদ্বেষী নন। শুধু তারা এই ধরনের মানুষদের মানসিকতা তুলে ধরার চেষ্টা করেন।

এ পাতায় কামরুজ্জামান কামরুজ্জামান বা ওসমান গনিসহ যাদের ছবি ব্যবহার করা হয়, তারা পাতার অ্যাডমিনদের পরিচিত ব্যক্তি। তাদের অনুমতি নিয়েই এসব ছবি ব্যবহার করা হয়। তবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই ব্যবহার করে এসব ছবিতে পরিবর্তন করা হয়। ফলে বাস্তবের সেই ব্যক্তির সাথে পুরোপুরি মেলানো যাবে না।

সুইজারল্যান্ড প্রবাসী পাতাটি শুরু হয়েছিল যুক্তরাজ্যের একটি বাসায়। তারা স্বামী-স্ত্রী সারাদিন কাজ শেষে ঘরে ফিরে নানা বিষয় নিয়ে গল্প করতেন। সেসব গল্প থেকেই প্রথম তাদের পাতাটির কনটেন্ট তৈরি শুরু হয়।

সুইজারল্যান্ড প্রবাসী পাতার মূল অ্যাডমিন বসবাস করেন যুক্তরাজ্যে। তবে তার দলের আরো একজন রয়েছেন যুক্তরাজ্যে, দুইজন বাস করেন যুক্তরাষ্ট্রে ও একজন সুইডেনে। তারা অনলাইনে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে কনটেন্ট ঠিক করেন, মডারেট করেন বা পাতাটি পরিচালনা করেন। আরো কয়েকজন মডারেটর রয়েছেন যারা পাতাটি পরিচালনায় সহায়তা করে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশিরা তো বিশ্বের অনেক দেশেই বসবাস করেন। তাহলে এই পাতাটির নাম যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা বা যুক্তরাজ্য প্রবাসী না হয়ে সুইজারল্যান্ড প্রবাসী কেন হলো?

এর পেছনে তিনি নিজের জীবনের একটি অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘কয়েক বছর আগে আমি ও কয়েকজন বন্ধু মিলে সুইজারল্যান্ড বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেই সময় সেখানকার কিছু বাজে অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। আমার সেই পোস্টে এসে অসংখ্য মানুষ, অ্যাকচুয়াল সুইজারল্যান্ড প্রবাসীরা দলবেধে এসে আমাকে গালাগাল করতে থাকে যে, আপনি সুইজারল্যান্ডে আসার যোগ্য না। সব কিছু দামী জানার পরেও কেন এসেছেন, ব্যাকপ্যাকারদের জন্য সুইজারল্যান্ড না। তখন আমাদের মনে হলো, এই মানুষগুলোকে আমরা মিউজিয়ামে রাখি। নিছক মজা করার জন্য পেজটা করা, কিন্তু সেটা যে মানুষের মনে এতটা জায়গা করে নেবে, সেটা বুঝতে পারিনি।’

যুক্তরাজ্যে যাওয়ার আগে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন সুইজারল্যান্ড প্রবাসী পাতার মূল উদ্যোক্তা। বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন সেলিব্রেটির ফেসবুক পাতা তারা পরিচালনা করেছেন। এর আগেও আরো কয়েকটি জনপ্রিয় ফেসবুক পাতা তারা তৈরি করেছিলেন, যদিও সেগুলোর নাম প্রকাশ করতে চাননি। বর্তমানে এই পাতার জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বিদেশি দূতাবাসও তাদের বিশেষ ঘোষণায় কামরুজ্জামান কামরুজ্জামানের ছবি ব্যবহার করেছে।

এ পাতার কনটেন্ট তৈরি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সপ্তাহের একটা নির্দিষ্ট দিনে বসে আমরা আলাপ আলোচনা করি, কী পোস্ট করবো, দেশে কি ঘটছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে পোস্ট ঠিক করি।

সুইজার‍ল্যান্ড প্রবাসী পাতায় দেখা যায়, প্রবাসী বাংলাদেশি হলেও বাংলাদেশিদের নিয়ে, বাংলাদেশ নিয়ে চরিত্রগুলোর মধ্যে একটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য থাকে। ওসমান গনির মতো চরিত্রগুলো সুইজারল্যান্ডকেই মাতৃভূমি বলে মনে করে।

‘এটা আমরা দেখছি, দেখতে দেখতে এত অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কারণ এখানে যারা আসেন, যারা থাকেন, সবাই দেশের বদনাম করতে থাকেন। যারা দীর্ঘদিন ধরে এদেশে থাকেন, তারা তো দেশকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা ছাড়া, দেশকে নিয়ে বাজে কথা বলা ছাড়া কিছুই শুনিনা আমরা। যারা আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে আবেদন করেন, তারা দেশকে নিয়ে সবসময়ে বাজে কথা বলেন। সবাই না, কিন্তু অনেকে এভাবে চিন্তা করেন।’

তিনি বলেন, ‘অনেকে মনে করতে পারে, এসব পোস্টের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশিদের ছোট করি। আসলে কিন্তু তা নয়। বরং যে বাংলাদেশিরা অন্য বাংলাদেশিদের ছোট করে, দেশকে ছোট করে, তাদের চেহারা তুলে ধরি।’

প্রসঙ্গত, সুইজারল্যান্ড প্রবাসী পাতার এই উদ্যোক্তা নিজে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত অন্য একটি চাকরি করেন। আরো যারা পাতার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন, তাদের কেউ চাকরি করেন, কেউ পিএইচডি করছেন, কেউ হোমমেকার। তাদের নিজেদের কাজের পাশাপাশি সবাই এই পাতার পেছনে সময় দেন।