পাকিস্তান-আফগানিস্তানের সংঘাতের কেন্দ্রে ডুরান্ড লাইন, এটি নিয়ে বিতর্ক কেন?

বড় ধরনের সংঘাতে জড়িয়েছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান
বড় ধরনের সংঘাতে জড়িয়েছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান © বিবিসি বাংলা

‘এই প্রথমবার একটি স্পষ্ট সীমান্ত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যাতে ভবিষ্যতে কোনো ভুল বোঝাবুঝি না হয় এবং ব্রিটিশ অস্ত্রসস্ত্রের সাহায্যে আফগানিস্তান আরও শক্তিশালী ও মজবুত হয়ে ওঠে’, ডুরান্ড লাইন প্রসঙ্গে প্রায় ১৩২ বছর আগে কথাগুলো বলেছিলেন আফগানিস্তানের তৎকালীন আমির আব্দুর রহমান খান।

সময়টি ছিল ১৮৯৩ সালের ১৩ নভেম্বর। ব্রিটিশদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ডুরান্ড লাইন চুক্তির প্রশংসা করে যখন তিনি এ মন্তব্য করেছিলেন, সে সময় আফগান প্রভাবের বাইরে থাকা একটি বিশাল অঞ্চলের সার্বভৌমত্বের অধিকারও কিন্তু তিনি ত্যাগ করছিলেন। এ অঞ্চলটি এখন পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া এবং বালুচিস্তান প্রদেশের অংশ।

পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিকতম সংঘাতের আবহে আরো একবার শিরোনামে উঠে এসেছে সেই ডুরান্ড লাইন, যাকে কেন্দ্র করে বিতর্কও দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সংঘাতের মাঝে থাকা ডুরান্ড লাইন কী, কেন এ নিয়ে বিতর্ক?

আফগানিস্তান বেশ কিছু সময় ধরেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাদের সীমান্ত ও আকাশসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ করে আসছে। এ প্রসঙ্গে পাকিস্তান কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা নিশ্চিত করলেও এখনো অনেক বিষয়ই অস্বীকার করেছে।

অন্যদিকে, পাকিস্তান আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের কাছে নিষিদ্ধ তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান যখন কাবুলে হামলা চালায় সেই সময় তারা দাবি করে এই অভিযানের নিশানায় ছিল টিটিপি। আফগানিস্তানও পাল্টা জবাব দেয়। ডুরান্ড লাইনের কাছে থাকা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকেও নিশানা করে আফগানিস্তান।

এ সংঘাত সমাধানের উদ্দেশ্যে দোহায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান-আফগানিস্তান বৈঠকে ডুরান্ড লাইনকে ‘কাল্পনিক’ বলে আখ্যা দেন আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালেবান সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোল্লা ইয়াকুব। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, এ সীমান্ত আফগানিস্তান কোনোদিন মেনে নেয়নি এবং এ বিষয়ে কী করণীয়, তা নির্ধারণ করবে আফগানরাই।

এই বিতর্কিত মন্তব্য নিয়ে বিস্তর আলোচনাও হচ্ছে। আফগানিস্তানের আপত্তির কারণে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠনের পর থেকে ডুরান্ড লাইন আফগান ও পাকিস্তানিদের মধ্যে সংঘাতের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও ডুরান্ড লাইন চুক্তি হওয়ার পরে স্বাক্ষরিত বেশ কয়েকটি চুক্তিতেও কিন্তু অনেক আফগান শাসকই এই বিষয়ে অনুমোদন দিয়েছিলেন।

আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিকতম সংঘর্ষের আবহে প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক, ডুরান্ড লাইন কী? এই চুক্তি স্বাক্ষরের নেপথ্যে কী ছিল এবং কেন স্বাক্ষরের পর ১৩২ বছর কেটে গেলেও এই নিয়ে বিতর্ক থামেনি।

ডুরান্ড লাইন কী?
এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৮৯৩ সালে। ব্রিটিশ সরকার তৎকালীন ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ মজবুত করার জন্য আফগানিস্তানের সঙ্গে প্রায় ২৬০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করে। ডুরান্ড লাইনের নামকরণ করা হয়েছিল ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের পররাষ্ট্র সচিব স্যার হেনরি মর্টিমার ডুরান্ডের নামের অনুকরণে। আফগানিস্তানের আমির আব্দুর রহমান খানের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন: ইসরায়েলি পার্লামেন্টে পশ্চিম তীরকে সংযুক্ত করার বিল পাস

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
ডুরান্ড লাইনের পশ্চিম প্রান্তটি ইরান সীমান্তের সঙ্গে গিয়ে মেশে এবং পূর্ব প্রান্তটি চীন সীমান্তের সঙ্গে মিলিত হয়। এর একদিকে আফগানিস্তানের ১২টি প্রদেশ রয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তান খাইবার পাখতুনখোয়া, বালুচিস্তান এবং গিলগিত-বালতিস্তান।

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বলছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে, মধ্য এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য ব্রিটিশ ও রাশিয়ানদের লড়াইয়ের মাঝে একটি মোহরানায় পরিণত হয় আফগানিস্তান। এটি ‘গ্রেট গেম’ নামে পরিচিত। রাশিয়ার দক্ষিণমুখী আগ্রাসনকে থামাতে, ১৮৩৯ সালে ব্রিটেন আফগানিস্তান আক্রমণ করে।

১৮৪৯ সালে ব্রিটিশরা পাঞ্জাব দখল করে এবং সিন্ধু নদীর পশ্চিমে অবস্থিত অসংজ্ঞায়িত শিখ সীমান্ত নিজেদের সঙ্গে জুড়ে নেয়। এ অঞ্চলে বিভিন্ন পশতুন উপজাতি বাস করত, যার প্রশাসন এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্রিটিশদের জন্য সমস্যা তৈরি করছিল। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কিন্তু দুই দলে গ্রুপে বিভক্ত ছিল। স্ট্যাটিক স্কুল নামক পক্ষ ছিল সিন্ধু নদীর দিকে ফিরে আসার সমর্থনে এবং অন্যদল, অর্থাৎ ফরোয়ার্ড স্কুল কাবুল, গজনী এবং কান্দাহারের দিকে অগ্রসর হতে চেয়েছিল, বলছে ব্রিটানিকার তথ্য।

ব্রিটানিকার গবেষণা অনুযায়ী, ১৮৭৮ সালের ওই যুদ্ধে ব্রিটিশরা জয় লাভ করে এবং আব্দুর রহমান খানকে নতুন আমির হিসেবে নিয়োগ করা হয়। আব্দুর রহমান খান ১৮৮০ সালে গন্দমাকের চুক্তির অনুমোদন করেন যা ১৮৭৯ সালে তার পূর্বসূরি ইয়াকুব খান স্বাক্ষর করেছিলেন।

এই চুক্তির অধীনে, আফগানিস্তানের বৈদেশিক নীতি ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তবে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার গ্যারান্টি দিয়েছিল ব্রিটিশরা। পরে তারা সেখান থেকে সৈন্যও প্রত্যাহার করে নেয়। ১৮৯৩ সালে, ব্রিটিশ সরকারের পররাষ্ট্র সচিব স্যার হেনরি মর্টিমার ডুরান্ড এবং আফগানিস্তানের আব্দুর রহমান খানের মধ্যে আলোচনার ফলে ডুরান্ড চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা আফগানিস্তান এবং ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের মধ্যে সীমানাকে সংজ্ঞায়িত করে।'

গবেষণায় আরো অনেক খুঁটিনাটি বিষয়েও উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এই চুক্তি মাত্র এক পৃষ্ঠা দীর্ঘ ছিল। জানা যায়, ১৮৯৪ সাল থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত চলা আফগান-ব্রিটিশ যৌথ জরিপের পর নির্ধারণ করা হয়েছিল ওই সীমান্ত।

পর্দার আড়ালে থাকা ঘটনা
ব্রিটিশ রাজকর্মচারী ওলাফ কারো তার বই ‘দ্য পাঠান’-এ আমির আব্দুর রহমান খান সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘নিচের উদ্ধৃতিটি আমির আব্দুর রহমান খানের দ্বিধাগ্রস্ত কিন্তু বাস্তববাদী মনের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ–– স্যার মর্টিমার ডুরান্ড একজন মহান রাষ্ট্রনায়ক এবং ফার্সি ভাষার পণ্ডিত ছিলেন, তাই কথোপকথন মসৃণ ছিল।’

‘প্রতিটি আলোচনার সম্পূর্ণ রেকর্ড রাখার জন্য, আমি আমার মীর মুন্সী সুলতান মোহাম্মদ খানকে একটি পর্দার আড়ালে বসানোর ব্যবস্থা করেছিলাম, যাতে কেউ তাকে দেখতে না পায় এবং আমি ছাড়া তার উপস্থিতি সম্পর্কে জানতে না পারে।’ 

তার কী কাজ ছিল সে বিষয়েও ব্যাখ্যা করেছেন কারো। তিনি লিখেছেন, তার কাজ ছিল স্যার মর্টিমার ডুরান্ড, আমার এবং প্রতিনিধি দলের অন্যান্য সদস্যদের সমস্ত কথোপকথন তা সে ইংরেজিতে হোক বা ফার্সিতে, সংক্ষিপ্তভাবে নোট করা। এই সমস্ত রেকর্ড আজও আমার অফিসের আর্কাইভে রয়েছে।

কথোপকথনের সারমর্ম ছিল সীমানা নির্ধারণের বিষয়ে তারা একমত হন। বলা হয়, সীমানা হবে চিত্রাল এবং ব্রোগিল পাস থেকে পেশোয়ার এবং সেখান থেকে কোহ-এ-মালিক সিয়া (যেখানে ইরান, আফগানিস্তান এবং বেলুচিস্তানের সীমানা মিলিত হয়) নিয়ে। সেখানে আব্দুর রহমান খানের মতামতও নথিভুক্ত করা হয়েছিল।

তিনি বলেছিলেন, ‘চুক্তি অনুসারে, ওয়াখান, কাফিরিস্তান, আসমার, লালপোরার মোহমান্দ এবং ওয়াজিরিস্তানের (বিরামল) একটি অংশ আমার সাম্রাজ্যের সঙ্গে জুড়ে যায়। আমি নয়া চমনের চাঘি রেলওয়ে স্টেশন, ওয়াজিরি অঞ্চলের বাকি অংশ, বুলন্দখেল, কুররাম, আফ্রিদি, বাজৌর, সোয়াত, বুনের, দির, চিলাস এবং চিত্রালের ওপর থেকে আমার অধিকার ত্যাগ করেছি’।

কারোর লেখায় আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এসব সীমান্ত ইস্যু নিয়ে যে ভুল বোঝাবুঝি ও বিরোধ তৈরি হচ্ছিল, তা সমাধান করা হয়েছে এবং দুই সরকারের কমিশনাররা চুক্তি অনুযায়ী সীমান্ত নির্ধারণ সম্পন্ন করেছেন। শান্তি ও সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে- যা চিরস্থায়ী হওয়ার জন্য আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি।’

এরপর ওলাফ কারোর লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘পাঠকদের কোনো সন্দেহ নেই যে, আমির (আব্দুর রহমান) এই চুক্তিতে সন্তুষ্ট ছিলেন। আমির ডুরান্ডের ফার্সি ভাষার দক্ষতায় সন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং আপাতত সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল।’ তবে ডুরান্ড চুক্তিতে ডুরান্ড লাইনকে সীমান্ত হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে কারো লিখেছেন, ‘এটি সত্যি যে চুক্তিতে এই রেখাকে ভারতের (তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত) সীমানা হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। বরং আমিরের (আবদুর রহমান) ক্ষমতার সীমানার পরিধি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল এই সীমার বাইরে কোনোপক্ষের প্রভাবই থাকবে না’।

এর কারণ ছিল ব্রিটিশ সরকার উপজাতী অধ্যুষিত এলাকাগুলোকে তার প্রশাসনিক ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করতে চায়নি বরং এই রেখার পূর্ব ও দক্ষিণ অঞ্চল আমিরের কর্তৃত্বের বাইরে রাখতে চাওয়া হয়েছিল। লেখায় আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, আন্তর্জাতিকভাবে এর কোনো মর্যাদা ছিল না, কারণ এই সীমানার বাইরে আমির কিন্তু তার সার্বভৌমত্ব ত্যাগ করেছিলেন।

তিন দশক আগে হারানো অঞ্চল
পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইজাজ হায়দারের ডন পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলেছেন, অনেক আফগান লেখক এবং রাজনীতিবিদ বলেছেন যে, ডুরান্ড চুক্তির ফলে আফগানিস্তান সিন্ধু নদী এবং ডুরান্ড লাইনের মধ্যবর্তী বেশিরভাগ অঞ্চল হারিয়েছে। কিন্তু বাস্তব হলো চুক্তির তিন দশক আগেই এ অঞ্চলগুলো তাদের ক্ষমতা থেকে চলে গিয়েছিল, হারিয়ে গিয়েছিল।

আফগান গবেষক অরুণ রাহির মন্তব্য উল্লেখ করে হায়দার লিখেছেন, এটি কিন্তু প্রথমবার নয়। প্রকৃতপক্ষে, আফগানরা ডুরান্ড চুক্তির মাধ্যমে শেষবারের মতো ব্রিটেনের কাছে কিছু অঞ্চল হস্তান্তর করে।
ব্রিটানিকার তথ্য অনুযায়ী, এই চুক্তির অধীনে বালুচিস্তানকে ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং ওয়াখান করিডোরের সীমানাও নির্ধারণ করা হয়। চীনা সীমান্তের দিকে যাওয়ার এই সংকীর্ণ স্ট্রিপ রাশিয়া এবং ব্রিটেনের মধ্যে একটি 'বাফার জোন' হিসেবে কাজ করেছিল।

রাওয়ালপিন্ডি চুক্তি এবং অফিসিয়াল সীমান্ত
১৯০১ সালে আমির আব্দুর রহমানের মৃত্যুর পরে, ব্রিটেন এবং আফগানিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে। ১৯১৯ সালে, তার উত্তরসূরি হাবিবুল্লাহ খানকে হত্যা করা হয়েছিল। তিনি ব্রিটিশদের সমর্থক ছিলেন। এরপরই ক্ষমতায় আসেন আমানুল্লাহ খান, যিনি ব্রিটিশবিরোধী ছিলেন এবং শিগগিরই তৃতীয় অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে ১৯১৯ সালে রাওয়ালপিন্ডি চুক্তির মাধ্যমে, যার ফলস্বরূপ আফগানিস্তান তার বৈদেশিক নীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায় এবং ডুরান্ড লাইনকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে লাগোয়া একটি সরকারি সীমান্ত হিসেবে স্বীকৃতিও দেওয়া হয়।

কেমব্রিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সৈয়দ আতিফ রজার গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, এই চুক্তিটি আফগানদের জন্য একটি উদযাপনের বিষয় ছিল। আমানউল্লাহ খান ব্রিটিশদের ধন্যবাদ জানিয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন এবং ১৯শে অগাস্ট, ১৯১৯ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, যা পরে আফগানিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে পরিণত হয়।

‘আফগান প্রতিনিধি দল চুক্তিতে 'আফগান সরকার' শব্দটির ওপর জোর দিয়েছিল যাতে চুক্তিটি কেবল আমির নয়, দু'পক্ষের সরকারের মধ্যে হয়। এই একই চুক্তিতে আমানউল্লাহকে সম্রাটের উপাধি দেওয়া হয়। তৃতীয় আফগান যুদ্ধ আসলে ব্রিটিশ প্রভাব থেকে সে দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ ছিল। এর কারণ কিন্তু সীমান্ত বিরোধ ছিল না। 

রাওয়ালপিন্ডি চুক্তিতে ডুরান্ড লাইনসহ পূর্ববর্তী সব সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন করা হয়েছে। পরবর্তীকালে, ১৯২১ সালের কাবুল চুক্তিতে, দুই পক্ষ এই সীমানা পুনর্ব্যক্ত করে এবং আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে।

কখন বিতর্কিত হয়ে ওঠে এই চুক্তি?
সৈয়দ আতিফ রজা লিখেছেন, ‘১৯৪৭ সালে বিভাজনের পরে, নবগঠিত পাকিস্তান ডুরান্ড চুক্তি পেয়েছিল উত্তরাধিকার সূত্রে। তবে পশতুনস্তান নামে এক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সীমান্তের দুই দিকেই আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান যখন জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য আবেদন করে, তখন আফগানিস্তান একমাত্র দেশ ছিল যা এর বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। আফগানিস্তান ডুরান্ড লাইনকে মানতে অস্বীকার করে বিষয়টিকে ‘ব্রিটিশদের চাপের ফল’ বলে অভিহিত করে ‘নাল অ্যান্ড ভয়েড’ বা বাতিল বলে আখ্যা দেয়। 

আব্দুর রহমান খান চাপের মুখে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন বলে আফগানদের তোলা আপত্তির জবাবে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ও আইনজীবী বিজান উমরানি লিখেছেন যে, আলোচনা এক মাস ধরে চলেছিল এবং স্যার মর্টিমার ডুরান্ড এবং ভারত সরকারের মধ্যে আদান প্রধান করা চিঠিপত্র থেকে দেখা যায় যে, আলোচনা প্রকৃতপক্ষে চলেছিল। ব্রিটিশ সরকার আফগানিস্তান সরকারের নির্দেশে কিছু অঞ্চলকে আফগান ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করতে সম্মত হয়, যদিও এর আগে সেগুলি ভারতের (ব্রিটিশ-শাসিত) দিকে রাখার (অন্তর্ভুক্ত করার) বিষয়ে পক্ষে ছিলেন তারা।

ইফতিখার আহমদ ইউসুফজাই এবং হিমায়েত উল্লাহ ইয়াকুবি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জার্নাল অফ রিসার্চ সোসাইটি’র গবেষণাপত্র ‘ডুরান্ড লাইন: ইটস হিস্টোরিক্যাল, লিগ্যাল অ্যান্ড পলিটিক্যাল স্ট্যাটাস’-এ জানিয়েছেন যে, আমির আব্দুর রহমান খান এ চুক্তি অনুমোদনের জন্য দুররানি দরবার এবং লোয়া জিরগাকেও আহ্বান জানিয়েছিলেন। এ থেকে বোঝা যায় যে, আমির তার সভাসদরা এবং উপজাতি প্রধানরা এ চুক্তিতে সন্তুষ্ট ছিলেন।

পরবর্তীকালে আফগানিস্তানের বিভিন্ন সরকার (আমানউল্লাহ খান, হাবিবুল্লাহ খান, শাহ মোহাম্মদ নাদির খানসহ অন্যান্যরা) এ চুক্তি মেনে চলেন। এদিকে রাওয়ালপিন্ডি চুক্তি (১৯১৯ সালে স্বাক্ষরিত), কাবুল চুক্তি (১৯২১ সালে), বাণিজ্য চুক্তি (১৯২৩ সালে) এবং ১৯৩০ সালে ডুরান্ড লাইনও দুই দেশের মধ্যে আন্তর্জাতিক সীমানা হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল।

দুজনের গবেষণা অনুসারে, ১৯২০ সালের পরে আফগানিস্তান স্বাধীন ছিল, তারা যদিও ওই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করতে পারত, কিন্তু তা তারা করেনি। ইফতিখার আহমদ ইউসুফজাই এবং হিমায়েত উল্লাহ ইয়াকুবি গবেষণা অনুসারে, ভারত ও পাকিস্তানের বিভাজনের পর পাকিস্তান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অস্তিত্ব লাভ করে।

‘সমস্যা দেখা দেয় যখন ব্রিটেন ভারত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘোষণা করে। আফগান সরকার দাবি করে, ১৮৯৩ সালের ডুরান্ড চুক্তির অধীনে ব্রিটেনের কাছে হস্তান্তর করা অঞ্চলগুলো এবার তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হোক। ব্রিটিশ সরকার তা মানতে চায়নি। তাদের যুক্তি ছিল এই অঞ্চলগুলো ব্রিটিশশাসিত ভারতের অংশ ছিল এবং নতুন ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় তা উত্তরাধিকার সূত্রে হস্তান্তর হবে। পাকিস্তান সৃষ্টির পরও সেই নীতিই মানা হয়।

১৯৫০ সালের ৩০ জুন, ব্রিটিশ কমনওয়েলথ সেক্রেটারি নোয়েল বেকার হাউস অফ কমন্সে বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে, আগের ব্রিটিশ শাসিত ভারত এবং ব্রিটিশ সরকারের সমস্ত অধিকার ও দায়িত্বের উত্তরাধিকারী পাকিস্তান এবং ডুরান্ড লাইন আন্তর্জাতিক সীমান্ত।

আরও পড়ুন: নিরাপদ সমুদ্র পর্যটনে জরুরি সতর্কবার্তা, মানতে হবে ১২ নির্দেশনা

আইন বিশেষজ্ঞ আহমের বিলাল সুফির মতে, ভিয়েনা কনভেনশন (অনুচ্ছেদ ৬২) এর অধীনে, যখন একটি নতুন দেশ ঔপনিবেশিক অঞ্চল থেকে বেরিয়ে এসে তৈরি হয়, তখন পূর্ববর্তী সমস্ত চুক্তি এবং বাধ্যবাধকতা নতুন সরকারের কাছে স্থানান্তরিত হয়। অতএব, পাকিস্তান স্বাধীনতার পরে বৈধভাবে ডুরান্ড চুক্তির ধারাবাহিকতা অর্জন করে।

অন্যান্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও এ নীতির একই ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যেমন বুরকিনা ফাসো বনাম মালি এবং লিবিয়া বনাম চাদ মামলা, যেখানে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত জানিয়েছে চুক্তিটি বাতিল হয়ে গেলেও ওই চুক্তির অধীনে নির্ধারিত সীমানাগুলি স্থায়ী। তবে আফগানিস্তান কিন্তু পাকিস্তানকে উত্তরসূরি হিসেবে সেই স্বীকৃতি দেয় না এবং সেটিকে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করে।

এ চুক্তি ১০০ বছরের জন্য ছিল?
ইউসুফজাই এবং ইয়াকুবির গবেষণা থেকে জানা যায়, আফগান নাগরিকদের মধ্যে একটি ভুল ধারণা রয়েছে এবং তা হলো যে, ডুরান্ড চুক্তি কেবলমাত্র ১০০ বছরের জন্য ছিল এবং ১৯৯৩ সালে তার মেয়াদ শেষ হয়। কোনো চুক্তি বা নথিতে এ ধরনের কোনো সময়সীমা কিন্তু উল্লেখ করা হয়নি।

আহমের বিলাল সুফিও এ প্রসঙ্গে তার মত জানিয়েছেন। তার কথায়, ডুরান্ড চুক্তি বা সে অর্থে ১৯১৯ এবং ১৯২১ সালের পরবর্তী সময়ের চুক্তিগুলো কিন্তু কোনো সময়সীমা নির্দিষ্ট করে না। ১০০ বছরের মেয়াদ সংক্রান্ত এ ধারণা শুধুই জল্পনা-কল্পনা।

প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি দেশের আচরণ কী হবে এবং সেই প্রেক্ষিতে অন্য দেশের আচরণ আইনি মানদণ্ডে পরিণত হয়। আফগানিস্তান যদি তার বাকি সীমান্তকে (রাশিয়া, চীন এবং ইরান) স্বীকৃতি দেয়, তাহলে তাদের পাকিস্তানের সঙ্গে থাকা ডুরান্ড লাইনকেও স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। কারণ এই সীমান্ত নিয়ে পরামর্শ করার সুযোগও কিন্তু ছিল না।
আর যদি এই চুক্তি খারিজ হয় তাহলে?

এ বিশেষজ্ঞের মতে, যদি ব্রিটেনের (ভারত থেকে) ক্ষমতা প্রত্যাহারের মাধ্যমে ডুরান্ড চুক্তি বাতিল হয়ে যেত, তাহলে সেই যুক্তিতে রাশিয়া ভেঙে গেলে আফগানিস্তানকেও তাজিক, উজবেক ও তুর্কমেন অঞ্চলের কাছে ফিরে যেতে হতো, কিন্তু তা তারা করতো না।

১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল আফগানিস্তান। সে সময় তারা যুক্তি দেয় যে, পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত নয় যতক্ষণ না সেখানকার পশতুনরা নিজেদের স্বাধীন বলার অধিকার বা পৃথক মর্যাদার বিষয়ে ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়। সে বছরের অক্টোবর মাসে, আফগানিস্তান এই নেতিবাচক ভোট প্রত্যাহার করে নেয় এবং পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন হয়।

এজাজ হায়দার তার নিবন্ধে লিখেছেন, ১৯৬৩ সালের মে মাসের তেহরান চুক্তির পর, দুই দেশের মধ্যে একটি অস্থায়ী সমঝোতা হয়েছিল। এর আগে আফগানিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সর্দার মোহাম্মদ দাউদ ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বরে বাজাউরে সৈন্য পাঠান, যার ফলে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। আফগান বাহিনীকে সরিয়ে নিতে পাকিস্তান ও স্থানীয় উপজাতিদের এক বছর সময় লেগেছিল।

তিনি বলেন, ‘দাউদ ডুরান্ড লাইনের প্রবল বিরোধী ছিলেন এবং পশতুনস্তানের সমর্থক ছিলেন। পাকিস্তান কাবুলকে চ্যালেঞ্জ জানায় যে সেখানকার পশতুনরা আফগানিস্তানে থাকতে চায় বা পাকিস্তানে যোগ দিতে চায় কি না তা খতিয়ে দেখার জন্য’।
যখন সমাধান খুব দূরে ছিল না

হায়দার লিখেছেন, ‘দাউদ ১৯৭৩ সালে জহির শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং আফগানিস্তান প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি আবার পশতুনস্তানের জন্য প্রচার শুরু করেন এবং পাকিস্তানে পশতুন ও বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থনও করেছিলেন। তার কট্টরপন্থী নীতির কারণে গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার, আবদুল রব রসুল সাইয়াফ, বুরহানউদ্দিন রব্বানী এবং আহমদ শাহ মাসুদসহ অনেক ধর্মীয় নেতা পাকিস্তান থেকে পালিয়ে যান।

আরও পড়ুন: রাশিয়ার শীর্ষ দুই তেল কোম্পানির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিষেধাজ্ঞা

এরপর পাকিস্তানও পাল্টা কৌশল অবলম্বন করে। বার্নেট রুবিন লিখেছেন, ১৯৭৫ সালে পাকিস্তান গোপনে আফগান ইসলামপন্থিদের একটি বিদ্রোহ সংগঠিত করেছিল যাতে দাউদকে পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত আলোচনায় বসার জন্য চাপ দেওয়া যায়।

হায়দারের মতে, সর্দার মোহাম্মদ দাউদ সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করতে থাকেন এবং যুক্তরাষ্ট্র, ইরান, মিশর, সৌদি আরব ও পাকিস্তানের কাছাকাছি যেতে শুরু করে। রুবিন, দিয়েগো কার্ডোভেজ এবং সেলিগ হ্যারিসনের মতো বিভিন্ন লেখক উল্লেখ করেছেন যে ডুরান্ড লাইনের সমস্যা সমাধান করতে ইচ্ছুক ছিলেন দাউদ।

লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৭৬ সালের জুন মাসে ভুট্টো কাবুলে যান এবং আগস্টে দাউদ ইসলামাবাদে আসেন। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ভুট্টো যদি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির গ্রেফতার হওয়া নেতাদের মুক্তি দেন তবে তিনি ডুরান্ড লাইনকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারেন।

পরবর্তীকালে, জেনারেল জিয়া-উল-হক ভুট্টোর বরখাস্তের পরেও একই নীতি অব্যাহত রেখেছিলেন এবং ১৯৭৭ সালের অক্টোবরে কাবুলে চলে যান। ১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে দাউদ আবার পরিদর্শনে আসেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ডুরান্ড লাইন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে কি না। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন সবকিছু নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুর নিষ্পত্তি হবে।

পরিস্থিতির বদল হয়। লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু ১৯৭৮ সালের ২৭ এপ্রিল, দাউদ এবং তার পরিবার কমিউনিস্ট অফিসারদের দ্বারা পরিচালিত অভ্যুত্থানে নিহত হন এবং পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান (পিডিপিএ) ক্ষমতা গ্রহণ করে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর আফগানিস্তান আক্রমণ করে। ১০ বছর পর সোভিয়েত সেখান থেকে সরে আসে। তবে এ অঞ্চলের জন্য এমন এক নতুন যুগ শুরু হয়েছিল, যা ছিল সমস্যার ভরা। এভাবে পাকিস্তানের মূল লক্ষ্য, কাবুলের ডুরান্ড লাইনকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, দাউদের সঙ্গে সঙ্গেই সমাপ্ত হয়ে যায়।

খবর: বিবিসি বাংলা।