‘ভাগ্যবান’ ববি হাজ্জাজ: অস্বস্তিতে বিএনপির আন্দোলনের শরিকরা
- ২০ অক্টোবর ২০২৫, ২০:২২
ববি হাজ্জাজ। রাজনৈতিক দল জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক সংক্ষেপে এনডিএমের চেয়ারম্যান। রাজনৈতিক দল হিসেবে এনডিএমের বয়স আগামী বছরের ২৪ এপ্রিল নয় বছরে পা দেবে। ববি হাজ্জাজের নেতৃত্বে ২০১৭ সালের ২৪শে এপ্রিল দলটি আত্মপ্রকাশ করে। ইতোমধ্যে দলটি নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন লাভ করেছে। যার ক্রমিক নম্বর হচ্ছে ৪৩ এবং প্রতীক সিংহ।
এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজকে এই মুহূর্তে দেশীয় রাজনীতিতে সবচেয়ে সৌভাগ্যবান হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে-দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির রাজনীতি না করেও দেশের তিনশ সংসদীয় আসনে প্রথম ধানের শীষ প্রতীকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন ও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। শুধু এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজই নয়, দলটির মহাসচিব মো. মমিনুল আমিন রাজবাড়ি-২ আসন থেকে জোটের প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
গেল ১৫ অক্টোবর রাজধানীতে বিএনপি আয়োজিত পরিচিতি সভায় দলের ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমিনুল হক তার নাম ঘোষণা করেন। এসময় জোটের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে তাকে সহযোগিতা করতে বিএনপির নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান বিএনপির এই নেতা। পরিচিতি সভায় বলা হয়, বিএনপি ও তার মিত্র রাজনৈতিক জোট সরকারের দমননীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনমুখী আন্দোলন চালিয়ে যাবে। ঢাকা-১৩ আসনে ববি হাজ্জাজের প্রার্থিতা সেই ঐক্যের প্রতীক এবং পরিবর্তনের পথে একটি নতুন বার্তা।
বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নিজের নির্বাচনী এলাকা ঢাকা-১৩ আসনে নির্বাচনী কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন জানিয়ে এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা আমাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করেছে। সবাই ঐক্যবদ্ধ আছে। নির্বাচনে বিজয়ের বিষয়ে আমি আত্মবিশ্বাসী।
ঢাকা-১৩ আসনটি জাতীয় সংসদের ৩০০ নির্বাচনী এলাকার একটি। এটি রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত জাতীয় সংসদের ১৮৬নং আসন। এ আসন আগে ছিল ঢাকা-৯ আসনের অন্তর্ভুক্ত। ঢাকা-১৩ আসনটি রাজধানী ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪ নং ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত।
ওই নির্বাচনী এলাকায় এর আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রতিনিধিত্ব করেছেন দলটির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। এছাড়া ওই আসন থেকে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে দীর্ঘদিন গণসংযোগ করে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন ভাইস চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম ও আরেক ভাইস চেয়ারম্যান আতাউর রহমান ঢালী। দলের এমন হেভিওয়েট নেতাদের প্রার্থী না করে অপেক্ষাকৃত নবীন দলের নেতাকে আসন ছেড়ে দেয়ায় নেতাকর্মীদের মধ্যেও গুঞ্জন শুরু হয়েছে। আর বিএনপির দীর্ঘদিনের যুগপৎ আন্দোলন সঙ্গী শরিক দলগুলোর নেতাদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে অস্বস্তি।
মনোনয়নের আশায় আছেন এমন কয়েকজন জোট নেতা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেছেন, ববি হাজ্জাজ রাজনীতিতেও আমাদের চেয়ে অনেক জুনিয়র। তারদলও অপেক্ষাকৃত নবীন। সবচেয়ে বড় কথা আমরা দীর্ঘদিন হাসিনার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনের মাঠে ছিলাম। জেল-জুলুম, নির্যাতনের পাশাপাশি ছিল নানা প্রলোভন। কিন্তু আমরা সবকিছু উপেক্ষা করে বিএনপি নেতৃত্বের আস্থার প্রতিদান দিয়েছি। অন্যদিকে, এনডিএম যুগপৎ আন্দোলনেই এসেছিল হাসিনার শাসনামলের একেবারে শেষ মুহুর্তে। কখনও কোনো হামলা-মামলাও তাদের মোকাবিলা করতে হয়নি।
সেই দলের চেয়ারম্যানকে সবার আগে যেখানে খোদ বিএনপিরও একজন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়নি, সেখানে তাকে হাত ধরে পরিচয় করিয়ে দেয়া, ধানের শীষের প্রার্থী ঘোষণা করাকে আমরা আর কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারি। এটাকে এককথায় ববি হাজ্জাজকে একজন সৌভাগ্যবান মানুষ বলেই চিহ্নিত করতে পারি। তার কপাল আর আমাদের কপালের মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য আছে।
এসব নেতারা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ববি হাজ্জাজ ‘বিতর্কিত’ মুছা বিন শমসেরের পুত্র। আর ফ্যাসিস্ট হাসিনার অন্যতম প্রধান দোসর শেখ সেলিমের জামাই। বিএনপি তাকে যতটা সম্মানিত করল, তার ছিটেফোঁটাও আমাদের মতো পরীক্ষিত শরিকদের কখনও দেখায় নাই। এটা দুঃখজনক।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বর্তমান পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সামনের নির্বাচন শুধু বিএনপির জন্য নয়, সব দল ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্যও চ্যালেঞ্জের বিষয়। নির্বাচন নিয়ে এখনও নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে, বন্ধ হয়নি। হাইকমান্ডকে সব বিষয় চিন্তা করতে হয়। নানান মেরুকরণ নিয়ে ভাবতে হয়। তাই ঢাকা-১৩ আসনে ববি হাজ্জাজকে মনোনয়ন দেয়ার বিষয়টিও হাইকমান্ডের চিন্তা-ভাবনার বিষয় বলে আমি মনে করি।
গেল বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্ত ঝড়া গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে যত দ্রুত সম্ভব দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি করে আসছে বিএনপি। দলীয়ভাবে জাতীয় নির্বাচনের তাগাদা দিয়ে আসলেও এখনও পর্যন্ত খোদ নিজেদের কোনো প্রার্থীর নাম ঘোষণা করতে পারেনি বিএনপি। কিন্তু এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজকে ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে সবার আগে ঘোষণায় হাসিনা পতন আন্দোলনে দীর্ঘদিন রাজপথের সঙ্গী জোট নেতাদের মধ্যে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে তাদের ক্ষুব্ধতাও জানিয়েছেন।
দলটি দীর্ঘদিন নানা প্রতিকূলতার মুখেও হাসিনার ফ্যাসীবাদী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করে এসেছে। আর রাজপথে বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন শরিক হিসেবে ছিল ছোট ছোট বেশ কিছু রাজনৈতিক দল। দলগুলোর মধ্যে ছিল-১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ, গণফোরামসহ আরও কিছু ছোট ছোট দল। এসব দলের অনেক নেতা হামলা-মামলা, জেল-জুলুম ও হাসিনার পুলিশতন্ত্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিএনপি জোটে থেকে হাসিনা পতনে ভূমিকা রেখেছে।
বিএনপি অনেক আগে থেকেই বলে আসছে-দেশে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনে সবদল ও জোটকে অর্ন্তভুক্ত করে নির্বাচন করবে। ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার পতনে ভূমিকা রাখা সকল জোট শরিকদের জন্য তারা সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে সবাইকে নিয়ে দেশ পুনর্গঠনে কাজ করবে। বিএনপির এ ঘোষণার পর জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা দলগুলোর নেতারা নির্বাচনে অংশ গ্রহণের স্বপ্ন দেখে আসছেন।
বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের কর্মকাণ্ড দিয়ে বিএনপির নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রমাণ করেছি। নতুন করে পরীক্ষা দেয়ার কিছু নেই। আমাকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি ও চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম আমার নির্বাচনী এলাকা লক্ষীপুর-১ (রামগঞ্জ) নির্বাচনী গণসংযোগ জোরালোভাবে করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। আমি নিরলসভাবে গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছি।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের এক প্রশ্নের জবাবে সেলিম বলেন, বিএনপি কোন আসনে কাকে মনোনয়ন দেবে তা সম্পূর্ণই তাদের এখতিয়ার। এ বিষয়ে মন্তব্য করা আমার ঠিক হবে না। তবে জোটে ববি হাজ্জাজ বা তার দল আমাদের অনেকের চেয়ে অপেক্ষাকৃত নবীন। যুগপৎ আন্দোলনেও দলটি এসেছে হাসিনাপতনের একেবারে শেষদিকেই বলা যায়। বিএনপি যেমন ববি হাজ্জাজকে কর্মসভা করে বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীর কাছে তাকে ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছে তেমনি আমাদেরও যদি ঘোষণা করত, তাহলে দলীয় কর্মীদের স্বতস্ফূর্ততা আরও বাড়ত বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, জোট প্রার্থী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও আমাকে ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। তবে, অনানুষ্ঠানিকভাবে একাধিক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা বিএনপির হাইকমান্ডের নির্দেশনা জানিয়ে দিয়েছেন। নির্দেশনা মোতাবেক আমার নির্বাচনী এলাকা কিশোরগঞ্জ-৫ (নিকলী ও বাজিতপুর উপজেলা) গণসংযোগ চালিয়ে আসছি।
এক প্রশ্নের জবাবে হুদা বলেন, বিএনপি কাকে মনোনয়ন দেবে তা নিয়ে তো আমরা প্রশ্ন তুলতে পারি না। ববি হাজ্জাজকে ঢাকা থেকে মনোনয়ন দিয়েছে, তার প্রতি শুভেচ্ছা। তবে, আমরা আশাকরি, আমাদের জোটের যেসব নেতাকে জোটগতভাবে মনোনয়ন দেবে, তা যত দ্রুত ঘোষণা করা হবে, আমাদের জন্য তা যেমন মঙ্গলজনক তেমনি অস্বস্তি দূর হবে।
এনডিএমের মহাসচিব মো. মমিনুল আমিন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, মনোনয়ন ঘোষণার পর এনডিএমের চেয়ারম্যান পূর্ণ উদ্যোমে ঢাকা-১৩ আসনে নির্বাচনী কাজ শুরু করেছেন।
তিনি আরও জানান, এনডিএমের মহাসচিব হিসেবে আমি নিজেও ফরিদপুরের রাজবাড়ি-২ আসনে জোটের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত। আমিও এলাকায় গণসংযোগে ব্যস্ত আছি।