শিক্ষার পূর্ণতা তত্ত্বে নয়, প্রয়োগে
- ২০ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০৬
সম্প্রতি প্রকাশিত হলো উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল। এবারের ফলাফলে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছিলো পাসের হার ও জিপিএ-৫ এর সংখ্যার উল্লেখযোগ্য হ্রাস। ফলাফলের ওপর মিশ্র প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সাধারণ মানুষের ইতিবাচক মনোভাবই অধিক উঠে এসেছে। কেননা অধিকাংশের ধারণা, চলতি বছরের রেজাল্টেে ফিরে এসেছে সত্যতা, যথার্থতা, নির্ভেজাল, এবং অকপটতা, যা চলমান রাখাই এবার একান্ত কাম্য।
বর্তমান ডিজিটাল শিক্ষা যুগে যেখানে মানোন্নয়ন শিক্ষা এখন হাতের মুঠোয়, সেখানে ফলাফলের এমন দুর্দশা কী আসলেই উল্লাসের বিষয় না উদ্বেগের, তা নিয়ে দ্বিতীয় ভাবনা এবার আসা উচিত। পরবর্তী প্রশ্ন আসে পরিশ্রমী, মেধাবীদের মূল্যায়ন নিয়ে- যে রাষ্ট্রীয় চলমান শিক্ষাব্যবস্থায় তারা আসলেই ঠিক কতটা সুযোগ আর সফলতা পাচ্ছে ।
বর্তমান বিশ্ব কেবল আধুনিকতা ও প্রযুক্তি নির্ভর নয় বরং প্রতিযোগিতার নির্ভরও। প্রতিযোগিতামূলক এ বিশ্বে শুধুই তাত্ত্বিক জ্ঞান পর্যাপ্ত নয়, পাশাপাশি আবশ্যক প্রয়োগীয় জ্ঞান ও চর্চা। বিশেষ করে বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়ে ব্যবহারিক জ্ঞান ছাড়া তাত্ত্বিক জ্ঞান কেবলই অসম্পূর্ণ নয় বরং অনেকাংশে মূল্যহীন। শুধু পাঠ্যপুস্তক কেন্দ্রিক নির্ভরশীলতা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম এক বড় ত্রুটি। প্রয়োগিক জ্ঞানচর্চা ছাড়া চলমান এ শিক্ষা ব্যবস্থা এখন শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের জন্য হুমকিস্বরূপ।
একাধিক গবেষণা ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষন বলছে, বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেও শিক্ষার্থীরা গড়ে আন্তর্জাতিকভাবে সপ্তম শ্রেণির সমতুল্য জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করেছে। বিষয়টি রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান নিয়ে একটি বড় প্রশ্ন তুলেছে। দেশে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষার গুনগত মানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। মুখস্থ নির্ভর শিক্ষা, গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরতা, যোগ্য শিক্ষকের অভাব এবং প্রশিক্ষণহীন পাঠদান পদ্ধতির কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশ্লেষণ ক্ষমতা, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা ও বাস্তব জ্ঞান গড়ে উঠছে না।
বিগত কয়েক যুগ ধরে পাশের হার বেশি দেখানো হয়েছে, অথচ ঢাবির ভর্তি পরীক্ষায় প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল হয়। কারণ তারা প্রাথমিকভাবে শিক্ষায় দুর্বল। দিনের পর দিন প্রয়োগিক চর্চার ব্যবস্থা না থাকার কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় এক বড় শিখন ঘাটতি তৈরি হয়। একবিংশ শতাব্দীতেও দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোয় বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়ের ওপর পর্যাপ্ত প্রয়োগ বা গবেষণামূলক চর্চার কোনো সুযোগ ও সুষ্ঠ ব্যবস্থা নেই যা সত্যিই হতাশাজনক।
এর ফলে শিক্ষার্থীদের বইয়ের গণ্ডি পেরিয়ে বাস্তবিক চিন্তা করার মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের ক্রমাগত অবক্ষয় হচ্ছে, বাড়ছে সীমিত জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীলতা। সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বা সৃজনশীলতার সূচনাই হয় এ প্রয়োগিক চর্চার মাধ্যমে। গবেষণার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় চিন্তাশীলতা, আবিষ্কার হয় উন্মোচন। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতেও এ প্রয়োগীয় শিক্ষায় খুবই সীমিত সুযোগ থাকে, যার পেছনে অপর্যাপ্ত বাজেট, প্রশাসনের দায়হীনতা, শিক্ষক ও ল্যাব সংকট সহ ক্লাসরুমের সংকীর্ণতা উল্লেখযোগ্যভাবে দায়ী।
অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত একই বিষয়ের প্রয়োগিক চর্চার প্রশিক্ষণ বিশ্বের নানান দেশে হাইস্কুল হতেই দেওয়া আরম্ভ হয়, ফলস্বরূপ, ব্যবহারিক জ্ঞানের পাশাপাশি দক্ষতা, অভিজ্ঞতায় ও আত্নবিশ্বাস অর্জনেও তাঁরা অনেক এগিয়ে থাকে। চমৎকার তাত্ত্বিক জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থার অংশ হওয়ায় মেধাবীরা ক্রমাগত ব্যর্থ হচ্ছে, হাতছাড়া করতে হচ্ছে অসংখ্য সুযোগ। দক্ষ মানবসম্পদের অভাবে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারেও এখন বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে।
আরও পড়ুন: এ মাসেই শেষ হচ্ছে আলোচনা; পে স্কেলের সুপারিশ আসবে কবে? সর্বশেষ যা জানা যাচ্ছে
ত্রুটিপূর্ণ এ ব্যবস্থা কেবল শিক্ষার্থীর জন্য নয়, রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নেও এক বড় বাধা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখনো শিক্ষাব্যবস্থায় শেখার চেয়ে নম্বর পাওয়াকেই অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে বহু শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে মৌলিক প্রশ্ন বুঝতে পারে না, কিংবা গবেষণা-ভিত্তিক শিক্ষায় টিকে থাকতে পারে না। শিক্ষাব্যবস্থা যদি বাস্তবমুখী, বিশ্লেষণভিত্তিক ও দক্ষতাভিত্তিক না হয়, তাহলে শুধু উন্নত ভবিষ্যৎ নয়, বর্তমানকেও পিছিয়ে পড়তে হবে।
প্রয়োগ ও গবেষণামূলক চর্চার পর্যাপ্ত ব্যবস্থার জন্য শিক্ষাখাতে বাজেট বৃদ্ধি ও বিনিয়োগের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, পাঠ্যক্রমে মুখস্থ নির্ভরতার পরিবর্তে বিশ্লেষণ ক্ষমতার বিষয় অন্তর্ভুক্তিকরনের মতো জোরদার পদক্ষেপ প্রয়োজন। এতে ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা সংশোধনে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে বলে শিক্ষাবিদরা ধারণা করছেন।
লেখক: শিক্ষার্থী, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও
সদস্য, জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি ফিচার, কলাম অ্যান্ড কন্টেন্ট রাইটার্স