ফোন হাতে রাখার ভঙ্গি থেকে জানুন আপনি মানসিকভাবে কেমন আছেন

ফোন হাতে রাখার ভঙ্গি
ফোন হাতে রাখার ভঙ্গি © সংগৃহীত

প্রযুক্তিনির্ভর জীবনে আজকের মানুষ সারাক্ষণ স্ক্রিনের দিকে ঝুঁকে থাকে। ফোন, ট্যাব বা ল্যাপটপে চোখ রেখে কাঁধ নুয়ে যায়, ঘাড় কাত হয়, পিঠ বাঁকা হয়ে পড়ে। এই অভ্যাস শুধু দেহে ব্যথা বা মাংসপেশির টানই সৃষ্টি করে না, বরং মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও গভীর প্রভাব ফেলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমরা কীভাবে ফোন ধরি, স্ক্রিনের দিকে তাকাই বা শরীরের ভঙ্গি বজায় রাখি, তা অনেকাংশে বলে দেয় আমাদের মানসিক অবস্থার কথা।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কায়রোপ্র্যাকটর ড. শুলম্যান বলেন, ‘যারা সবসময় ঝুঁকে বা কুঁজো হয়ে হাঁটে কিংবা বসে থাকে, তারা সাধারণত হতাশা ও দুঃখবোধে বেশি ভোগেন।’ দীর্ঘ সময় নিচের দিকে তাকিয়ে থাকা বা ফোনে মগ্ন থাকার ফলে শরীরে ভারী ভাব তৈরি হয়, এটি ধীরে ধীরে মানসিক চাপ বাড়ায়।

‘এমবডিড কগনিশন’ নামের এক ধারণা অনুযায়ী, আমাদের আবেগ শুধু মস্তিষ্কে নয়, শরীরের ভঙ্গিতেও প্রতিফলিত হয়। অ্যাপোলো হাসপাতালের ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশনের প্রধান পরামর্শক ড. নীতিন মেনন বলেন, “যখন আমরা শরীর ঝুঁকিয়ে রাখি, মস্তিষ্ক সেটিকে পরাজয় বা অসহায়তার সংকেত হিসেবে ধরে নেয়। এতে মনমরা ভাব বা হতাশা আরও বেড়ে যায়।”

তিনি আরও জানান, এভাবে দেহের মাধ্যমে তৈরি হওয়া চাপের সংকেত আমাদের বিশ্রাম নেওয়া কঠিন করে তোলে এবং উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়। ‘পোশ্চার বা দেহভঙ্গি মানসিক অসুস্থতার মূল কারণ না হলেও এটি এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। একে মানসিক সুস্থতার সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় অবহেলা করা ঠিক নয়।

আরও পড়ুন: কারও দুধে অ্যালার্জি, কারও চিংড়িতে, কেন ‘ফুড অ্যালার্জি’ পরীক্ষা করানো খুব জরুরি?

অন্যদিকে সি কে বিরলা হাসপাতালের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. শিভি কাতারিয়া জানান, ফোন ব্যবহারের সময় মানুষ নিজের মধ্যে গুটিয়ে যায়। এটি চারপাশ থেকে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। ‘ফোন হাতে নিয়ে শরীর ভাঁজ করে বসা মানে নিজের চারপাশে অদৃশ্য দেয়াল তুলে দেওয়া। এতে সামাজিক সচেতনতা ও অমৌখিক যোগাযোগ কমে যায়। এতে করে একাকিত্বের অনুভূতি বাড়ায়।

তিনি আরও বলেন, ‘ফোন ধরার ধরনও আমাদের মানসিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি। কেউ যদি ফোন শক্ত করে চেপে ধরে, ঘন ঘন চেক করে বা উদ্বিগ্নভাবে স্ক্রল করে, তা তার অন্তর্গত অস্থিরতা বা উদ্বেগের প্রতিফলন। এভাবে ফোন একদিকে উত্তেজনার উৎস, অন্যদিকে তা একধরনের মানসিক আশ্রয়েও পরিণত হয়।’

ফোর্টিস হাসপাতালের ফিজিওথেরাপি বিভাগের ইনচার্জ শালিনী আনন্দ জানান, ‘ফোনে নিচু হয়ে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় বুক চেপে যায়, ফলে শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত হয়। এই অবস্থায় দীর্ঘ সময় থাকলে ঘাড়ে টান, পিঠ বাঁকা হয়ে যাওয়া, এবং মেরুদণ্ডের আকৃতি বিকৃত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এতে পেশির কাজ ব্যাহত হয় ও শরীরে অস্বস্তি বাড়ে।

তবে সুখবরও আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক ভঙ্গি শুধু শারীরিক আরামই দেয় না, বরং মানসিক প্রশান্তিও এনে দেয়। যখন কেউ বুক সোজা রেখে মাথা উঁচু করে বসে বা দাঁড়ায়, তখন ফুসফুসে গভীরভাবে শ্বাস নেওয়া সহজ হয়। এটি শরীরে ‘রেস্ট অ্যান্ড ডাইজেস্ট’ বা শান্ত অবস্থার স্নায়ুতন্ত্র সক্রিয় করে।

ড. মেনন বলেন, ‘আমি আমার রোগীদের প্রতিদিন কয়েকবার ‘পোশ্চারাল রিসেট’ অনুশীলন শেখাই। মানে, কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে সোজা হয়ে বসা বা দাঁড়ানো, কাঁধ পেছনে ঘুরিয়ে নেওয়া এবং গভীর তিনটি শ্বাস নেওয়া। এই ছোট অনুশীলন মস্তিষ্কের উদ্বেগচক্র ভাঙতে সাহায্য করে।’

তিনি পরামর্শ দেন, যোগব্যায়াম, পিলাটিস বা মাথা উঁচু করে হাঁটার মতো ভঙ্গি-সচেতন অনুশীলন মানসিক প্রশান্তি ফিরিয়ে আনতে বিশেষ কার্যকর হতে পারে।

অর্থাৎ, আপনার ফোনে চোখ রাখার ভঙ্গিই বলে দিতে পারে আপনি মানসিকভাবে কতটা স্থির বা অস্থির। তাই এখনই ফোন নামিয়ে, মাথা উঁচু করে একটু গভীর শ্বাস নিন। হয়তো এখান থেকেই শুরু হতে পারে আপনার মনের যত্ন। তথ্যসূত্র : ইন্ডিয়া টুডে