জুলাই সনদ প্রশ্নবিদ্ধ এবং প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য আপত্তিজনক ও অন্তঃসারশূন্য: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক
- ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ১১:১২
জুলাই সনদ প্রশ্নবিদ্ধ এবং প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য আপত্তিজনক ও অন্তঃসারশূন্য বলে মন্তব্য করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। রবিবার (১৯ অক্টোবর) এক বিবৃতির মাধ্যমে তারা এ মন্তব্য করেছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরে’র আয়োজন। মহাসমারোহে এ আয়োজনের ঢাকঢোল পেটানো হলেও, শুরু থেকেই জুলাই সনদ তৈরির প্রক্রিয়া ও পরিসর নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন জনমনে থাকায় জনপরিসরে এই স্বাক্ষর-অনুষ্ঠান নিয়ে উল্লেখযোগ্য আগ্রহ ছিল না। গণ-অভ্যুত্থানোত্তর অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন সংস্কার কমিশন ও ঐকমত্য কমিশন প্রতিষ্ঠা, সংস্কার নিয়ে আলাপচারিতা ও সর্বোপরি জুলাই সনদ প্রস্তুত করার লক্ষ্যে যেভাবে অগ্রসর হয়েছে, তা অভ্যুত্থানের বহু অংশীজনকেই আশাহত করেছে।
বিবৃতিতে সরকারের জনবিমুখতার কথা বলে বলা হয়, সরকার এতটাই জনবিমুখ হয়ে পড়েছে যে, বহু অংশীজনের স্বর এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্যখাতসহ জনগণের বহু প্রকৃত আকাঙ্ক্ষা উঠে আসেনি সংস্কারের সুপারিশমালা ও চূড়ান্ত জুলাই সনদে। বিশেষত, নারী, লিঙ্গীয় পরিচয়ে সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের ব্যাপারে এই সনদে কোনো আশার আলো নেই। নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে প্রসন্ন করার লক্ষ্যে ও বহুপক্ষকে এই সনদ চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়ায় দূরে রেখে এবং অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় অংশীদার শিক্ষার্থীদের অভিপ্রায়কে গুরুত্ব প্রদান না করে যে ‘ঐক্যে’র কথা প্রচার করা হয়েছে, তার ফাঁক আমরা সনদ স্বাক্ষরের দিনই দেখতে পেয়েছি—জুলাই যোদ্ধাদের একটি অংশ বিক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং তাদের ওপর পুলিশ ন্যাক্কারজনক হামলা চালিয়েছে। শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রণীত এই সনদের স্বাক্ষর-দিবসে সকল রাজনৈতিক দল উপস্থিত না থাকলেও, সরকার ও ঐকমত্য কমিশন সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এ আয়োজন করতে ব্যতিব্যস্ত ছিল বলে মনে হয়েছে। এমতাবস্থায়, জুলাই সনদ ঐক্যের ডাক দিতে ব্যর্থ হওয়ার পাশাপাশি প্রশ্নবিদ্ধও হয়েছে, যা অদূর ভবিষ্যতে নতুন রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করবে বলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক মনে করে।
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের সমালোচনা করে বলা হয়, অনৈক্যের প্রভাব খোদ ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রায় ৩০ মিনিটের বক্তৃতাতেও প্রতিফলিত হয়েছে। এই বক্তৃতায় তিনি জুলাই সনদের গুরুত্ব আলোকপাত করতে গিয়ে অনেক অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক টেনেছেন। প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তৃতায় আলঙ্কারিক বাহুল্য ও শ্রেষ্ঠত্ববাদী অহমিকার চর্বিতচর্বণ ছাড়া আর কিছুই নেই। মোটাদাগে তাঁর এই অন্তঃসারশূন্য বক্তব্য জাতিকে আশার আলো দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। উল্টো তিনি এমন এক আপত্তিজনক ও বিতর্কিত বিষয়ের অবতারণা করেছেন, যা রাজনৈতিকভাবে তো বটেই, সমাজতাত্ত্বিক ও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল।
এতে আরও বলা হয়, তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) দুইবার তাঁর বক্তৃতায় ‘বর্বরতা’ ও ‘সভ্যতা’র যে মেরুকরণ করেছেন, তা নিন্দনীয় ও বিদ্বেষমূলক হয়েছে বলে আমরা মনে করি। প্রথমবার তিনি বলেছেন, “এই সনদের মাধ্যমে আমরা একটা বড় কাজ করলাম৷ আমরা বর্বরতা থেকে সভ্যতায় আসলাম। আমরা এক বর্বর জগতে ছিলাম, যেখানে আইনকানুন ছিল না। মানুষের যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারত। এখন আমরা সভ্যতায় আসলাম এবং এমন সভ্যতা আমরা গড়ে তুলব মানুষ ঈর্ষার চোখে আমাদের দেখবে।” বক্তৃতা শেষের আগে তিনি আরেকবার বলেছেন, ‘ঐক্যমতের মাধ্যমে যে কঠিন কঠিন কাজ সমাধা করা যায়, আমরা যে বর্বরতা থেকে সভ্যতায় এসেছি, তার প্রমাণ রাখা যায়, কার্যে প্রমাণ করতে হবে। কাগজে তো আমরা প্রমাণ করলাম যে সেই সভ্যতা আমরা নিয়ে আসলাম, এখন কাজে প্রমাণ করতে হবে যে আমরা সেই সভ্যতা অর্জন করেছি।‘
এতে আরও বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক মনে করে, এই আলোচনা সম্পূর্ণভাবে ঔপনিবেশিক বিদ্যায়তনিক বয়ান ও পশ্চিমা শ্রেষ্ঠত্ববাদী সূত্র মেনে তুলে ধরা হয়েছে। ব্রিটিশ ও পশ্চিমা ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদীরা উপনিবেশিত জাতিগুলোকে ‘অসভ্য’ ও ‘বর্বর’ সাব্যস্ত করে তাদের ওপর তথাকথিত ‘মর্ডানিটি’ (আধুনিকতা) ‘এনলাইটমেন্ট’ (আলোকায়ন), ‘সিভিলাইজেশন’ (সভ্যতা), ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’ (শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ) চাপিয়ে দিয়েছিল। এই করুণ অভিধা আমাদেরও জুটেছিল, যার ফল ছিল ১৯০ বছরের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী শাসন-শোষণ।
এরপর, পাকিস্তানের নব্য-ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীকে পরাজিত করে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছি, তা শুধু আমাদের সার্বভৌমত্বই নিশ্চিত করেনি, একইসঙ্গে সমস্ত শ্রেষ্ঠত্ববাদী অহংবোধকেও সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রশ্ন ও প্রত্যাঘাত করতে শিখিয়েছে। এ কথা সত্য, গত ৫৫ বছরের ইতিহাসে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ব্যর্থতায় আমরা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রাপ্ত জনগণের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র ও আইনিব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। কিন্তু, তার অর্থ এই নয় যে, আমরা এতদিন ‘বর্বর’ ছিলাম, আর প্রশ্নবিদ্ধ ও ঐক্য গড়তে ব্যর্থ এ জুলাই সনদ আমাদের ‘সভ্য করা’র বা ‘সভ্যতা শেখানো’র মহাপ্রকল্প হয়ে উঠবে।
বস্তুত, তথাকথিত ‘সভ্যতা’র ধারণাকে ফেরি করার মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক প্রকল্পের পক্ষেই সাফাই গাওয়া হয়। আর কাউকে এই ‘সভ্যতা’র মানদণ্ডে বর্বর, অসভ্য, পাশবিক, দাস, চাকর, ব্লাক, রেড ইত্যাদি বলার মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ববাদী ঔপনিবেশিক মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে। জ্ঞানজগতে উত্তর-ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিক ও চিন্তকরা নানাভাবে নানা পর্যায়ে উপনিবেশিত জাতিগোষ্ঠীগুলোর উপনিবেশ-বিরোধী লড়াইকে বিদ্যায়তনিক পরিসরে মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা করেছেন এবং ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদের অপরায়ন প্রকল্পের সমালোচনা করেছেন। এই ঐতিহাসিক ও বিদ্যায়তনিক পটভূমি মাথায় রেখে বলা যায়, প্রধান উপদেষ্টা ক্ষমতার মসনদে বসে অবিবেচনাপ্রসূত ঔপনিবেশিক অপরায়নের ছাঁচেই কথা বলেছেন। মনে রাখা দরকার, তিনি একটি সরকারের প্রধান নির্বাহী হলেও, এটি তাঁর অস্থায়ী পরিচয়। সারা বিশ্বেই তিনি একজন স্বনামধন্য একাডেমিশিয়ান ও সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে সমাদৃত। এমন এক বর্ণিল একাডেমিক পরিচয় থাকার পরও, তিনি কী করে উপনিবেশজাত শব্দসম্ভারে তাঁর বক্তৃতা রাখতে পারলেন, তা আমাদের কাছে বিস্ময়কর লেগেছে।
এসময়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক এমন শব্দচয়নের বিরোধিতা করে তাঁর এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায় । পাশাপাশি প্রশ্নবিদ্ধ জুলাই জাতীয় সনদ প্রসঙ্গে খুব শীঘ্রই একটি পর্যালোচনা তুলে ধরার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।