জুলাই সনদ ঐক্যের নয়, মানুষের বিভেদের দলিল
- ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ২৩:০৯
দেশটাকে বিভক্তির হাত থেকে রক্ষায় আজ কেউ আর সত্যিকার অর্থে এগিয়ে আসছে না। যারা আজ ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে উচ্ছ্বাসে মেতে আছেন, যারা বিশ্বাস করেন—এ দলিলের মাধ্যমে দেশে ‘শক্তিশালী গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হবে। তাঁদের কাছেই প্রশ্ন রয়ে যায়, তাঁরা আসলে গণতন্ত্র বলতে কী বোঝেন?
রাষ্ট্র কাঠামো পুনর্গঠনের এমন এক দলিলে সই হলো, যেখানে দেশের অর্ধেকেরও কম রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে। এখন অধিকাংশ মানুষের মনেই প্রশ্ন উঠতে পারে, বাকি অংশের রাজনৈতিক মতাদর্শ, দর্শন ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা কি জুলাই সনদে প্রতিফলিত হয়েছে? যদি না হয়ে থাকে, তবে ভবিষ্যতে এই দলগুলো কতটা বৈধভাবে নিজেদের ‘গণতান্ত্রিক দল’ হিসেবে নির্বাচন কমিশনে টিকে থাকতে পারবে, সেটিও ভাববার বিষয়।
রাষ্ট্র পরিচালনায় সময়ের দাবি অনুযায়ী নতুন আইন প্রণয়ন, এমনকি সংবিধান সংশোধনও হতে পারে। কিন্তু সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক দলিলের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার পথ তৈরি করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কারণ, আমাদের সংবিধান ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে লেখা। এটাই আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক, আমাদের গর্ব, আমাদের চরম প্রাপ্তি।
যারা আজ ‘জুলাই সনদ’-এ স্বাক্ষর করেছেন এবং আগামী রাষ্ট্র পরিচালনায় এটিকে ভিত্তি হিসেবে নিতে চান, তাঁদের মনে রাখা উচিত, এটি সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক ঐকমত্যে রচিত নয়। তাই ভবিষ্যতে যখন এই সনদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, তখন সম্ভাব্য রাজনৈতিক সংঘাত, বিভাজন বা রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতির দায় তাঁদেরই কাঁধে বর্তাবে। সেই দায় থেকে মুক্তির কোনো পথ থাকবে না।
ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়, ইতিহাস তার সাক্ষী। কিন্তু রাষ্ট্র কাঠামোর নৈতিকতা, স্থিতিশীলতা ও টেকসই রূপ গড়ে তোলার দায়িত্ব সব রাজনৈতিক দলেরই। যতদিন প্রকৃত জাতীয় ঐক্য গড়ে না উঠবে, ততদিন শত ‘জুলাই সনদ’ বা ‘অক্টোবর সনদ’ও দেশে গণতন্ত্রের বাস্তব রূপ দিতে পারবে না।
অনেকে হয়তো জানেন না ‘জুলাই সনদ’-এর মধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বৈধতা দেওয়ার একটি সুস্পষ্ট বয়ান তৈরি করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হয় এবং একই বছর সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেই ব্যবস্থার অবসান ঘটে। জুলাই সনদে কোথাও শেখ মুজিবুর রহমানের নাম নেই, স্বাধীনতার ঘোষণার ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা ইচ্ছাকৃতভাবে মুছে দেওয়া হয়েছে। যেন ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞের পর ২৬ মার্চের ঘোষণার মাধ্যমে কোনো অলৌকিক শক্তির ইচ্ছায় দেশ স্বাধীন হয়ে গেল।
প্রতিহিংসা, বিকৃতি আর আত্মরক্ষার রাজনীতিতে লেখা মূলত জুলাই সনদ। একাত্তরের ত্রিশ লাখ শহীদ, দুই লাখ নির্যাতিত মা-বোন, তাদের যন্ত্রণা সেখানে অনুপস্থিত। বরং সেখানে স্থান পেয়েছে ‘জুলাই সহস্রাধিক নিহত ও বিশ হাজার আহত’-এর মতো নতুন তথ্য, যা প্রকৃত ইতিহাসকে বিকৃত করেছে।
প্রতিহিংসার মানসিকতা নিয়ে লেখা দলিল যদি ‘বাংলাদেশ সংবিধান ২.০’ হয়ে থাকে, তবে আশঙ্কাই করা যায় আগামীতে এই দেশকে আরেক দফা রক্তক্ষয় থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। ‘জুলাই সনদ’ বাংলাদেশের মানুষকে একত্র করেনি, বরং আরও বিভক্ত করেছে। প্রতিহিংসা ও আত্মরক্ষার মানসিকতায় যারা এটি রচনা করেছেন, তাঁরা জনগণের ঐক্যের বদলে তৈরি করেছেন বিভেদের দেয়াল। এ দলিলের বহু ধারা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক অস্থিরতার নতুন উৎস হয়ে দাঁড়াতে পারে। যেখানে প্রাণ হারাবে শত কিংবা হাজার বাংলাদেশি।
এ দায় পড়বে অন্তর্বর্তী সরকারের কাঁধেই। ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে, এ কথাটি মনে রাখবেন।
ড. নাদিম মাহমুদ: লেখক ও গবেষক; ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: nadim.ru@gmail.com
(মতামত লেখকের নিজস্ব)