নাফ নদে জেলেদের অপহরণ

সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে আসে কান্নার শব্দ

নাফ নদীতে মাছ ধরার ট্রলার
নাফ নদীতে মাছ ধরার ট্রলার © টিডিসি

কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে এখন নীরবতা। সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে ভেসে আসে কান্নার শব্দ। যে নদী একসময় জীবিকার প্রতীক ছিল, আজ সেটিই হয়ে উঠেছে ভয় আর অনিশ্চয়তার নাম নাফ নদী। মাছ ধরতে গিয়ে প্রতিদিনই কেউ না কেউ হারিয়ে যাচ্ছেন। পরিবারগুলো অপেক্ষা করে, ফিরে আসে শুধু খবর- ওপারে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি।

কক্সবাজারের টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিনের নাফ নদে বাংলাদেশি জেলেদের ওপর মিয়ানমারের আরাকান আর্মির ক্রমবর্ধমান হামলা ও অপহরণের ঘটনা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। নদী একসময়ে জীবিকার প্রতীক হলেও এখন তা ভয়ে ও অনিশ্চয়তায় পরিণত হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, মাছ ধরতে গিয়ে প্রতিদিন কেউ না কেউ আটক বা অপহৃত হচ্ছে, আবার কেউ ফিরে এলেও নির্যাতনের ক্ষত নিয়ে আসে। সরকারি এবং স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে অন্তত ১১৬ জন জেলে অপহৃত হয়েছেন এবং এ বছরের প্রথম নয় মাসে ২৩৫ জন জেলেকে আটক করেছে আরাকান আর্মি, যার মধ্যে এখনো ১১১ জন বন্দি রয়েছেন।

নাফ নদ বাংলাদেশের টেকনাফ ও মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের প্রাকৃতিক সীমানা। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) আরাকান অঞ্চলে প্রভাব বাড়ানোর পর থেকেই বাংলাদেশি জেলেদের ওপর তাদের আক্রমণ বেড়েছে। অস্পষ্ট সীমান্তরেখার সুযোগে আরাকান আর্মির সশস্ত্র সদস্যরা নদী থেকে জেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ ফিরছেন নির্যাতনের ক্ষত নিয়ে, অনেকেই আর ফিরছেন না।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিনের কার্যালয়ের তথ্যমতে, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে অন্তত ১১৬ জন জেলে অপহৃত হয়েছেন। অন্যদিকে বিজিবির তথ্যমতে, এ বছরের প্রথম নয় মাসে ২৩৫ জন জেলেকে আটক করেছে আরাকান আর্মি। তাদের মধ্যে ১২৪ জন ফিরে এসেছেন, আর ১১১ জন এখনো বন্দি অবস্থায় রয়েছেন। নিখোঁজদের মধ্যে ৬২ জন রোহিঙ্গা জেলে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেন্টমার্টিন থেকে গত ৩১ আগস্ট তিনটি নৌকা আটক করেছে আরাকান আর্মি। তিনটি নৌকা থেকে ১৮ জেলেকে অপহরণ করে নিয়ে যায় মিয়ানমারভিত্তিক গোষ্ঠীটি। আটককৃতদের মধ্যে ছিলেন মো. আবু তারেক ও তার ছোট ভাই মো. জিয়াউল হক (বাবা হাজি আব্দুর শুক্কুর), মো. রহমত উল্লাহ (বাবা আলী আজগর), মো. রফিক (বাবা আব্দুর রহমান), আব্দুল মোতালেব (বাবা বছির আহমেদ), আবু বকর সিদ্দিক (বাবা আমির হোসেন), মো. তাহের (বাবা আব্দুল খালেক), সাব্বির আহমেদ (বাবা মকবুল আহমেদ), মনিউল্লাহ (বাবা মো. আব্দুর সালাম), ছৈয়দুল্লাহ (বাবা মাহমুদুল হাসান), আব্দুর রহিম (বাবা আবদুল্লাহ), হাফেজ আহমদ (বাবা আবু শমা), সালাহউদ্দিন (বাবা হাফিজউল্লাহ), আফসার উদ্দিন (বাবা নূর মোহাম্মদ) ও মো. আইয়ুব (বাবা মৃত আবুল কাসেম)।

এ ছাড়া সেন্টমার্টিনের একই পরিবারের চারজনকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি। এর মধ্যে আছেন তিন সহোদর মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, আলমগীর, আলহাজ উদ্দিন এবং তাদের ভগ্নিপতি সাব্বির আহমেদ।

টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিনের মানুষের প্রধান পেশা মাছ ধরা। কিন্তু এখন জেলেরা জীবিকার নয়, আতঙ্কের নদীতে নামেন। আরাকান আর্মি শুধু সীমান্তের ওপার থেকে নয়, অনেক সময় বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে ট্রলার থামিয়ে জেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ।

আরাকান আর্মির হাত থেকে বেঁচে আসা জেলেরা জানান, তাদের দিনে অন্তত দুইবার মারধর করা হয়, খেতে দেওয়া হয় না কিছুই। কেউ কেউ বলেন, ‘কলাগাছ সিদ্ধ করে খেতে বাধ্য করত, হাত-পা বেঁধে রাখত।’

বন্দি অবস্থায় তাদের কাছ থেকে বিজিবি ক্যাম্পের অবস্থান ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা চৌকির তথ্য জানতে চাওয়া হয়। কেউ কেউকে কৃষিকাজ বা মালামাল বহনের কাজেও ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিশ্ববিখ্যাত গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) তাদের এক প্রতিবেদনে জেলেদের আটক তিনটি মূল কারণ ব্যাখ্যা করেছে।

প্রথমত, নিরাপত্তার কারণ। জান্তা সরকারের বিমান হামলার আশঙ্কায় নদীপথে টহল বাড়িয়েছে আরাকান আর্মি। সন্দেহজনক দেখলেই তারা বোট থামিয়ে জেলেদের আটক করছে।

দ্বিতীয়ত, লুটপাট ও খাদ্যসংকট। জান্তা সরকারের অবরোধে আরাকান অঞ্চলে খাদ্য ও জ্বালানির তীব্র সংকট। তাই মাছভর্তি নৌকা, খাবার ও সরঞ্জাম ছিনিয়ে নিচ্ছে তারা।

তৃতীয়ত, রাজনৈতিক কৌশল। বন্দি জেলেদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ ও ‘বৈধ কর্তৃপক্ষ’ হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করছে আরাকান আর্মি।

টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিনের শতাধিক পরিবার এখন অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে। শাহপরীর দ্বীপের মদিনা বেগমের তিন ছেলে ও এক জামাতা এখনো ফেরেননি। কণ্ঠ ভারী হয়ে তিনি বলেন, ‘চারজন সন্তানকে হারিয়ে এখন কান্না ছাড়া কিছু জানি না। আমার শুধু চাই, ওরা ফিরে আসুক।’

সেন্টমার্টিনের জেলে মো. আইয়ুবের ছেলে সায়েম জানায়, বাবা না থাকায় তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে।

বোটমালিকদের হতাশা আরও গভীর। শাহপরীর দ্বীপের ওসমান বলেন, ‘আমার চোখের সামনেই বাংলাদেশের দিক থেকে বোট ধরে নিয়ে গেছে।’

আর সৈয়দ আলম বলেন, ‘বিদেশ থেকে ফেরা জীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে বোট বানিয়েছিলাম। দুই মাসও যায়নি, সব শেষ।’

টেকনাফ পৌরসভার কেকে খালের ঘাট থেকে ৯টি বোট ও ৬৫ জন জেলে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি। যাদের মধ্যে ৬১ জনই রোহিঙ্গা।

বোট মালিক সমিতির সভাপতি সাজেদ আহমদ বলেন, ‘অস্ত্রের মুখে জেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে আরাকান আর্মি। ভয় না পেয়ে উপায় নেই। এভাবে চললে মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যাবে।’

তিনি আরও জানান, ‘রাখাইন রাজ্যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর নাফ নদে বাংলাদেশি জেলেদের ওপর একধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তারা। খাদ্যসংকটের কারণেই লুটপাট বাড়ছে।’

টেকনাফের ইউএনও শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, ‘জেলেরা মিয়ানমারের সীমান্তে গেলেই আটক হন। আমরা সচেতন করছি, কিন্তু অন্য দেশের জলসীমায় পদক্ষেপ নেওয়ার এখতিয়ার নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘মিয়ানমারের পানিতে মাছ বেশি পাওয়া যায়, তাই জেলেরা ঝুঁকি নিচ্ছেন।’

তবে স্থানীয় প্রশাসনের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, জেলেদের সুনির্দিষ্ট তালিকা এখনো তৈরি হয়নি। ইউএনও বলেন, ‘তালিকা করলে সংখ্যা হয়তো আরও কমবে, কারণ সবাই তো আনুষ্ঠানিকভাবে জানান না।’

বিশ্লেষকদের মতে, মূল সমস্যা সীমান্তরেখার অনিশ্চয়তা। নাফ নদে স্রোত, জোয়ার ও ঘূর্ণিপ্রবাহে সীমারেখা প্রায়ই স্পষ্ট থাকে না। জেলেরা বুঝতেই পারেন না কখন তারা বাংলাদেশের জলসীমা ছাড়িয়ে গেছেন। একটি মাঝারি আকারের বোটে মাছ ধরতে ২০ লাখ থেকে দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়। মাছ না পেলে লোকসানের অর্ধেক জেলেদের, বাকি অর্ধেক মালিকের। তাই জীবনের ঝুঁকি জেনেও অনেক সময় তারা গভীরে ঢুকে পড়েন- কখনো মৃত্যুর দিকেও।

তাদের মতে, একসময় জীবিকার প্রতীক ছিল নাফ নদ। এখন সেটি হয়ে উঠেছে মানবিক বিপর্যয়ের প্রতীক। বন্দি জেলেদের ফিরিয়ে আনার কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই, প্রশাসনের হাতে বাঁধা আন্তর্জাতিক সীমা। নাফ নদ আজ শুধু দুই দেশের সীমারেখা নয়- এটি হয়ে উঠেছে জীবনের সীমা, যেখানে প্রতিদিনই ডুবে যাচ্ছে পরিবার, আশা আর অপেক্ষা।