মারুফার ইনসুইং আতঙ্কের নাম, ক্রিজে দাঁড়ালে যেন ‘ঝড়’ ওঠে

মারুফা আক্তার
মারুফা আক্তার © ফাইল ছবি

বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটে এক উজ্জ্বল নাম মারুফা আক্তার। মাত্র ২০ বছর বয়সেই তিনি হয়ে উঠেছেন ভয়ংকর ইনসুইংয়ের প্রতীক, এক অনন্য প্রতিভার প্রতিচ্ছবি। প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের জন্য তার ইনসুইং এখন আতঙ্কের নাম, বোলিং ক্রিজে দাঁড়ালে যেন ‘ঝড়’ আসে। কেউ কেউ তুলনা টানেন বিশ্বসেরা পেসার মিচেল স্টার্কের সঙ্গে। আর তাতে অত্যুক্তি নেই বলেই মনে করেন ক্রিকেটবোদ্ধারা। সম্প্রতি তার ভয়ংকর ইনসুইং দেখে অবাক হয়েছেন অনেক কিংবদন্তি ক্রিকেটার, ধারাভাষ্যকার। মুগ্ধ হয়েছে পুরো ক্রিকেট বিশ্বই।

ইনসুইংয়ের জাদু

নারী বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম দুই ম্যাচেই বল হাতে মারুফা যেন আগুন ঝরিয়েছেন। পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে তিনি দলের জন্য এনে দেন স্বপ্নের সূচনা। প্রথম ওভারের শেষ দুই বলে ফেরান দুই ওপেনার ওমাইমা সোহেল ও সিদরা আমিনকে। প্রথম উইকেটে অফ স্টাম্পের বাইরে পড়ে ভেতরে ঢুকে যাওয়া ফুলার লেংথের বল লেগ স্টাম্পে আঘাত করে। তাতে ওমাইমা পান ‘গোল্ডেন ডাক’। পরের বলেও একই পরিণতি সিদরার, অন্যরকম নিখুঁত ইনসুইং, যা ড্রাইভ করতে গিয়ে তিনি লেগে টেনে নেন স্টাম্পে। হ্যাটট্রিক হাতছাড়া হলেও, ক্রিকেটবিশ্ব তখনই টের পায় এই মেয়েটি সাধারণ কেউ নন।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষেও দ্বিতীয় ম্যাচে তিনি ছিলেন সমান উজ্জ্বল। ২৮ রানে ২ উইকেট। তার ইনসুইংয়ে এবার কাবু ইংলিশ ব্যাটাররা। বিদেশি ধারাভাষ্যকাররা প্রশংসায় ভরিয়ে দেন তরুণ এই পেসারকে।

আইসিসির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক পাশে অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি পেসার মিচেল স্টার্কের ইনসুইং, অন্য পাশে মারুফার ইনসুইং। দুজনের বলের গতি, সিম পজিশন ও বাঁকের ছন্দ যেন অবিকল এক! ভিডিওটি মুহূর্তেই ভাইরাল হয়। গোটা ক্রিকেট বিশ্বেই হইচই পড়ে যায়। 

মারুফার প্রেরণা যখন মিচেল স্টার্ক 

এক সাক্ষাৎকারে মারুফা বলেন, ‘মিচেল স্টার্ক আমার খুব প্রিয় বোলার। তার সুইং আমাকে অনুপ্রাণিত করে, আমি শিখি তার কাছ থেকেই।’ তার এই অনুপ্রেরণাই আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। ইনসুইং এখন তার অস্ত্র, আত্মবিশ্বাস, এবং পরিচয়ের ভাষা। তবে অনেকে বলছেন, মিচেল স্টার্কের ঝুড়িতে শুধু ইনসুইং নয়, আছে বৈচিত্র্যময় নানা ডেলিভারি। ধীরে ধীরে নারী ক্রিকেটের স্টার্ক হয়ে উঠতে হলে মারুফাকে আরও অনেক পরিশ্রম করতে হবে, শিখতে হবে ধ্রুপদি পেসারদের নানা অস্ত্র।

সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে সাফল্য

মারুফা খুব বেশি লম্বা নন, শরীরের গঠনও পাতলা। তবু তার বোলিংয়ে আছে জোর, ছন্দ, নিয়ন্ত্রণ। পেস বোলারদের জন্য উচ্চতা সুবিধাজনক হলেও মারুফা সেই সীমাবদ্ধতাকে জয় করেছেন দক্ষতা দিয়ে। তার নিখুঁত রিস্ট পজিশন, সিম কন্ট্রোল আর অ্যাকশন। মূলত তিনটি উপাদানের মিশ্রণই তার ইনসুইংকে করে তুলেছে ভয়ংকর।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন বলে ইনসুইং মারুফার মূল শক্তি। তবে দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকতে হলে আউটসুইং, বাউন্সার, স্লোয়ার, কাটার, ইয়র্কার ইত্যাদি সব অস্ত্র আরও শাণিত করতে হবে। কারণ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একমাত্র ইনসুইং দিয়ে টিকে থাকা কঠিন। তবে তিনি যদি এই দিকগুলোয় দক্ষতা বাড়াতে পারেন, তবে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ পাবে নারী ক্রিকেটের এক অপ্রতিরোধ্য ফাস্ট বোলার।

একজন কৃষকের কন্যা মারুফা, হাল টানা বাবার মেয়েটি আজ বাংলাদেশ নারী দলের পেস আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু। একসময় পরিবারের অভাব-অনটন, মাঠে হাল ধরা হাতই এখন বল ধরছে দেশের গর্বের প্রতীক হয়ে। তার যাত্রা শুধু ক্রিকেট নয়, এক সংগ্রামী মেয়ের অনুপ্রেরণার গল্প।

২০ বছর বয়সেই তার চোখে বড় স্বপ্ন, বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে স্থায়ী মর্যাদার আসনে তুলে নেওয়া। আত্মবিশ্বাসী মনোভাব, আগ্রাসী বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এবং বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংই তাকে আলাদা করে রেখেছে। মারুফা শুধু একজন খেলোয়াড় নন, তিনি বাংলাদেশের নারী শক্তির প্রতীক। তিনি প্রমাণ করেছেন, মাটি ছুঁয়ে থাকা মেয়েরাও একদিন আকাশে ঝলমল করতে পারে, আলোকিত করতে পারে গোটা বিশ্বকেও।