নারীর সংগ্রামের প্রতীক ক্রিকেটার মারুফা, অদম্য নারীদের যথাযথ মূল্যায়ন জরুরি

আলমগীর শাহরিয়ার
আলমগীর শাহরিয়ার © টিডিসি সম্পাদিত

সৈয়দপুর জেলার প্রত্যন্ত এক এলাকা ঢেলাপীর। সেই ঢেলাপীর থেকে ক্রিকেটার মারুফার রাজধানী শহর ঢাকার মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ওঠে আসা কিংবা কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়াম জয়ের গল্পটা রূপকথাকেও যেন হার মানায়। গল্প, উপন্যাস বা সিনেমায় মানুষের জীবনের গল্প ওঠে আসে। কিন্তু জীবন কখনো গল্প, উপন্যাস বা সিনেমারও অধিক। ক্রিকেটার মারুফার জীবনও তাই।

ওয়ানডে বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তান ম্যাচে নিজের জাত চিনিয়েছেন পেসার মারুফা আক্তার। নিজের প্রথম ম্যাচে প্রথম ওভারে পাকিস্তান দলের ব্যাটিংয়ে দারুণ ফর্মে থাকা ওমাইমা সোহেল ও সিদরা আমিনকে বোল্ড করেন তিনি। তৈরি হয়েছিল হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা। এই তরুণীর বলের গতি ও নিয়ন্ত্রণ দেখে বিশ্বসেরা ক্রিকেটার লাসিথ মালিঙ্গা প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। বোলিংয়ে তার ‘নিখাদ দক্ষতা’ ও ‘দারুণ নিয়ন্ত্রণের’ প্রশংসা করে ফেসবুকে লিখেছেন, এখন পর্যন্ত এই আসরের সেরা ডেলিভারি বাংলাদেশের মারুফার।

আইসিসি মারুফার দুটি ডেলিভারি নিয়ে ভিডিও প্রকাশ করেছে। ভারতের সাবেক অধিনায়ক মিতালি রাজও বাংলাদেশের বাঘিনীকন্যা মারুফার প্রতি নিরঙ্কুশ মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ দল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৭ উইকেটে জয় পেয়েছে। ৭ ওভারে ৩১ রান দিয়ে ২ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হন মারুফা।

মারুফাকে নিয়ে আজ থেকে দুই বছর আগে ‘চিতার বেগে ছুটন্ত মারুফা’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলাম। মারুফার বিষয়ে যে আশাবাদ ও সম্ভাবনার কথা সেদিন উচ্ছ্বসিতভাবে লিখেছিলাম, সেই আশাবাদ ভুল ছিল না—মারুফা ওয়ানডে বিশ্বকাপের সূচনালগ্নেই তা প্রমাণ করেছেন। বয়স মাত্র ২০ বছর। অদম্য সাহস ও সংগ্রামের প্রতীক হয়ে ওঠা এই তরুণী অনেক দূর যাবেন—এই কথা আজ সংশয়হীনভাবেই বলা যায়।

পশ্চাৎপদতায় পূর্ণ এই সমাজে মারুফা আক্তারদের তারকা হয়ে ওঠা জরুরি—যতটা না নিজের জন্য, তার চেয়ে বেশি সমাজের জন্য। মারুফার জীবনজয়ের অসামান্য গল্প আমাদের প্রত্যন্ত গ্রাম ও সমাজে নারীর সক্ষমতা ও বিশ্বজয়ের ইতিবাচক বার্তা দেবে। যে কোনো সংগ্রামসংকুল প্রতিকূল পরিবেশ থেকেও মানুষ নিজের মেধার বিকাশ ঘটাতে পারে, মারুফারা তার উজ্জ্বল উদাহরণ।

দারিদ্র্যের সমুদ্রে হাবুডুবু খাওয়া বর্গাচাষি পিতা আইমুল্লাহর পরিবারে এবং রক্ষণশীল সমাজে জন্ম নেওয়া একটি মেয়ের ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন আপাতদৃষ্টিতে অবাস্তবই মনে হয়। কিন্তু স্বপ্ন যখন দুর্বার, তখন তাকে রোধ করার সাধ্য কার? মারুফার জীবনের বিজয়গাঁথাও যেন এখানে—হার না মানা, হাল না ছাড়া। অকপটে বলেছেন, পিতার সঙ্গে মাঠে কৃষিকাজ আমাকে শক্তি ও সাহস দিয়েছে। যেন এস এম সুলতানের শিল্পকর্মের সেই কৃষক এরা, যেন উত্তরবঙ্গের কৃষক বিদ্রোহের নায়ক, যেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সেই বিখ্যাত চরিত্র নুরলদীনের উত্তরাধিকার এরা।

২০২৩ সালের ১৬ জুলাই মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সফররত ভারতের নারী ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে দ্বিপাক্ষিক সিরিজে প্রথম জয়ের অন্যতম কারিগর ছিলেন মারুফা। ২০১৮ সালের এশিয়া কাপের ঐতিহাসিক ফাইনালের পর ভারতকে আবার হারায় বাংলাদেশ। ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটারদের তৃতীয় জয় সেটি। সেবারও বিজয়ের কৃতিত্ব অষ্টাদশী কিশোরী মারুফাকে না দিলেই নয়। বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে ৪০ রানের জয়ে ৪ উইকেট নেন মারুফা। তাঁর সঙ্গী রাবেয়া নিয়েছিলেন ৩ উইকেট। এভাবেই বিজয়ের পথ রচনা করেন তারা। অথচ এই মারুফা বিকেএসপিতে ২০১৮–১৯ সেশনে ভর্তির জন্য নির্বাচিত খেলোয়াড় হলেও অর্থাভাবে ভর্তি হতে পারেননি। গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হলে এগিয়ে আসে বিসিবি।

রত্ন চিনতে ভুল করেনি প্রতিষ্ঠানটি। মেয়েদের ঢাকা প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে হয়েছিলেন সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের মুকুটও উঠেছিল তার মাথায়। তখন তিনি কেবল দশম শ্রেণির ছাত্রী। পরে মেয়েদের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের জন্য ঘোষিত ১৫ সদস্যের দলেও ডাক পান মারুফা আক্তার।

ষাটের দশকেও পুরান ঢাকায় নারীরা ঘর থেকে বের হতে হলে রিকশার চারদিকে পর্দার ঘেরাটোপে থাকতে হতো। অথচ আজকের বাংলাদেশে মারুফা অবরোধবাসিনীদের সেই ঘেরাটোপ ভেঙে হাজারো দর্শকের সামনে চিতার বেগে দৌড়ে মাঠে বল করছেন। এই বাঁধভাঙা সাহসই মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশের নারীর অর্জন। কখনো ধর্মের দোহাই দিয়ে, কখনো প্রবল পুরুষতন্ত্রে সামাজিক রীতি বা প্রথার দোহাই দিয়ে নারীদের যুগ যুগ ধরে ঘরবন্দি করে রাখা হয়েছে।

বাংলা নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া তার লেখায় বলেছিলেন, “যখনই কোনো ভগিনী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। আমরা প্রথমত যাহা মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি। আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ওই ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধি–ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।”

প্রবল পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মারুফারা তাই নারীদের এগিয়ে যাওয়ার, আগল ভাঙার দারুণ প্রতীক, প্রেরণার অনিঃশেষ উৎস। এদেশে কর্মক্ষেত্রে এখন নারীদের জয়জয়কার—প্রশাসনে, শিক্ষকতায়, শিল্পকলায়, ক্রীড়ায়, ব্যাংকিংয়ে, এনজিওতে, এমনকি ব্যবসা-বাণিজ্যে। আমাদের বিশাল পোশাকশিল্পে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে সামাজিক বাঁধা উপেক্ষা করে বেরিয়ে আসা বস্ত্রবালিকারা এদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। ক্রীড়া ও সংস্কৃতিক্ষেত্রেও আমাদের অর্জন দেশের সীমানা পেরিয়ে মারুফাদের হাত ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছে গেছে বহু আগেই। তাই মারুফারা নিছক সুস্থ বিনোদনের প্রতীক নন, বরং একটি সমাজের জেন্ডার সমতা ও অগ্রগতির প্রতীক।

চিতার বেগে ছুটছ তুমি, ছুটছে তোমার পা,
আগুন হয়ে জ্বলতে থাকো, ভগিনী মারুফা।

আলমগীর শাহরিয়ার: প্রবাসী কবি ও গবেষক
ইমেইল: alo.du1971@gmail.com