মানবেতর জীবন শিক্ষকদের
ক্লাস নেন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা, বেতন পান ৩৫০০ টাকা
- রায়হান উদ্দিন
- ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ১৫:৩৩
প্রতিষ্ঠান আছে, রয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীও। শুধু নেই চলার মতো বেতন-ভাতা। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম ইবতেদায়ি মাদ্রাসা। প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত চলে পাঠদান। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ক্লাসও নেন শিক্ষকরা। তবে নেই শুধু বেতন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাথমিক ও ইবতেদায়ির সিলেবাস ভিন্ন হলেও শিক্ষার মান-পরীক্ষা পদ্ধতি এক ও অভিন্ন। যোগদানের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাথমিকের একজন শিক্ষক বেতন পান প্রায় ২০ হাজার টাকা।
অন্যদিকে ইবতেদায়ি মাদ্রাসার একজন শিক্ষক বেতন পাচ্ছেন তিন হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। এ যেন আকাশ-পাতাল পার্থক্য। স্কুলশিক্ষকের বেতন নিয়মিত পক্ষান্তরে ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকের বেতন নিয়মিতই অনিয়মিত। প্রাথমিক শিক্ষকের বেতন মাসের শুরুতেই আর মাদ্রাসার শিক্ষকের বেতন মাসের মাঝে কিংবা শেষে। সব কিছু ঠিক থাকলেও বেতন-ভাতায় চরম বৈষম্য। সবারই একই প্রশ্ন- কেন এমন বৈষম্য?
জানা যায়, ১৯৯৪ সালের একই পরিপত্রে রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষকদের বেতন নির্ধারণ করা হয়। এখন পর্যন্ত ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণ হয়। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলো জাতীয়করণ হয়নি। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর-২০২৩ (ব্যানবেইস) হিসেবে দেশে চার হাজার ৩১২টি স্বতন্ত্র মাদ্রাসা রয়েছে। এ ছাড়াও বেশকিছু জয়েন্ট ইবতেদায়ি মাদ্রাসা রয়েছে।
২০১১ সালে শেখ হাসিনা ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বিষয়াদির ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ফলে ২০১৮ সালের নভেম্বরে একটি নীতিমালা করা হয়। সর্বশেষ নীতিমালা অনুযায়ী ইবতেদায়ি মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষকদের বেতন হতো ১১তম গ্রেডে আর সহকারী শিক্ষকদের বেতন হতো ১৬তম গ্রেডে। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরিত এ নীতিমালাও বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে ১৫১৯টি ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরা পাচ্ছেন নামেমাত্র বেতন। তাও আবার অনিয়মিত। কেউ কেউ পান তিন মাস বা চার মাস পর পর বেতন।
শিক্ষকরা বলছেন, বেতন ইস্যুতে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা তাদের পেশা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। কোথাও কোথাও শিক্ষক না থাকায় ছাত্র-ছাত্রীও ভর্তি হচ্ছে না। ফলে অনেক মাদ্রাসাই প্রায় বন্ধের পথে।
নিজেদের অধিকার আদায়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন ইবতেদায়ীর শিক্ষকরা। জুলাই বিপ্লবে আওয়ামী সরকারের পতনের পর চলতি বছরের শুরুতে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলো এমপিওভুক্ত ও পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরে জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে কর্তৃপক্ষ। সবশেষ অন্তবর্তী সরকার ১৫১৯টি মাদ্রাসার এমপিওভুক্তির আবেদন গ্রহণ করে। এর মধ্যে ১০৯০টি প্রতিষ্ঠানের যাচাই-বাছাই সম্পন্ন হলেও এখনও গেজেট প্রকাশ হয়নি। এমপিওভুক্তির আওতায় আসলে বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার মতো স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত হিসেবে বেতন-ভাতা পাবেন।
অন্যদিকে সর্বশেষ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জারিকৃত নীতিমালায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বেতন ১১তম গ্রেডে আর সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ১৩তম। এসব স্কুলের শিক্ষকরা নিয়মিতই মাসের শুরুতেই বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। কিন্তু একই মানের ইবতেদায়ি মাদ্রাসায় কর্মরত শিক্ষকরা এসব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে সারা দেশের বিপুল সংখ্যক শিক্ষক তাদের পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
এ ছাড়া দিনের পর দিন বেতন-ভাতা না হওয়ায় ২০০৯ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে নিয়োগ প্রক্রিয়া। ফলে ইবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষক সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। শিক্ষকরাও বলছেন, বেতন ইস্যুতে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা তাদের পেশা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। কোথাও কোথাও শিক্ষক না থাকায় ছাত্র-ছাত্রীও ভর্তি হচ্ছে না। ফলে অনেক মাদ্রাসাই প্রায় বন্ধের পথে।
ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার একটি দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক মোহাম্দদ মাসুদ মিয়া (ছদ্ম নাম) বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির ব্যবস্থা থাকলেও ইবতেদায়ি মাদ্রাসার সব শিক্ষার্থী তা পাচ্ছে না। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকরাও বলছেন, ২০১৮ সালের নীতিমালা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। মূলত এ কারণেই মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষকদের হতাশা দিন দিন বেড়েই চলেছে। অনেকে মাদ্রাসা ছেড়ে অন্য কোনো পেশায় চলে গেছেন। এছাড়াও রয়েছে শূন্যপদে শিক্ষক নিয়োগের জটিলতা। এটি সমাধান না করা হলে মাদ্রাসাগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। দ্রুত প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষরিত নীতিমালা বাস্তবায়নের দাবি জানান তারা।
এসব বিষয়ে সংযুক্ত ইবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষক ফোরামের সভাপতি হাবিবুর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকরা এমপিওভুক্তি না হওয়ার কারণে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সরকারকে দ্রুত এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাই।
দেশের মাদ্রাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের একমাত্র পেশাজীবী অরাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা শাব্বীর আহমদ মোমতাজী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিগত সরকারের সময় অনেক নীতিমালা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমান সরকারের সময় নতুন নীতিমালা হয়েছে এবং এমপিওভুক্ত করা হচ্ছে। এটি বাস্তবায়িত হলে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকদের আর দুর্দশা থাকবে না।