খাগড়াছড়ির রামসু বাজার: আগুনে পোড়া স্বপ্ন, রক্তে ভেজা শোক
- ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২০:৫৩
খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার রামসু বাজার এখন এক শোকের শহর। চারপাশে ধ্বংসস্তূপ, ঝলসে যাওয়া দোকানপাট ও ঘরবাড়ি, ছাইয়ের গন্ধে ভারী হয়ে আছে বাতাস। একদিনের ব্যস্ত বাজার আজ নিস্তব্ধ—এ যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত কোনো এলাকা। এখানে মানুষের স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়েছে, হারিয়েছে প্রাণ তিন তরুণ, অসংখ্য পরিবার হয়েছে নিঃস্ব।
রক্তাক্ত সেই ২৮সেপ্টেম্বরের দুপুর
রবিবার দুপুরে হঠাৎ করেই ছুটে আসে গুলির শব্দ। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, প্রধান সড়ক থেকে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। মুহূর্তেই রক্তে লাল হয়ে যায় মাটি। পাখির মতো লুটিয়ে পড়েন থৈইচিং মারমা, আথুইপ্রু মারমা ও আখ্রাউ মারমা—তিন তরুণ, তিন পাহাড়ি প্রাণ। মরদেহ পড়ে থাকে রাস্তায়, কিন্তু আতঙ্কে কেউ কাছে যায়নি। যারা বেঁচে গিয়েছিলেন, তারা প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ে পালিয়েছেন পাশের গ্রামে। অনেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে। অনেকে পালানোর সুযোগ না পেয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছে, গুরুতর আহত হয়েছেন।
সেদিন শুধু প্রাণহানি নয়, আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে মানুষের স্বপ্ন। রামসু বাজারে অন্তত ৫৫টি দোকান, ২৫টি বসতঘর ও ২০টি ভাড়াবাড়ি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পুরো বাজার ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। একসময় যেখানে বেচাকেনা আর হাসিমুখের ভিড় ছিল, সেখানে এখন শুধু পোড়া টিন আর ছাইয়ের স্তূপ পড়ে আছে।
মায়ের কান্না, স্ত্রীর আহাজারি
নিহত থৈইচিং মারমার মা ডানুপ্রু মারমা ভেঙে পড়েছেন। কণ্ঠরোধে বললেন, “আমার একমাত্র ছেলে কোনোদিন রাজনীতি করে নি। সে শুধু তেল কিনতে বের হয়েছিল। সেদিন যে তাকে এভাবে হারাতে হবে, কখনো ভাবিনি। আমার গর্ভবতী পুত্রবধূ এখন নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা—তার ভবিষ্যৎ কী হবে? আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও।” গুলিতে স্বামী হারানো কুতু মারমার চোখ ভিজে আছে অশ্রুতে। তিনি বলেন, “আমার স্বামী গাড়ি চালাত। সেদিন দোকানে তেল নিতে গিয়ে আর ফেরেনি। আমার অনাগত সন্তান পৃথিবীতে বাবার মুখও দেখতে পাবে না। যখন সন্তান বাবার খোঁজ করবে, আমি কী বলব?”
ধ্বংসের সাক্ষী একটি ছবি
ব্যবসায়ী ক্যজ হ্লা মারমা মোবাইল বের করে দেখান তার কিশোরী মেয়ের ছবি। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীটি দোকানে বসে ছিল। সহিংসতায় তার দেহ রক্তাক্ত হয়ে পড়ে। কণ্ঠ কাঁপতে কাঁপতে তিনি বলেন, “আমার চোখের সামনে মেয়েকে গুলি করেছে। আমার দোকানও লুট করে আগুন দিয়েছে। এত বছর তিলে তিলে যা গড়েছিলাম, সব শেষ। আমি এর বিচার চাই।”
‘আমরা কার কাছে বিচার চাইব?’
সহিংসতায় সব হারানো স্থানীয়রা ক্ষোভ উগড়ে দেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, “আমাদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট সব পুড়িয়ে দেওয়া হলো। যাদের কাছে নিরাপত্তা চাইব, তারাই পাহাড়িদের গুলি করে। উল্টো আমাদের সন্ত্রাসী আখ্যা দেয়। আমরা কার কাছে বিচার চাইব?”
প্রশাসনের আশ্বাস, মানুষের হতাশা
আজ মঙ্গল (৩০সেপ্টেম্বর) দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেফালিকা ত্রিপুরা, জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার ও পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েল। জেলা প্রশাসক জানান, পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে প্রশাসন থাকবে। পুলিশ সুপার বলেন, নিহতদের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে এবং আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কিন্তু আশ্বাস শুনে ভরসা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। তাদের দাবি একটাই—ন্যায়বিচার। নিহতদের পরিবার চায় হত্যাকারীদের ফাঁসি। কেউ কেউ বলছেন, শুধু তদন্ত কমিটি নয়, দোষীদের বিচারের আওতায় আনা ছাড়া শান্তি ফিরবে না।
তদন্ত কমিটি গঠন
এ ঘটনায় ৫সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার।
থমথমে খাগড়াছড়ি
সহিংসতার পর থেকে খাগড়াছড়ি শহর, সদর উপজেলা ও গুইমারায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি আছে। চতুর্থ দিনের মতো জেলার অভ্যন্তরীণ সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ। শুধু সীমিত আকারে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক চলছে। বাজারগুলো জনশূন্য, মানুষ ঘরবন্দি। তবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবরোধ শিথিল করায় পরিবহন সেক্টরে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে।
একটি ধর্ষণ থেকে শুরু
সবকিছুর সূচনা হয়েছিল একটি কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনায়। এর বিচারের দাবিতে ‘জুম্ম ছাত্র–জনতা’চারদিন ধরে সড়ক অবরোধ কর্মসূচি চালাচ্ছিল। সেই অবরোধ চলাকালীন সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। রক্ত ঝরল, ঘরবাড়ি পুড়ল, দোকানপাট ছাই হয়ে গেল।
রামসুর ক্ষত
আজ রামসু বাজারের মানুষ দিশেহারা। জীবিকা হারানো দোকানিরা জানেন না আগামীকাল কীভাবে পরিবার চালাবেন। সন্তান হারানো বাবা-মা জানেন না জীবনের অর্থ কী। স্ত্রী হারানো স্বামী কিংবা স্বামী হারানো স্ত্রী—সবার বুকেই একটিই প্রশ্ন: কেন?
রামসু বাজার এখন শুধু একটি নাম নয়, এটি এক গভীর ক্ষতের প্রতীক। যেখানে মানুষের ঘরবাড়ি, দোকানপাট ছাই হয়ে গেছে, আর শোকগাথায় ঢেকে গেছে পাহাড়ি জনপদের আকাশ। মানুষ আজও ন্যায়বিচারের অপেক্ষায়, কিন্তু উত্তর আসছে না।