গভীর এক ডিজিটাল বিভাজন তৈরি হওয়ার ঝুঁকি
- ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৪:২৬
গতকাল জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির এই যুগে উন্নয়নশীল বিশ্বের তরুণদের জন্য আরও গভীর এক ডিজিটাল বিভাজন তৈরি হওয়ার ঝুঁকি আজ আমাদের একটি বড় উদ্বেগ। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ভাষা-ভিত্তিক বৃহৎ মডেল কিংবা আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা—এসব প্রযুক্তি যেন তাই পক্ষপাতদুষ্ট না হয় এবং এর সুফল যেন ন্যায্যভাবে সবার কাছে পৌঁছায় তা আজ আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।’
‘অন্যথায় বিশ্বব্যাপী এমন একটি প্রজন্ম তৈরি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে যারা নিজেদের বঞ্চিত, প্রান্তিক, অন্যায় ও অবিচারের শিকার হিসেবে বিবেচনা করবে। তারা সকল ধরনের ক্ষতিকারক প্রলোভনের সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে।’ বিশ্বসংস্থায় ডিজিটাল বিভাজনের বিষয়টি প্রথমবারের মতো অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস উপস্থাপন করেছেন বলেই মনে করি। এজন্য আমি তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি।
‘গভীর এক ডিজিটাল বিভাজন তৈরি হওয়ার ঝুঁকি’- এই প্রেক্ষাপটে নতুন এই বৈষম্যের কয়েকটি দিক আপনাদের সামনে বিস্তারি তুলে ধরতে চাই—যা খুব কম আলোচিত হলেও বাস্তবে ক্লাউড ইকোসিস্টেম-এ দ্রুত বাড়তে থাকা এক ধরণের বৈষম্য সৃষ্টি করছে।
আজ আমরা সবাই ‘ক্লাউড-ফার্স্ট’ বিশ্বে প্রবেশ করেছি। আমাদের ছবি, ভিডিও, ইমেইল, অফিসের কাজ, শাসনব্যবস্থা এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার—সবকিছুই এখন ক্লাউড স্টোরেজ ও ক্লাউড-ভিত্তিক টুলের উপর নির্ভরশীল। এ পরিবর্তন আমাদের সমাজ ও অর্থনীতিকে রূপান্তরিত করছে। কিন্তু ছোট ও উন্নয়নশীল দেশগুলো—বিশেষ করে যারা বড় অর্থনীতি বা বড় দেশের প্রতিবেশী—তারা একটি অদৃশ্য কিন্তু গভীর বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
এই বৈষম্য মূলত ক্লাউড স্টোরেজ ও নেটিভ ক্লাউড অবকাঠামোর কারণে তৈরি হচ্ছে। বড় বড় আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো তাদের ডেটা সেন্টার, ক্লাউড সুবিধা, কনটেন্ট ডেলিভারি নেটওয়ার্ক (সিডিএন), ক্যাশ স্টোরেজ ইত্যাদি স্থাপন করেছে মূলত বৃহৎ ও পুরনো অর্থনীতিগুলোতে। এর ফলে ছোট দেশগুলো তিনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে:
১. অর্থনৈতিক বৈষম্য
এই দেশগুলোকে বিদেশে অবস্থিত ক্লাউড সার্ভিস ব্যবহারের জন্য আন্তর্জাতিক গেটওয়ের মাধ্যমে অতিরিক্ত ব্যান্ডউইথ কিনতে হয়। ফলে তাদের সীমিত বৈদেশিক মুদ্রা দ্রুত ড্রেন আউট বা ক্ষয় হচ্ছে বা চাপ তৈরি হচ্ছে।
২. সেবার মানের বৈষম্য
বিদেশি সার্ভারের সাথে দীর্ঘ দূরত্বে তথ্য আদান-প্রদানের কারণে সর্বদা অতিরিক্ত ল্যাটেন্সি যোগ হচ্ছে। এর ফলে ইন্টারনেট ট্র্যাফিক ধীরগতির হয়, সেবার মান কমে যায়, এবং ব্যবহারকারীরা ন্যায্য সুবিধা পায় না, বিশেষত ক্রিটিকাল সার্ভিস যার জন্য অত্যন্ত কম ল্যাটেন্সি দরকার।
আরও পড়ুন: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ শিক্ষার্থী নর্থ সাউথে, কম কোনটিতে?
৩. বিনিয়োগ বৈষম্য
কারণ ডেটা সেন্টার ও অবকাঠামোগত বিনিয়োগ বড় দেশগুলোতেই সীমাবদ্ধ থাকে। ফলে ছোট দেশগুলোতে এ ধরণের ক্লাউড ও হাইপার স্কেলার বিনিয়োগ আসে না। তাদের ডিজিটাল অর্থনীতি পিছিয়ে থাকে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যায়।
হাইপারস্কেলারদের বিজনেস কেইসের অনুকূল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত হলেও, ছোট দেশগুলোকে নির্ভরশীল, বঞ্চিত ও প্রান্তিক অবস্থায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে—যেখানে তারা ডিজিটাল রূপান্তরের আসল সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জাতিসংঘ এ সমস্যাটিকে বৈশ্বিক নীতির আলোচনায় অগ্রাধিকার দিতে পারে।
আমাদের এমন একটি বৈশ্বিক ঐকমত্য এবং ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে হবে, যাতে ক্লাউড ব্যবহারের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা নিশ্চিত হয়, ছোট দেশগুলো পিছিয়ে না থাকে, এবং ডিজিটাল অবকাঠামোয় বিনিয়োগ সারা বিশ্বে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এখনই পদক্ষেপ না নিলে, একটি নতুন বিভাজন তৈরি হবে—এবার সেটা হবে সংযোগের নয়, বরং ক্লাউডের বিভাজন। আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল ভবিষ্যৎ দরকার, যেখানে ক্লাউড মানুষকে বিভক্ত করবে না, বরং একত্র করবে।
লেখক: অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী