রাবিতে পোষ্য কোটা ‘অযৌক্তিক’, বাতিল চান অনেক শিক্ষক

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় © টিডিসি সম্পাদিত

পোষ্য কোটা ইস্যুতে শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আন্দোলনে অচল হয়ে পড়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি)। ক্লাস-পরীক্ষা রয়েছে বন্ধ। পোষ্য কোটা ব্যবস্থাকে অযৌক্তিক উল্লেখ করে তা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন বহু শিক্ষক। গতকাল সোমবার রাবির শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু হয়। দ্বিতীয় দিনের মতো চলছে কমপ্লিট শাটডাউন। এ কারণে শিক্ষার্থী শূন্য হয়ে পড়েছে ক্যাম্পাস। 

গত ১৮ সেপ্টেম্বর হঠাৎ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কিছু শর্তসাপেক্ষে প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধার নামে ফিরিয়ে দেওয়া হয় পোষ্য কোটা। এ ঘোষণার পরপরই বিক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। কয়েকজন বসে যান আমরণ অনশনে। এ সময় অসুস্থ হয়ে চারজনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

পোষ্য কোটাকে কেন্দ্র করে গত ২০ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত উত্তেজনা বিরাজ করে ক্যাম্পাসে। এ সময় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে হাতাহাতি, ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। শিক্ষক-কর্মকর্তাদের হেনস্তার প্রতিবাদে কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অন্যদিকে ঘোষণা দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম।

এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পোষ্য কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরবর্তী সময়ে সিন্ডিকেট সেই সিদ্ধান্তই বহাল রাখে।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত পাঁচ শিক্ষাবর্ষে ৪৪২ শিক্ষার্থী পোষ্য কোটায় ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। তাদের মধ্যে সর্বশেষ ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের 'এ' ইউনিটে ৭৭০তম মেধাস্থানে থাকা শিক্ষার্থী উর্দু বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। এরপর আর কোনো মেধাতালিকা প্রকাশ না করায় ৭৭১তম মেধাস্থানের শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারেননি। কিন্তু পোষ্য কোটায় ৭ হাজার ৭৮৭তম মেধাস্থানধারী শিক্ষার্থী ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ভর্তির সুযোগ পান।

এছাড়া পোষ্য কোটার ধাক্কায় ৫ হাজার ২৫৭তম পজিশন করে আইন বিভাগ ও ৬ হাজার ৫৫৩তম পজিশনে পেয়েছে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তির মাগনা সুযোগ। পাশাপাশি ৭ হাজার ৫৫১তম হয়ে বাংলা বিভাগ, ৭ হাজার ১৭৮তম পজিশনে ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ৬ হাজার ৭৯১তম পজিশনে লোকপ্রশাসন বিভাগ, ৬ হাজার ৬৫৪তম পজিশনে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ও ৬ হাজার ৬১৬তম-তে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন পোষ্য কোটাধারীরা। ৫ হাজারের উপরে পজিশন করেও তিন ইউনিটের ৩৮ জন শিক্ষার্থী পোষ্য কোটায় টপ লেভেলের সাবজেক্ট থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিভাগে ভর্তি হন।

পোষ্য কোটা সম্পূর্ণ বাতিলের পক্ষে আমি না, আবার এভাবে রাখার পক্ষেও না। কারণ এর অপব্যবহার হয়। কিন্তু রাষ্ট্রে যারা চাকরি করে তাদের একটা অধিকারের বিষয় থাকে। এটা সবখানে থাকে, প্রায় সব দেশেই থাকে—আ-আল মামুন, অধ্যাপক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেন্টারের সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ৯৬ জন, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ১০০ জন, ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ১১৩ জন, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ৩৯ জন ও ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ৯৪ জন শিক্ষার্থী পোষ্য কোটায় ভর্তি হয়েছেন। অর্থাৎ গত ৫ বছরে ৪৪২ জন শিক্ষার্থী পোষ্য কোটায় ভর্তি হয়েছেন। 

যে পোষ্য কোটা নিয়ে তুলকালাম সে ব্যবস্থা বিলোপের দাবি জানিয়েছেন অনেক শিক্ষক। এর মধ্যে অন্যতম একজন হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, শিক্ষা ও গবেষণা বন্ধ করে কোনোকিছুকেই সমর্থন করি না। এগুলো বাদ দিয়ে কোনো শিক্ষার্থীর দাবি, এমনকি শিক্ষকদের দাবিও আমি সমর্থন করি না। আর পোষ্য কোটা আমার কাছে কোনোকালেই যৌক্তিক ছিল না। 

তিনি আরও বলেন, আমি একজন শিক্ষক, আমি সবচেয়ে বড় পদে আছি। আমার সন্তানেরা সব থেকে বেশি প্রিভিলেজ পাবে পড়ালেখার ক্ষেত্রে। তারা আরো বেশি মেধাবী হবে। যদি না হয় আমার সে সামর্থ আছে অন্য জায়গায় পড়ানো। আমি বেসরকারিতে পড়াতে পারব বা বিদেশে পাঠাতে পারব। 

মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ-আল মামুন। তিনি বলেন, পোষ্য কোটা সম্পূর্ণ বাতিলের পক্ষে আমি না, আবার এভাবে রাখার পক্ষেও না। কারণ এর অপব্যবহার হয়। কিন্তু রাষ্ট্রে যারা চাকরি করে তাদের একটা অধিকারের বিষয় থাকে। এটা সবখানে থাকে, প্রায় সব দেশেই থাকে। এক সময় যোগাযোগ, যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো ছিল না—সন্তানেরা যাতে আমাদের কাছে থাকতে পারে সেজন্য পোষ্য কোটার প্রয়োজন ছিল। এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা, যাতায়াত ব্যবস্থা সবকিছু উন্নত হয়েছে। তৃতীয় ও ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীরা যেহেতু কম সচ্ছল, উপযুক্ত পরিবেশ পায় না, তাদের সন্তানদের জন্য ১/২ শতাংশ বা আলাপ সাপেক্ষে কিছু কোটা রাখা যেতে পারে।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল কোটার ন্যায্যতা বিধান। কিন্তু শেখ হাসিনা আন্দোলনের মুখে দেমাক দেখিয়ে ২০১৮ সালে সব কোটা বাতিল করে দিয়েছিল, আবার ২০২৪ সালে সব কোটা বহাল করেছিলেন। পরিণতি তো আমরা সবাই জানি! সেইভাবে, ত্যানা অনেক পেঁচিয়ে আজ যেখানে এসে আমরা পৌঁছালাম, যেভাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রকাশ্যে ধস্তাধস্তি করতে দেখলাম তা খুব লজ্জার। এরকম ঘটনা আমি আগে দেখিনি দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে।

আরও পড়ুন: ক্লাস, পরীক্ষা, গবেষণা— সব চাপে কুলহারা শিক্ষকরা, তবুও নেই ‘টিএ’ নিয়োগের উদ্যোগ

নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হাবিব জাকারিয়া বলেন, শিক্ষার্থীরা যখন পোষ্য কোটা বাতিলের বিষয়ে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি আয়োজন করেছিল—তখন আমি শিক্ষক হিসেবে প্রথম স্বাক্ষর করেছিলাম। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পরে পোষ্য কোটা থাকার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো কারণ দেখি না। এছাড়া এভাবে পোষ্য কোটার দাবিটা আমি স্বাভাবিকভাবে দেখছি না। এটার ভিতরে কী রাজনীতি চলছে এটা আমি স্পষ্টভাবে বলতে পারব না। 

তিনি আরও বলেন, খুব সুন্দরভাবে ডাকসু, জাকসু হয়ে গেল। এভাবে রাকসুও হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। এটা সবার জন্য সম্মানের হতো। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও সম্মানের হতো। কিন্তু যেটা ঘটছে এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সম্মানের না। আমি খুবই আশাহত, এ ব্যাপারটা নিয়ে যে রাজনীতি এটা এল সেটা শোভনীয় নয়। 

আইন বিভাগের অধ্যাপক মোর্শেদুল ইসলাম বলেন, পোষ্য কোটা কোনো দাবি হতে পারে না। এটা কোনো অধিকার নয়। আমার অবস্থান পোষ্য কোটার বিরুদ্ধে। আমি কখনই এই কোটাকে সমর্থন করি না। তাই কর্মবিরতি উপেক্ষা করেও আমি ক্লাস নিয়েছি।