পৃথিবীর গভীরেই ছায়াপথের সর্পিল বাহুর ‘নমুনা’, স্ফটিক রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি বিজ্ঞানীদের

পৃথিবীর গভীরেই ছায়াপথের সর্পিল বাহুর ‘নমুনা’ রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা
পৃথিবীর গভীরেই ছায়াপথের সর্পিল বাহুর ‘নমুনা’ রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা © আনন্দবাজার

পৃথিবীর বাইরের দিকে কঠিন আবরণ তৈরি হওয়ার আগেই ‘সে’ পৃথিবীতে ছিল। এখনও রয়েছে। কিন্তু কোটি কোটি বছর ধরে ‘সে’ ছিল লোকচক্ষুর আড়ালে। অবশেষে ছোট্ট একটি স্ফটিকই বিজ্ঞানীদের জানিয়ে দিল, তার উপস্থিতি। আমাদের ছায়াপথ মিল্কি ওয়ের সর্পিল বাহুর ‘নমুনা’ বন্দি রয়েছে এতে।

পৃথিবী যেমন সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। সূর্যও তেমন গোটা সৌরমণ্ডলকে সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রের চারদিকে ঘুরছে। আমাদের ছায়াপথের গড়ন অনেকটা চাকতির মতো, যার কেন্দ্র ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন সর্পিল বাহু। এবার সেই বাহুর ‘নমুনা’ খুঁজে পাওয়া গেল পৃথিবীর মধ্যেই। পৃথিবী সৃষ্টির সময় তা ছিল সম্পূর্ণ উত্তপ্ত, গলিত অবস্থায়। আমাদের এই গ্রহের বাইরের অংশটি সেই সময় ছিল ম্যাগমার (লাভা) এক সমুদ্রের মতো। 

তারপরে ধীরে ধীরে তা ঠান্ডা হতে হতে তৈরি হয়েছে ভূত্বক বা ‘ক্রাস্ট’, যা পৃথিবীর বাইরের দিকের একটি পাতলা এবং কঠিন স্তর। নতুন গবেষণা বলছে, ভূত্বক গঠনের ইতিহাসে জড়িয়ে রয়েছে ছায়াপথের সর্পিল বাহু।

অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা ভূত্বকে পাওয়া কিছু জিরকন স্ফটিক নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছিলেন। জিরকন হল পৃথিবীতে পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন খনিজগুলোর অন্যতম। এ পর্যন্ত সন্ধান পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন জিরকন স্ফটিকটির বয়স ৪৪০ কোটি বছরেরও বেশি। ভূবিজ্ঞানীরা অনেকে বলেন, ছোট ছোট স্ফটিকগুলি সময়কে ধরে রাখতে পারে। 

ভূত্বক গঠনের সময় থেকে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন রাসায়নিক পরিবর্তনের সাক্ষ্য বহন করে এগুলো। এ স্ফটিক শুধু নিজের বয়সই জানায় না, সেগুলি তৈরির সময় পৃথিবী কেমন ছিল, তা-ও লুকিয়ে থাকে এর মধ্যে। এগুলোকে নিয়ে গবেষণা করেই ভূত্বকের গঠন সম্পর্কে নতুন দিশার সন্ধান দিলেন কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা।

স্ফটিকগুলির রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে চমকপ্রদ কিছু তথ্য পেয়েছেন গবেষকেরা। রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে মিল রয়েছে আমাদের ছায়াপথের (মিল্কিওয়ে) সর্পিল বাহুর গ্যাসীয় মণ্ডলের কিছু উপাদানের। এ বাহুগুলো আসলে কোনও শক্ত গঠন নয়। এগুলির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন নক্ষত্র, গ্যাস এবং ধূলিকনা। 

গবেষকেরা বলছেন, আমাদের সৌরমণ্ডল যখন প্যাঁচানো বাহুর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল, তখন সর্পিল বাহুগুলিতে থাকা রাসায়নিকের সঙ্গে মিল রয়েছে স্ফটিকগুলির রাসায়নিক নমুনার। সম্প্রতি ‘ফিজিকাল রিভিউ রিসার্চ’ জার্নালে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে।

ছায়াপথের কেন্দ্রের দিকের তুলনায় সর্পিল বাহুর মধ্যে দিয়ে যেতে সৌরমণ্ডলের বেশি সময় লাগে। সর্পিল বাহুর অংশ দিয়ে যাওয়ার সময় পৃথিবীতে ধূমকেতু এবং অন্য মহাজাগতিক বস্তু আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। ছায়াপথের সর্পিল বাহুগুলোতে রাসায়নিক নমুনার সঙ্গে কী ভাবে ভূত্বকে পাওয়া স্ফটিকের মিল পাওয়া গেল, তা এখনও স্পষ্ট নয়। বিজ্ঞানীদের অনুমান, সৌরমণ্ডল ছায়াপথের সর্পিল বাহু দিয়ে যাওয়ার সময় আশপাশের ধূমকেতুর ওপর নিজের মহাকর্ষীয় শক্তির প্রভাব ফেলে থাকতে পারে।

আরও পড়ুন: প্রথমবারের মতো ব্যালন ডি’অর জিতলেন ফরাসি উইঙ্গার উসমান দেম্বেলে 

গবেষকদলের প্রধান ক্রিস কার্কল্যান্ডের মতে, এর ফলে সম্ভবত কিছু ধূমকেতু পৃথিবীর ওপর এসে আছড়ে পড়েছিল। জিরকন স্ফটিক পৃথিবীর ত্বক বা ‘ক্রাস্ট’ গঠনের সঙ্গে ছায়াপথের যোগসূত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য বহন করছে বলেই মনে করেন তিনি। নতুন এ খোঁজ ভূবিজ্ঞানের সঙ্গে মহাকাশবিজ্ঞানের যোগসূত্রকে আরও নিবিড় করে তুলল বলেই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। 

কার্কল্যান্ডের মতে, ভূত্বকের পরিবর্তনকে এখন আর আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করা যাবে না। ভূত্বক গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে ছায়াপথেরও। তাঁর কথায়, এ গবেষণালব্ধ ফলই ভূবিজ্ঞান এবং মহাকাশবিজ্ঞানে গবেষণার পথকে আরও প্রশস্ত করবে।

আপাতত গবেষণালব্ধ ফল থেকে স্পষ্ট, ভূত্বকের গঠনে ছায়াপথের সর্পিল বাহুর সম্পর্ক রয়েছে। বিজ্ঞানীরা এ-ও জানিয়েছেন, দু’টি বিষয়ের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে মানেই এমন নয়, ছায়াপথের নমুনার সঙ্গে ভূত্বক গঠনের সরাসরি যোগ হয়েছে।

খবর: আনন্দবাজার।