উজ্জ্বল মুখে উচ্ছ্বাসের ছোঁয়া: ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে গ্র্যাজুয়েশন ডে
- ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২২:০৩
গোটা রূপায়ণ সিটির আকাশটাও যেন সেদিনটি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের (ডিআইএস) উত্তরা ক্যাম্পাসের প্রাঙ্গণ ভরে উঠেছিল উৎসবের রঙে। বর্ণিল সাজসজ্জা, ফুল আর আলোয় মোড়ানো পরিবেশে ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা ঠাঁই দাঁড়িয়েছিল স্বপ্নের নতুন দুয়ারে। শরীরে চাপানো কালো গাউন আর মাথায় চারকোনা গ্র্যাজুয়েশন ক্যাপ; ছোট্ট মুখগুলিতেও ফুটে উঠেছিল বিজয়ের উচ্ছ্বাস, ভবিষ্যতের প্রত্যাশা।
দিনভরের ওই মিলনমেলায় সাতশো শিক্ষার্থীর প্রত্যেকেই যেন সেদিন একেকটি আলোকময় প্রদীপ। কারো ঠোঁটে গান, কেউবা ব্যস্ত নাচের স্টেপে, আবার কারো চোখেমুখে ঝলমলে হাসি। সুর আর ছন্দ মিলেমিশে তৈরি করছিল এক অপার্থিব আবহ। সেই আনন্দ-উৎসবের অংশীদার হয়ে শিক্ষকরাও দাঁড়িয়ে ছিলেন গর্বভরে; অভিভাবকদের চোখে তখন শুধু সন্তানের সাফল্যের দীপ্তি।
এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছিল, এ যেন শুধু একটি গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠান নয়, বরং স্বপ্নপূরণের এক মায়াবী উৎসব। শিশুরা যখন তাদের ছোট্ট হাতে নতুন যাত্রার পতাকা তুলে নিচ্ছিল, তখন উপস্থিত সবার মনেই এক অনাবিল আশ্বাস, এই ক্ষুদেরাই একদিন বদলে দেবে আগামীর পৃথিবী। গতকাল শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) উত্তরা রূপায়ণ সিটিতে ডিআইএস উত্তরা ক্যাম্পাসের গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানের দৃশ্য এটি।
‘আমাদের শিক্ষকদের ধন্যবাদ, যারা সবসময় আমাদের পথপ্রদর্শক হয়েছেন; আমাদের বাবা-মাকে ধন্যবাদ, যারা আমাদের সবচেয়ে বড় ভক্ত; প্রতিটি শিক্ষার্থীকে ধন্যবাদ, যারা এই অবিশ্বাস্য যাত্রার অংশ। আর অবশ্যই ডিআইএসের সব স্টাফদের ধন্যবাদ, যারা আমাদের সাফল্যের নেপথ্যের অক্লান্ত সহায়ক’- নাওয়াফ মাহবীর, হেড বয়
অনুষ্ঠানের আলোকোজ্জ্বল মঞ্চে তখন ‘হেড বয়’ নাওয়াফ মাহবীর নিবরাসের তরুণ কণ্ঠ ভেসে আসছে; ডিআইএসের দশম গ্রেডের শিক্ষার্থী সে। গত তিন বছর ধরে প্রিফেক্টের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে বড় ও পরিণত হয়েছে নিবরাস। তাই হয়তো পরিণত সেই কণ্ঠে ছিল আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি, চোখে ছিল ভবিষ্যতের স্বপ্নের ঝিলিক।
নিবরাস বলছিল, কীভাবে দায়িত্বের পথচলায় সে অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার জমিয়েছে। তার ভাষায়, ‘দায়িত্ব পালনকালে ডিউক অব এডিনবরা (DofE) প্রোগ্রামে অংশ নিয়ে পাহাড়ে ট্রেক করেছি, জায়েদ সাসটেইনেবিলিটি প্রকল্পের মাধ্যমে পৃথিবী রক্ষার চেষ্টা করেছি আর নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জে প্রায় রকেট উৎক্ষেপণ করে ফেলেছিলাম। আর ফুটবল মাঠে যখন দল একের পর এক ট্রফি ঘরে তুলেছে, তখন সহপাঠীদের সঙ্গে মিলে গলা ফাটিয়ে উল্লাসের মুহূর্ত ভাগ করে নিয়েছি।
এক এক করে সেসব স্মৃতির ভাঁজ উন্মোচন করতে করতে নিবরাস থেমে থেমে বলল, ‘এসব অভিজ্ঞতার পর আমি বুঝেছি, আমাদের স্কুলের আসল শক্তি হলো সম্প্রীতির এই বন্ধন।’ সবশেষে এই আইকন বয়ের সরল আহ্বান, আসুন, বছরটাকে আমরা অসাধারণ করে তুলি। শুধু ক্লাসে উপস্থিত থাকব না, বরং সেখানে নিজেদের ছাপ রেখে আসব। শুধু সফলতার স্বপ্ন দেখব না, একসাথে মিলেই সেটাকে গড়ে তুলব।’
শেষ লাইনে শিক্ষক তো বটেই, ধন্যবাদ দিতে ভুললেন না গোটা ডিআইএস পরিবারকেও। ‘আমাদের শিক্ষকদের ধন্যবাদ, যারা সবসময় আমাদের পথপ্রদর্শক হয়েছেন; আমাদের বাবা-মাকে ধন্যবাদ, যারা আমাদের সবচেয়ে বড় ভক্ত; প্রতিটি শিক্ষার্থীকে ধন্যবাদ, যারা এই অবিশ্বাস্য যাত্রার অংশ। আর অবশ্যই ডিআইএসের সব স্টাফদের ধন্যবাদ, যারা আমাদের সাফল্যের নেপথ্যের অক্লান্ত সহায়ক’, যোগ করেন নিবরাস। হেড বয়ের এসব কথায় যেন হলঘরে উপস্থিত শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকসহ সবাই একসঙ্গে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। মুহূর্তটিতে স্পষ্ট হয়ে উঠল, ডিআইএস কেবল শিক্ষা দেয় না, গড়ে তোলে এক অনন্য পরিবার।
অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে অনুভূতি প্রকাশ করে অলিভার রহমান অভি নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, এমন গ্র্যাজুয়েশনে অংশগ্রহণ করা অভিজ্ঞতা একেবারেই নতুন। বন্ধুদের সঙ্গে ছবি তোলা আর মঞ্চ পেরোনোর মুহূর্তগুলো দারুণ লেগেছে। পুরো অনুষ্ঠানটি আয়োজন করতে যেসব অসাধারণ শিক্ষক এত কষ্ট করেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
শেহাসীন ওয়ালিদাহ তাবীন বললেন, অনুষ্ঠানটি সত্যিই রোমাঞ্চকর; এক কথায় ভোলার মতো নয়। বন্ধু, সহপাঠী আর শিক্ষকদের সঙ্গে মিলে আমরা নতুন ও সুন্দর স্মৃতি গড়ে তুলেছি। গ্র্যাজুয়েশন ওয়াক থেকে শুরু করে ব্যাচ-গিভিং সেশন এবং সাংস্কৃতিক অংশ; সবকিছুই ছিল নিখুঁত। আবদুল্লাহ আলী মারুফের অভিজ্ঞতা, এমন গ্রাজুয়েশন ডে আমার জীবনের প্রথম। পুরো আয়োজনটাই চমৎকার লেগেছে, বিশেষ করে পারফরম্যান্সগুলো। সব মিলিয়ে দিনটি ছিল অসাধারণ, আর আমি দারুণ উপভোগ করেছি।”
প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা জানান, শিক্ষার্থীদের কঠোর পরিশ্রমের স্বীকৃতি দিতে ডিআইএসের নার্সারি থেকে শুরু হয়ে দশম গ্রেডের জন্য গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এখানে আর্লি ইয়ার্স থেকে গ্র্যাজুয়েশন অর্থ্যাৎ প্রাইমারিতে প্রবেশ, যেখানে শিশুরা আরও সংগঠিত শিক্ষার পরিবেশে প্রবেশ করে। প্রাইমারির সমাপ্তি তাদের লোয়ার সেকেন্ডারির জন্য প্রস্তুত করে। আর লোয়ার সেকেন্ডারি থেকে গ্র্যাজুয়েশন তাদের আপার সেকেন্ডারির জন্য প্রস্তুত করে, যেখানে তারা আইজিসিএসই লেভেলের উপর গুরুত্ব দেয়। এটিই তাদের ভবিষ্যৎ লক্ষ্যের পথ নির্ধারণ করে দেয়।
ডিআইএস উত্তরা ক্যাম্পাসের অধ্যক্ষ নাজাহ্ সালাওয়াতের মতে, গ্র্যাজুয়েশন শুধুই শিক্ষাজীবনের একটি ধাপ নয়, এটি উচ্চশিক্ষার প্রস্তুতি এবং বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব পালনের প্রতিশ্রুতি। এ মুহূর্ত শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের জন্য গৌরবের, যা ভবিষ্যতের সম্ভাবনার প্রতীক।
গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ড্যাফোডিল গ্রুপের চেয়ারম্যান ড. মো. সবুর খাঁন। সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিয়ে তিনি বলেন, তোমাদের নেতৃত্ব, মানবিক গুণাবলি, ইতিবাচক মানসিকতা ও উদ্যোক্তা দক্ষতা ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের রূপরেখা হবে। তিনি বলেন, আমি তোমাদের সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত করছি উদ্যোক্তা হতে। আর এটা হলেই তোমরা একদিন আমার মত অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারবে। এ সময় উপস্থিত শিক্ষার্থীরা চেয়ারম্যানের বক্তব্যে তাল মিলিয়ে ‘ইয়েস, ইয়েস’ বলে সম্মতি প্রকাশ করেন।
সততা ও ন্যায্যতা শপথ নিলেন হেড বয়/হেড গার্ল
এদিকে গ্রাজুয়েশন ডে অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ের ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, উত্তরা’র হেড বয় ও হেড গার্ল হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণকালে শপথ নিয়েছে। শপথ পাঠের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি রক্ষার অঙ্গীকারও করেছেন তারা। শৃঙ্খলা, সততা, নেতৃত্ব, ঐক্য এবং নিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঘোষণা করেছেন, সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে বিদ্যালয়ের মর্যাদা ও গৌরব অটুট রাখবেন। শপথে বলা হয়-
১. আমি সর্বদা আমার বিদ্যালয়ের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকে অটুট রাখব।
২. আমি শৃঙ্খলা, পাঠ্যঅর্জন এবং চরিত্রে নিজেকে আদর্শ হিসেবে গড়ে তুলব।
৩. আমি সবার প্রতি সততা, ন্যায্যতা ও সম্মানের সাথে আচরণ করব।
৪. আমি আমার সহপাঠীদের তাদের প্রতিটি কাজে উৎকর্ষ সাধনের জন্য অনুপ্রাণিত করব।
৫. আমি নিষ্ঠা, দায়িত্ববোধ এবং আন্তরিকতার সাথে আমার দায়িত্ব পালন করব।
৬. আমি আমার শিক্ষকদের সহযোগিতা করব এবং সহপাঠীদের পাশে ঐক্য ও সহযোগিতায় দাঁড়াব।
৭. আমি মর্যাদা, আনুগত্য ও গর্বের সাথে আমার বিদ্যালয়কে উপস্থাপন করব।
৮. পূর্ণ অঙ্গীকারের সাথে আমি প্রতিজ্ঞা করছি—আমার সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে আমি আমার বিদ্যালয়ের সেবা করব।
অনুষ্ঠানে রূপায়ণ গ্রুপের কো-চেয়ারম্যান মাহির আলী খান রাতুল, ড্যাফোডিল গ্রুপের সিওও ড. ইমরান হোসেন, ব্র্যান্ড অ্যান্ড কমিউনিকেশনের ডেপুটি ডিরেক্টর সামিহা খান, ডিআইএসের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ শাহানা খান, অধ্যক্ষ নাজাহ সালাওয়াত এবং রূপায়ণ সিটির সিইও মাহবুবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ব্রিটিশ কাউন্সিল বাংলাদেশের কান্ট্রি এক্সাম ডিরেক্টর ম্যাক্সিম রাইম্যান, অক্সফোর্ড একিউএ (বাংলাদেশ ও নেপাল) এর কান্ট্রি ডিরেক্টর শাহীন রেজা এবং ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস অ্যান্ড অ্যাসেসমেন্টের কান্ট্রি লিড সারওয়াত মাসুদা রেজা।
এর আগে ১৮ সেপ্টেম্বর ড্যাফোডিল প্লাজায় অনুষ্ঠিত হয়েছে ডিআইএস ধানমন্ডি ক্যাম্পাসের গ্র্যাজুয়েশন। সেখানে ৩৫০ শিক্ষার্থী অংশ নেয়।