বাংলাদেশে পোল্ট্রি শিল্প: তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য হাইলাইন ব্রাউনের সম্ভাবনা

হাইলাইন ব্রাউন জাতের মুরগি
হাইলাইন ব্রাউন জাতের মুরগি © টিডিসি ফটো

বাংলাদেশে পোল্ট্রি শিল্প তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য স্বাবলম্বী হওয়ার বড় সুযোগ তৈরি করেছে। কম পুঁজিতে দ্রুত লাভের কারণে এ খাত দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। ডিম উৎপাদনে দক্ষ এবং আবহাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ায় হাইলাইন ব্রাউন (Hy-Line Brown) জাতের মুরগি বিশেষভাবে খামারিদের প্রথম পছন্দ।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে Hy-Line Brown জাতের মুরগির সহজলভ্যতা, ফার্মিং ও সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পশুপালন অনুষদের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী সাকিব ইফতেখার ইসলাম। হাইলাইন ব্রাউন একটি সংকর প্রজাতির লেয়ার মুরগি, যা বিশেষভাবে ডিম উৎপাদনের জন্য উন্নত করা হয়েছে। এই জাতের মুরগি বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পে একটি গেম-চেঞ্জার হিসেবে বিবেচিত হয়।

উচ্চ ডিম উৎপাদন:

হাইলাইন ব্রাউন মুরগি ১০০ সপ্তাহের উৎপাদন চক্রে ৪৬৮ থেকে ৪৭৩টি ডিম দিতে পারে। এর মানে, গড়ে প্রতি সপ্তাহে একটি মুরগি ৫টিরও বেশি ডিম উৎপাদন করে। তাদের ডিম উৎপাদনের দক্ষতা সর্বোচ্চ ৯৬% পর্যন্ত পৌঁছায়, যা বাণিজ্যিক ফার্মিংয়ের জন্য অত্যন্ত লাভজনক।

খাদ্য রূপান্তর দক্ষতা (FCR):

হাইলাইন ব্রাউনের খাদ্য রূপান্তর দক্ষতা (FCR) ১.৯ থেকে ২.১ এর মধ্যে, যা অন্যান্য লেয়ার জাতের তুলনায় উন্নত। এর অর্থ হলো, প্রায় ২ কেজি খাদ্য থেকে এরা ১ কেজি ওজন বৃদ্ধি করতে পারে। এটি খরচ কমিয়ে লাভ বাড়াতে সহায়ক।

জলবায়ু সহনশীলতা: বাংলাদেশের গরম ও আর্দ্র জলবায়ুর সঙ্গে হাইলাইন ব্রাউন সহজেই মানিয়ে নিতে পারে। এটি তাদের বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চাষের জন্য উপযোগী করে তুলেছে।

ডিমের গুণগত মান:

এই জাতের মুরগির ডিম বাদামী রঙের হয়, যা বাংলাদেশের বাজারে সাদা ডিমের তুলনায় বেশি জনপ্রিয় এবং দামেও ভালো। ডিমের খোসা শক্ত এবং টেকসই, যা পরিবহনের সময় ক্ষতির ঝুঁকি কমায়। ৩৮ সপ্তাহ বয়সে এদের ডিমের অভ্যন্তরীণ গুণমান হিউ ইউনিটে (Haugh Unit) ৯০-এর বেশি হয়, যা উচ্চমানের ডিমের সূচক।

হাইলাইন ব্রাউন কোথায় পাবেন?

বাংলাদেশে হাইলাইন ব্রাউন মুরগির একদিন বয়সী বাচ্চা (Day-Old Chicks বা DOC) সহজেই পাওয়া যায়। এই বাচ্চার দাম সাধারণত ৬০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যে হয়। আপনি এগুলো সংগ্রহ করতে পারেন জেলা ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে। এছাড়া, কাজী ফার্মস, প্যারাগন, নারিশের মতো প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি কোম্পানিগুলো নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে কাজ করে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ সেবাও প্রদান করে, যা নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষভাবে সহায়ক।

হাইলাইন ব্রাউন ফার্মিংয়ে সাফল্যের টিপস:

হাইলাইন ব্রাউন মুরগির খামার স্থাপনের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখতে হবে। প্রথমত, খামারের অবস্থান নির্বাচন করতে হবে এমন জায়গায় যেখানে পর্যাপ্ত বায়ুচলাচল এবং সূর্যালোক পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, মুরগির খাঁচা বা শেড তৈরি করতে হবে পরিষ্কার এবং জীবাণুমুক্ত পরিবেশে। তৃতীয়ত, সুষম খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজের ঘাটতি না হয়। এছাড়া, নিয়মিত টিকাদান এবং পশুচিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।

তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সম্ভাবনা:

হাইলাইন ব্রাউন মুরগির খামার শুরু করা তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য একটি লাভজনক উদ্যোগ হতে পারে। এই জাতের মুরগি শুধু উচ্চ ডিম উৎপাদনই নিশ্চিত করে না, বরং বাংলাদেশের বাজারে এর ডিমের চাহিদা এবং দামও সন্তোষজনক। তরুণরা স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি রপ্তানির সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখতে পারেন। এছাড়া, পোল্ট্রি শিল্পে সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা, যেমন—স্বল্প সুদে ঋণ, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা এই খাতে নতুনদের জন্য পথ সুগম করছে।

চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান:

পোল্ট্রি শিল্পে সাফল্যের পথে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, খাদ্যের দাম বৃদ্ধি, রোগের প্রাদুর্ভাব, এবং বাজারে দামের ওঠানামা। এই সমস্যাগুলো মোকাবেলায় উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ নেওয়া, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা এবং বাজার বিশ্লেষণ করে পরিকল্পনা করা জরুরি। এছাড়া, স্থানীয় পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে বাজার সম্পর্কে সঠিক তথ্য এবং সহায়তা পাওয়া যায়।

পোল্ট্রি শিল্প শুধু ব্যক্তিগত আর্থিক স্বাধীনতাই নিশ্চিত করে না, বরং দেশের অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তায়ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তাই, আপনি যদি একজন তরুণ উদ্যোক্তা হন এবং নিজের পায়ে দাঁড়াতে চান, তাহলে হাইলাইন ব্রাউনের লেয়ার ফার্মিং হতে পারে আপনার স্বপ্ন পূরণের একটি দারুণ পথ।