ছাত্রশিবিরের উত্থান এবং রাজনীতির নতুন মেরুকরণ নিয়ে কিছু জরুরি কথা

দেবব্রত মুখোপাধ্যায়
দেবব্রত মুখোপাধ্যায় © টিডিসি সম্পাদিত

৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন রাজনীতি নিয়ে প্রচুর বাগাড়ম্বর হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শূন্যপ্রসবা কথাবার্তা ছাড়া কিছু হয়নি। অবশেষে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের ফলে আমরা আবিষ্কার করলাম, ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন কিছু যদি কেউ করতে পারে, সেটা করছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ও জামায়াতে ইসলামী। আমি একটু দেখতে চাই যে, জামায়াত, তথা ছাত্রশিবিরের এই উত্থান কি আকস্মিক কি না এবং তাদের পরবর্তী কৌশল কী হতে পারে।

উত্থানপর্ব

১. সাসটেইনেবল মানি ফ্লো নিশ্চিত করা:
আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে জড়িত প্রায় সবগুলো দল মূলত স্বল্পদর্শী ও তাৎক্ষণিক লাভে বিশ্বাস করে এসেছে। ফলে ক্ষমতার কাছাকাছি গেলে, কোথাও থেকে টুকটাক টাকার গন্ধ পেলে এবার লেজ উঁচু করে ঝাঁপিয়ে পড়ে লুটপাট করেছে। নিজের দলের জন্যও কোনো স্থায়ী অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করতে পারেনি।

বিপরীতে জামায়াত যখনই টাকার সোর্স পেয়েছে, ক্ষমতার কাছে গেছে; তারা ওই অর্থটাকে সাসটেইনেবল একটা স্ট্রাকচারে নিতে চেয়েছে। তারা হাসপাতাল করেছে, ব্যাংক করেছে, শিল্প প্রতিষ্ঠান করেছে। পুঁজিবাদী সততা বজায় রেখেই তারা এগুলো দারুণ মানি জেনারেটিং প্ল্যাটফর্মে পরিণত করেছে। ফলে তাদের টিকে থাকার জন্য খুচরো চাঁদাবাজি, ভাইয়ের তেলবাজির অপেক্ষা করতে হয়নি। এটা জামায়াতকে দীর্ঘ একটা সময় প্রায় আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকার পরও টিকে থাকতে দিয়েছে। যদিও শেষদিকে তাদের অনেকগুলো লাভজনক আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করে লুট করা হয়েছে।

২. নেতাদের আর্থিক নিরাপত্তা:
জামায়াতের যে টেকসই মানি ফ্লো তৈরি হয়েছে, এর একটা বড় অংশ ছাত্র নেতা ও ফুলটাইমারদের ক্যারিয়ার গড়তে এবং জীবন চালাতে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। ফলে এই নেতারা অগ্রপশ্চাৎ দুশ্চিন্তা না করে স্রেফ পড়াশোনা ও সংগঠনের কাজ করেছেন। তারা জানেন, তাদের ক্যারিয়ারের প্রয়োজনে টাকার অভাব হবে না।

৩. পাণ্ডিত্যের ট্যাবুতে না পড়া:
শিবিরের নেতারা অনেক পড়াশোনা করেন। যেটার ফলে অনেকে তাদের বাংলাদেশি বামনেতাদের সঙ্গে তুলনা করেন। কিন্তু এখানে শিবির নেতারা পরিষ্কার কিছু ইউনিক বৈশিষ্ট্য তৈরি করতে পেরেছেন। কাদের পড়তে হবে বেশি, কাদের পড়াশোনায় কম সময় দিয়ে মাঠে বেশি সময় দিতে হবে—এটা ডিফাইন করতে পেরেছেন। ফলে শিবির কেবল পড়ে পড়ে বই হয়ে যায়নি। তারা ডেডিকেটেড কর্মীবাহিনীও তৈরি করতে পেরেছে। বিপরীতে বাম নেতারা লাল বই পড়ে লাইব্রেরিতে সাজানো ধুলো পড়া অচল বইয়ে পরিণত হয়েছেন। কিছু ফিলোসফিকাল টার্মের বাইরে রাজনীতির কোনো জ্ঞানই তৈরি হয়নি।

৪. রণকৌশল হিসেবে পদ কেনা:
ছাত্রশিবিরের এই কাজটাকে আমার কাছে গত বিশ বছর বিশেকের সবচেয়ে যুগান্তকারী কাজ মনে হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি গত প্রায় ২০–২৫ বছর ধরে নিজের কর্মীদের প্রতি প্রচণ্ড অবিশ্বস্ত ও ধান্দাবাজ নেতায় ভরে উঠেছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের আমলে সরকারি নিয়োগ থেকে শুরু করে দলীয় পদ—সব বিক্রি করা হয়েছে। ছাত্রশিবির এই পদগুলো পার্টি বাজেটেই কিনে নিয়েছে।

আওয়ামী লীগের সরকারি নিয়োগগুলোর ঠিকাদারি করতেন মূলত শেখ পরিবারের সদস্যরা। চাকরি চাইতে গেলে ত্যাগী নেতার ছেলেকে বা ছাত্রলীগের গরিব ছেলেটাকে তারা নির্দয়ের মতো লাথি মেরে বের করে দিয়েছেন। সেই পদটা নিলামে তুলে বিক্রি করেছেন। এমনকি আওয়ামী লীগ অনলাইন মোকাবেলা, সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের জন্য মিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন প্রজেক্ট করেছিল। সেগুলোর পদ, কর্তৃত্বও তারা বেচে দিয়েছিল!

ছাত্রশিবিরের ছেলেরা রণকৌশল হিসেবে পদগুলো কিনে নিয়েছেন। বিএনপির সময়ও এটা ঘটেছে। ফলে আজ আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যেদিকেই তাকাচ্ছে, জামায়াত-শিবির দেখছে এবং ভাগ্য ও ষড়যন্ত্রকে দোষ দিচ্ছে।

৫. সো কল্ড গুপ্তলীগ:
লম্বা সময় ধরে ছাত্রশিবিরের অনেক নেতা ছাত্রলীগের পরিচয়ে রাজনীতি করেছেন। এটাকে নিয়ে আজকাল অনেক ট্রল হয়। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, তারা গুপ্ত ছিলেন না। তাদের শিবির ব্যাকগ্রাউন্ড, উদ্দেশ্য জেনেও স্রেফ টাকা এবং দুই ‘ম’-এর লোভে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতারা তাদের এম্পাওয়ার করেছেন। আমার এই বিশ্বাসের সূত্র আপনি খুঁজে পাবেন ফেসবুকেই। দেখবেন বছর পাঁচেক আগেও ছাত্রলীগের রাস্তার নেতারা নিয়মিত অভিযোগ করতেন যে, টাকা নিয়ে শিবিরের ছেলেদের লীগে পদ দেওয়া হচ্ছে।

যার ফলে আওয়ামী লীগ দেউলিয়া হলেও শিবির ডুয়াল ফাইট জিতেছে। প্রথমত তাদের মেধাবী নেতারা নিরাপদে থাকতে পেরেছেন। যেটা দুর্যোগের কালে জরুরি বলে চাণক্যও বলে গেছেন। দ্বিতীয়ত এর ফলে আওয়ামী লীগের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। এরকম টাকা এবং মদ-নারীতে পদ বিক্রি হতে দেখে ছাত্রলীগের মাঠের ছেলেরা ক্ষুব্ধ হয়ে চলে গেছে। ফলে সংঘাতের সময় লীগ নেতারা আওয়াজ দিতে গিয়ে দেখেন, তাদের পেছনে কথা বলার মতো একটি ছেলেও অবশিষ্ট নেই। আওয়ামী লীগের চিরকালের সবচেয়ে শক্তির জায়গা ‘মাঠের প্রতিরোধ’ ব্যাপারটাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে শিবির একটিও আঘাত না করে।

৬. বিপ্লবের মেওয়া:
৫ আগস্টকে এখন আমি বিপ্লব বলতে পারি। কারণ বিপ্লব করতে পার্টি লাগে এবং ক্ষমতার কাঠামোর প্রস্তুতি লাগে। এখন বোঝা যাচ্ছে, সেটা কেবল জামায়াত-শিবিরের ছিল। পট পরিবর্তনের পর বিএনপি ও ছাত্র নেতারা নানারকম দখলে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তারেক রহমানের অসম্ভব চেষ্টা সত্ত্বেও বিএনপি নেতারা টেম্পু স্ট্যান্ড থেকে শুরু করে পাথরের কেয়ারি দখল নিলেন। জামায়াতের যারা এগুলোতে অংশ নিলেন, তারাও সামনে দিলেন বিএনপিকে। ফলে তাদের গায়ে নোংরা লাগল না। ছাত্র নেতারা লোভী ও গলাবাজ হয়ে গেলেন প্রায় সবাই। বিপরীতে জামায়াত সবার কাছে খুব তুচ্ছ বলে মনে হওয়া কয়েকটি মাত্র প্রশাসনিক পদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে নিল। সবাই ভাবল, জামাতিরা বোকা বলে এসব টাকাহীন জায়গায় লোক বসাচ্ছে। সাদিক কাইয়ুমের মতো নেতৃস্থানীয় বিপ্লবের নেতা কোথাও কোনো পদ নিলেন না; গলাবাজি করতে শুনলাম না। অথচ সময় এলে দেখা গেল, সেগুলো মেসির চেয়েও ম্যাজিকাল সব গোল দিচ্ছে।

এখন কী?

১. জামায়াত কি ক্ষমতা নেবে?
মনে হয় না। এখনই সেটা তারা পারবে বলে মনে হয় না। যদিও যত সদস্য, ততো ভোট; বাস্তবতা থেকে তারা কিছুটা মুক্তি পেয়েছে। তবু সরকার গঠনের মতো পরিমাণে সুইং ভোট তারা দু-চার বছরে ম্যানেজ করতে পারবে না। আপাতত তারা লিবারেল ডেমোক্রেটিক শক্তিশালী বিরোধী দল হতে চাইছে বলে অনুমান করি। যাদের অসম্মতিতে কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো শক্তি সরকার অর্জন করতে পারবে না। এ জন্য তারা উচ্চ কক্ষে পিআর এবং শতাধিক নিম্নকক্ষের আসনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

২. জামায়াত কি গণতান্ত্রিক হবে?
জামায়াতের ক্ষমতামুখী রাজনীতিটা কেমন হবে, সেটা বুঝতে আপনি তাদের আমির ডা. শফিকুর রহমানের দুটি আলাপ শুনতে ও পড়তে পারেন। খালেদ মুহিউদ্দিনের সঙ্গে টক শো এবং প্রথম আলোর সাক্ষাৎকারে আপনি পরিষ্কার দেখতে পাবেন, জামায়াত কিভাবে মওদুদীবাদী রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে। এসব জায়গায় তিনি শরিয়া আইন, সংখ্যালঘুর অধিকার, একাত্তর, খেলাফতের দাবিকে ডেমোক্রেটিক জামায়াত কীভাবে ডিল করবে, তার একটা পথওয়ে দেখতে পাবেন।

৩. একাত্তর, নারী এবং সংখ্যালঘু:
তিনটি প্রশ্নে জামায়াতের মধ্যে গত বিশ বছর ধরে সংস্কার ও বিপ্লবের অনেক চেষ্টা হয়েছে। শিবিরের একঝাক মেধাবী নেতা এই সংস্কার করতে না পেরে রাজনীতি ছেড়েছেন বা নামসর্বস্ব দল করেছেন। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামান এবং ব্যারিস্টার রাজ্জাক তীব্র চেষ্টা করেছিলেন। তবে সবই বিফল হয়েছে মজলিসে শুরাকে কনভিন্স করতে না পারায়। ডা. শফিকুর রহমান, সাদিক কাইয়ুম এই ব্যাপারগুলো খুব সফটলি ডিল করছেন। যার বেশ কিছু প্রমাণ আপনারা দেখছেন এবং দেখবেন। সাদিক কাইয়ুম ইতিমধ্যে ছাত্রী সংসদের নেতৃত্বকে শিবিরের ডট রিপোর্টিংয়ে আনার চেষ্টা শুরু করেছেন। আপনারা খুব সম্ভবত ১৬ ডিসেম্বরের আগেই জামায়াত ও শিবিরের পক্ষ থেকে একাত্তর নিয়ে ঐতিহাসিক কোনো দলিল উপস্থাপন দেখতে পাবেন।

৪. তাহলে কি হ্যাপি এন্ডিং?
না। আমি সব কথা বললাম আসলে জামায়াত ও শিবিরের ঢাকা-কেন্দ্রিক চিন্তাশীল নেতৃত্বের কথা। এর বাইরে জামায়াতের বিশাল একটা কর্মীবাহিনী রয়ে গেছেন এই লিবারেল ট্রেনিংয়ের বাইরে। ফলে মফস্বলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের গোঁড়ামি, গুন্ডামি তীব্র হতে থাকবে এই ডাকসু, জাকসু বিজয়ের ফলে। আর সেটাই লিবারেল দল হয়ে ওঠার জন্য তাদের মূল চ্যালেঞ্জ। জামায়াত ও শিবির নেতৃত্ব যত দ্রুত তাদের কক্সবাজার–তেঁতুলিয়ার কর্মীটিকে তাদের বদলে যাওয়া রাজনীতি বোঝাতে পারবেন, ততো তারাই হাফ ছেড়ে বাঁচবেন। তবে এটা অতি সুদূরপরাহত একটা আশা মাত্র।

ফুটনোট
আমাদের এখানে অবজেক্টিভ আলোচনার খুব একটা জায়গা নেই। ফলে আওয়ামী লীগ নিয়ে কথা বললে সে বাকশালী আর জামায়াত নিয়ে কথা বললে সে শিবির; এই সিদ্ধান্ত খুব দ্রুত আসে। আমার নিরুপদ্রব জীবনে ট্যাগগুলো খুব কষ্টকর লাগে। তাই, সেলফ ডিক্লেয়ার দিই। আমি জামায়াতে যোগ দিচ্ছি না, নিশ্চিত থাকেন। আমি শেষ বিন্দু পর্যন্ত ক্লাসিক মার্ক্সিজমে আস্থা রেখে যেতে চাই। বাংলাদেশে যেহেতু মার্ক্সিস্ট পার্টি নেই; বাম যা দেখেন সব এনজিও বা ফান্ডেড রাজনীতি। তাই সক্রিয় রাজনীতি করি না।

জামায়াত ও শিবিরকে নিয়ে এই বিশ্লেষণটা অজামাতিরা পড়লে ভালো করবেন। পৃথিবীতে সময় কখনো শেষ হয়ে যায় না। ২০২৪ সালে এসে এক সময়ের চকলেট বয় রাহুল গান্ধী স্রেফ হাঁটতে হাঁটতে কংগ্রেসের অক্সিজেন ফিরিয়ে এনেছেন। কে জানে, আপনারাও হয়তো পারবেন।

শুভম।

দেবব্রত মুখোপাধ্যায়: লেখক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক