হিউম্যান বডিতে আগ্রহ থেকে মেডিকেলে চান্স পাওয়া তৌকির এবার বিসিএসে প্রথম
- ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭:৩৩
সম্প্রতি ৪৮তম বিশেষ বিসিএসের ফলাফল প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। স্বাস্থ্য ক্যাডারের জন্য বিশেষ এই বিসিএসে সহকারী সার্জন পদে ২ হাজার ৮২০ জন এবং সহকারী ডেন্টাল সার্জন পদে ৩০০ জনকে সুপারিশ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ডা. আব্দুল্লাহ আল শাহরিয়ার তৌকির এতে প্রথম হয়েছেন। মেডিকেলের চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৭ম স্থান অধিকার করেছিলেন তিনি। ৫ম শ্রেণিতেও ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলেন এই মেধাবী শিক্ষার্থী। নিজের সাফল্য আর অনুপ্রেরণাসহ নানা বিষয়ে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে কথা বলেছেন ডা. আব্দুল্লাহ আল শাহরিয়ার তৌকির, সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নবাব আব্দুর রহিম।
বিসিএসে আপনার সাফল্যের গল্প শুনতে চাই।
ডা. আব্দুল্লাহ আল শাহরিয়ার তৌকির: আসলে যখন রেজাল্ট দেখি তখন একটা অদ্ভুত ভাল লাগা কাজ করছিল। একই সাথে আল্লাহর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা অনুভব করছিলাম। শেষ এরকম ভাল লাগা কাজ করেছিল মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার পর যখন আমি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাই।
চিকিৎসক হওয়ার পিছনে অনুপ্রেরণা কী?
ডা. আব্দুল্লাহ আল শাহরিয়ার তৌকির: হাইস্কুলে পড়ার সময় থেকে আমার বইপত্র ঘাটার অভ্যাস গড়ে ওঠে। সেই সুবাদে হিউম্যান বডি নিয়ে জানার আগ্রহ তৈরি হয়। আবার ছোটোবেলা থেকেই দেখেছি আমাদের গ্রামের মানুষ আধুনিক স্বাস্থসেবা থেকে বঞ্চিত। তখন থেকেই ইচ্ছা চিকিৎসক হয়ে তাদের কাছে আধুনিক স্বাস্থসেবা পৌছে দেওয়ার। আমার মা-বাবা এবং অন্যান্য স্বজনদেরও ইচ্ছা ছিল আমাকে চিকিৎসক বানানোর। তাদের ইচ্ছাও আমাকে প্রভাবিত করেছে চিকিৎসক হতে।
এখন অনেক চিকিৎসকই ক্যাডার পরিবর্তন করেন। আমি মনে করি এর পিছনে অনেক কারণ দায়ী। যেমন স্বাস্থ্য ক্যাডারে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাব, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য এবং পরিবারের চাপে চিকিৎসক হওয়া। যদি স্বাস্থ্য ক্যাডারে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা বাড়ানো যায়, গবেষণার জন্য ফান্ডিং এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সরবরাহ করা হয়, তাহলে আমার মনে হয় শুধু ক্যাডার পরিবর্তনই কমবে না, অনেক মেধাবী চিকিৎসক বিদেশে না গিয়ে দেশের সেবাতেই তাদের মেধাকে কাজে লাগাবেন। আসলে আমি প্যাশন থেকেই ডাক্তার হয়েছি এবং এখনও এই প্রফেশনের প্রতি প্যাশনেট। আমার ক্যাডার পরিবর্তনের কথা কখনোই চিন্তায় আসেনি। আমি হেলথ ক্যাডারে থেকে স্বল্প খরচে মানুষের স্বাস্থসেবা নিশ্চিত করতে চাই। এটাই চিকিৎসক হিসেবে আমার অগ্রাধিকার।
পড়াশোনা ও ছোটবেলার গল্প শুনতে চাই।
ডা. আব্দুল্লাহ আল শাহরিয়ার তৌকির: আমার জন্ম কুমিল্লা জেলার সদর-দক্ষিণ উপজেলার মজলিশপুর গ্রামে। গ্রামেই বেড়ে ওঠা। সুলতানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিসহ প্রাথমিকের পাঠ গোছাই। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে কুমিল্লা জিলা স্কুলে চান্স পাই। এটাই আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। এই বিখ্যাত বিদ্যাপীঠের অনেক কৃতিশিক্ষার্থীর কৃতিত্ব থেকে জীবনে সফল হওয়ার অনুপ্রেরণা লাভ করি। তারপর এসএসসি পাস করে কুমিল্লার ইবনে তাইমিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৭ম স্থান অধিকার করি, যা আমাকে সামনে আরও ভাল করার অনুপ্রেরণা যোগায়।
প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হলে কিভাবে মোকাবেলা করেছেন?
ডা. আব্দুল্লাহ আল শাহরিয়ার তৌকির: আসলে সবার জীবনেই ছোটো বড় বাধা আসে। আমার জীবনও কোনো ব্যতিক্রম নয়। যখনই কোনো বাধা এসেছে, নিজের সক্ষমতার প্রতি সন্দেহ জন্মেছে,তখন ধৈর্য্য ধারণ করে সফলতার জন্য চেষ্টা করে গিয়েছি। সৃষ্টিকর্তার সাহায্য প্রার্থনা করেছি।
বিসিএসের জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন?
ডা. আব্দুল্লাহ আল শাহরিয়ার তৌকির: আমার বিসিএস জার্নি শুরু হয় মূলত ২০২৩ সালের নভেম্বরে ইন্টার্নশিপ শেষ হওয়ার পর। ইন্টার্নশিপে কিছুটা প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, কিন্তু তখনও আমি ডিটারমাইন্ড ছিলাম না বিসিএস নিয়ে। ইন্টার্নশিপ শেষে আমার বড় ভাই এবং মেডিকেলের সিনিয়রদের সাথে কথা বলে আমাদের দেশের সোশ্যাল পারসেপশনে (সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি) বিসিএসের গুরুত্ব বুঝতে পারি। এরপরই মূলত আমি আন্তরিকভাবে বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। প্রথমে আমি বিসিএস প্রিলিমিনারির প্রশ্ন ব্যাংক থেকে প্রশ্নের প্যাটার্ন এবং গুরুত্বপূর্ণ টপিকগুলো বাছাই করার চেষ্টা করি। সেই টপিকগুলোর উপর কন্সেপ্ট ক্লিয়ার রেখে যতটুকু সম্ভব বিস্তারিত প্রিপারেশন নেই এবং কোচিংয়ে নিয়মিত পরীক্ষা দিতে থাকি।
তারপর ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পাস করি। ৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারিতে ভাল প্রস্তুতির কারণে ৪৮তম বিসিএসের সাধারণ অংশে আমাকে তেমন বেগ পেতে হয়নি। ৪৮তম বিসিএসের জন্য আমি মূলত মেডিকেল অংশের বেসিক (এনাটমি, ফিজিওলজি),সার্জারি ও গাইনি ফোকাস করে প্রিপারেশন নেই। যেহেতু আমার মেডিসিনে (নিউরোলজি) এফসিপিএস পার্ট ১ পাস করা, তাই মেডিসিনের প্রিপারেশন আমাকে তেমন নিতে হয়নি।
আর ভাইভার জন্য প্রিভিয়াস স্পেশালের প্রশ্নগুলো বিশ্লেষণ করে প্রশ্ন কেমন হতে পারে তা অনুধাবনের চেষ্টা করেছি। প্রশ্ন বিশ্লেষণ করার পর বুঝতে পারি স্যাররা শুরুতে প্রার্থীদের নার্ভাসনেস (উৎকণ্ঠা) কাটানোর জন্য কিছু আইসব্রেকিং (প্রারম্ভিক সৌজন্যমূলক) প্রশ্ন করেন। যেমন নিজ জেলা, শখ, বর্তমান কর্মস্থল ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন করেন। তাই আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার ভাইভাটাও এভাবে শুরু হতে পারে। যেহেতু আমি নিউরোলজিতে ট্রেইনিংয়ে আছি, আমি নিউরোলজির ভাল প্রস্তুতি নিয়ে যাই। আমাকে মেডিকেল অংশের পুরোটাই প্রায় নিউরোলজি থেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। আলহামদুলিল্লাহ আমি মোটামুটি সাড়া দিতে পেরেছি।
নতুনদের কী পরামর্শ দেবেন?
ডা. আব্দুল্লাহ আল শাহরিয়ার তৌকির: যারা বর্তমানে গ্র্যাজুয়েশন লেভেলে আছেন, তাদের জন্য আমার পরামর্শ থাকবে নিজের একাডেমিক স্টাডিতে ফোকাস করুন। গ্র্যাজুয়েশনের আগেই বিসিএস ক্রেইজে ঝাপিয়ে না পড়তে বলি। বিসিএস এমনিতেই অনেক লং জার্নি। গ্র্যাজুয়েশনে থেকে এ সফর শুরু করে এটাকে আরও লম্বা করার মানে নেই বলে মনে হয় আমার কাছে। গ্র্যাজুয়েশনের পর ৩-৪ মাসের ফোকাসড প্রিপারেশনই প্রিলির জন্য যথেষ্ট। প্রিলি পাশের পর রিটেনের জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়, যদিও ৪৭তম বিসিএস ব্যতিক্রম।
প্রিলির প্রস্তুতিতে নতুন প্রার্থীরা যে সমস্যার সম্মুখীন হয় তা হল কী বই পড়ব এবং কতটুকু পড়ব। এই প্রশ্নের সহজ সমাধান হল প্রথমেই প্রিলিমিনারির প্রশ্ন ব্যাংক ভালভাবে বিশ্লেষণ করা। কোন টপিকগুলো থেকে প্রশ্ন বেশি আসে সেগুলো বাছাই করা। তারপর বাজারে যে বইগুলোতে এসব টপিক ভাল লেখা আছে, সে বই ফলো করা। একই সাথে নিজের স্ট্রং জোন আর উইক জোনগুলো শনাক্ত করা। কেউ যদি ইংলিশ ও গণিতে ভাল হয়, তাহলে সে এই বিষয়গুলোতে কম গুরুত্ব দিয়ে অন্য বিষয়ে ভাল করে পড়বে। আবার কারও সাধারণ জ্ঞানের বুনিয়াদ ভাল হতে পারে, তিনি হয়ত তখন অন্য বিষয়ে বেশি জোর দিবেন।
আরেকটি বিষয়, অনেক প্রকাশনীর বই না পড়ে যেকোন একটা প্রকাশনীর বই ধরে পড়া। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যেসব টপিক থেকে খুবই কম প্রশ্ন আসে, সেসব টপিক কম গুরুত্ব দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ টপিক বারবার রিভাইজ দেওয়া। সৃষ্টিকর্তার সাহায্য প্রার্থনা করে, নিজের প্রতি বিশ্বাস না হারিয়ে চেষ্টা করে গেলে আশা করি সফলতা ধরা দেবে। যারা বিসিএস জার্নি শুরু করতে চান তাদের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।