যুক্তরাষ্ট্রে ভ্যাকসিন গবেষণায় অবদান রাখছেন ময়মনসিংহের মেয়ে মমতা

মমতা আক্তার
মমতা আক্তার © সংগৃহীত
কোভিড-১৯ মহামারি শুধু মৃত্যু-ভয়েই বিশ্বকে আচ্ছন্ন করেনি, ভেঙে দিয়েছে মানুষের আত্মবিশ্বাস, অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভরসার ভিত্তিও। সেই বৈশ্বিক সংকটের কঠিন সময়ে মমতা আক্তার এক নীরব প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, বিজ্ঞানের আলোয় মানবজাতির জন্য কিছু করবেন।
 
মমতা আক্তার ময়মনসিংহের এক প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে। সেখান থেকে ধাপে ধাপে উঠে এসে তিনি আজ যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি (এমএসইউ)-তে ভ্যাকসিন গবেষণায় অনন্য অবদান রাখছেন। তাঁর গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু প্রাণঘাতী গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া (Enterobacteriaceae family), যা মানবদেহে মারাত্মক সংক্রমণের জন্য দায়ী। এই ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর ও টেকসই ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের লক্ষ্যেই তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
 
২০২২ সাল থেকে মমতা আক্তার এমএসইউ-এর রসায়ন বিভাগে প্রফেসর ড. শুফেই হুয়াং-এর তত্ত্বাবধানে অর্গানিক কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করছেন। বৈশ্বিক স্বাস্থ্যবিষয়ক এক গভীর দায়বদ্ধতা থেকে তিনি প্রাণঘাতী এই জীবাণুগুলোর বিরুদ্ধে একটি সার্বজনীন ভ্যাকসিন তৈরির লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি, তিনি গ্র্যাজুয়েট টিচিং ও রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন, যেখানে তিনি একদিকে যেমন তার একাডেমিক দায়িত্ব পালন করছেন, অন্যদিকে তেমনি পরবর্তী প্রজন্মের গবেষক ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ।
 
শুধু গবেষণা ও শিক্ষাক্ষেত্রেই নয়, নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও মমতা আক্তার অনন্য উদাহরণ। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড বায়োকেমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ইন নর্থ আমেরিকা (বিএসিএবিএএনএ) এর মিশিগান চ্যাপ্টারের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই অলাভজনক সংগঠনটি কেমিক্যাল ও বায়োকেমিক্যাল সায়েন্সের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থী ও পেশাজীবীদের সহায়তা প্রদান করে থাকে।
 
তাঁর গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু প্রাণঘাতী গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া, বিশেষ করে এন্টারোব্যাকটেরিয়াসি পরিবার। এই জীবাণুগুলো রক্তপ্রবাহের সংক্রমণ, মূত্রনালীর সংক্রমণ, নিউমোনিয়া ও গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিসের জন্য দায়ী। বিশেষত কার্বাপেনেম-রেজিস্ট্যান্ট এন্টারোব্যাকটেরিয়াসি আজ বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য এক ভয়ঙ্কর হুমকি।
 
মমতার স্বপ্ন একটি সার্বজনীন ও খরচ-সাশ্রয়ী ভ্যাকসিন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা, যা শুধু উন্নত বিশ্বেই নয়, সীমিত সম্পদসম্পন্ন অঞ্চলগুলোতেও সমানভাবে কার্যকর হবে। তাঁর বিশ্বাস, ভ্যাকসিন উন্নয়ন কেবল বৈজ্ঞানিক প্রয়াস নয়, বরং এটি মানবতার প্রতি এক দায়বদ্ধতা।
 
আগামী তিন বছরের মধ্যে গবেষণার ফলাফল আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে প্রকাশ এবং বিশ্বব্যাপী বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে উপস্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। দীর্ঘমেয়াদে তিনি সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ বা আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য সংস্থায় একজন জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করতে চান। সেখানে তিনি বহুমাত্রিক গবেষণা দলকে নেতৃত্ব দিয়ে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স মোকাবিলায় নীতি প্রণয়নে ভূমিকা রাখতে চান।
 
মমতার জন্ম ময়মনসিংহ সদর উপজেলার রঘুরামপুর গ্রামে। শৈশব থেকেই পড়াশোনার প্রতি গভীর অনুরাগী ছিলেন। সীমিত সুযোগ-সুবিধার মাঝেও তিনি দৃঢ় মনোবল ও অধ্যাবসায়ের জোরে এগিয়ে গেছেন। ২০০৮ সালে ময়মনসিংহের লেতু মন্ডল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ২০১০ সালে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজ থেকে এইচএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৬ সালে রসায়নে অনার্স এবং ২০১৮ সালে জৈব রসায়নে (অর্গানিক কেমিস্ট্রি) মাস্টার্স শেষ করেন, আর সেখান থেকে সুদূর মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি—তার গল্প এক অনুপ্রেরণার যাত্রা।
 
মমতা বলেন, ‘যে গ্রামে কলেজে ওঠার আগেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়, সেই গ্রামের মেয়ে হয়ে আমি এখন সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে।’
 
বাংলাদেশের শিক্ষাজীবনেই গবেষণার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং ধাপে ধাপে নিজেকে প্রস্তুত করেন বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে কাজ করার জন্য। ২০১৭–১৮ অর্থ বছরে তিনি বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় কর্তৃক জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ অর্জন করেন। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ২০২২ সালে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি যাত্রা শুরু করেন, যা সম্পূর্ণ তাদের অর্থায়নে পরিচালিত। বর্তমানে তিনি প্রফেসর ড. শুফেই হুয়াং-এর তত্ত্বাবধানে গবেষণা করছেন। এছাড়াও, তিনি ২০২৪ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ-সুইডেন ট্রাস্ট ফান্ড ট্রাভেল গ্রান্ট ও মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ইমার্জেন্সি ফেলোশিপ ফান্ডিং পান।  
 
তিনি বলেন, ‘এমএসইউ-তে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি এটি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন।’
 
এছাড়াও এমএসইউ-তে গ্র্যাজুয়েট টিচিং ও রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করছেন তিনি। নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের গবেষণায় অনুপ্রাণিত করা এবং বৈজ্ঞানিক কৌতূহল জাগানো তাঁর অন্যতম দায়িত্ব।
 
ভ্যাকসিন উন্নয়নের পাশাপাশি মমতা ক্যান্সার গবেষণাতেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘প্যাথলজি – রিসার্চ অ্যান্ড প্র্যাকটিস’–এ সহলেখক হিসেবে তাঁর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে ক্যান্সার-সংশ্লিষ্ট ফাইব্রোব্লাস্টের জটিল ভূমিকা ব্যাখ্যা করা হয়েছে, পাশাপাশি মস্তিষ্কে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়া এবং ওষুধ প্রতিরোধ এবং সম্ভাব্য থেরাপি নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। 
 
তিনি বলেন, ‘মস্তিষ্কে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধে উন্নত থেরাপিউটিক পদ্ধতি উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে।’ 
 
বাংলাদেশের বাস্তবতায় মমতার গবেষণা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। দেশে সংক্রামক রোগের হার তুলনামূলকভাবে বেশি এবং চিকিৎসা সবার নাগালের মধ্যে নয়। সীমিত সম্পদ ও অবকাঠামোর কারণে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ মোকাবিলা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মমতা বিশ্বাস করেন, তাঁর গবেষণা এখানকার জনস্বাস্থ্য খাত, ওষুধ শিল্প এবং বায়োটেকনোলজি সেক্টরে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।
 
তিনি মনে করেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য নির্ভর করবে সবার জন্য সমান ও সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ওপর। এজন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা জোরদার, আধুনিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তোলা, পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি, ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি হ্রাস করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
 
করোনাভাইরাস মহামারিই মমতাকে গবেষণায় নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছে। বৈষম্যমূলক টিকা প্রাপ্তি দেখে তিনি উপলব্ধি করেন, বিজ্ঞানের সাফল্য তখনই পূর্ণতা পায় যখন তা সবার জন্য সমানভাবে সহজলভ্য হয়। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই ভ্যাকসিন উন্নয়নকে তিনি মানবিক দায়বদ্ধতা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাঁর কাছে এই গবেষণা শুধু একটি একাডেমিক যাত্রা নয়, বরং মানবতার প্রতি অঙ্গীকার।
 
শুধু গবেষণাগারেই সীমাবদ্ধ নন মমতা। বর্তমানে তিনি বিএসিএবিএএনএ-র (বাংলাদেশ কেমিক্যাল এন্ড বায়োকেমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ইন নর্থ আমেরিকা) মিশিগান চ্যাপ্টারের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর মাধ্যমে উত্তর আমেরিকায় অবস্থানরত বাংলাদেশি গবেষক ও শিক্ষার্থীদের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। সংগঠনের সদস্যদের জন্য সেমিনার, ওয়ার্কশপ ও নেটওয়ার্কিং ইভেন্টের আয়োজন করেন, যা একাডেমিক ও পেশাগত উন্নয়নে সহায়ক। এসব আয়োজন অনেক সময় চাকরি, ইন্টার্নশিপ ও পোস্টডক্টোরাল সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। তার লক্ষ্য হলো—যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থী, গবেষক এবং পেশাজীবীদের একাডেমিক ও পেশাগত উন্নয়নে সহায়তা করা। এছাড়াও সম্প্রতি তিনি মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির কেমিস্ট্রি গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশন (CGSO)-এর আন্ডারগ্র্যাজুয়েট আউটরিচ অফিসার হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
 
মমতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেমিস্ট্রি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন (ডিইউসিএএ)-এর আজীবন সদস্য। তিনি এ বছর অনুষ্ঠিতব্য ৬ষ্ঠ বার্ষিক ডাউ-এমএসইউ (Dow-MSU) প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সিম্পোজিয়ামের স্টুডেন্ট কো-চেয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি, বাংলাদেশে গবেষণা, শিক্ষা ও উদ্ভাবনের অগ্রযাত্রায় নিবেদিত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘রিসার্চঅরবিট’-এর উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
 
মমতার অর্জিত এসব সাফল্য তাঁর দীর্ঘ যাত্রার সাক্ষী, যেখানে অধ্যবসায় আর দৃঢ় মনোবল তাঁকে ক্রমেই বড় মঞ্চের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতের স্বপ্নও তাঁর স্পষ্ট। দীর্ঘমেয়াদে তিনি এমন একটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন, যেখানে সমতা ও সহজলভ্যতা নিশ্চিত করে টেকসই ভ্যাকসিন প্রযুক্তি উন্নয়নের কাজ হবে।
 
তিনি বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশ থেকে উঠে আসা তরুণ-তরুণীরা বিশ্বমানের গবেষণায় অবদান রাখতে সক্ষম, যদি তারা যথাযথ দিকনির্দেশনা ও সুযোগ পায়। সেই সুযোগ তৈরি করাই তাঁর অন্যতম লক্ষ্য।
 
কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স এক অদৃশ্য মহামারি হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় মমতার গবেষণা নতুন আশার আলো। তাঁর জীবন ও কর্ম প্রমাণ করে অদম্য স্বপ্ন, অধ্যবসায় আর মানবিক দায়বদ্ধতা থাকলে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকেই বিশ্বমানের অবদান রাখা সম্ভব।
 
বাংলাদেশের তরুণদের জন্য তিনি শুধু একজন গবেষক নন, বরং এক অনুপ্রেরণা, যিনি দেখিয়ে দিচ্ছেন, গ্রাম থেকে ওঠে এলেও বিশ্বজয়ের পথ বিজ্ঞানের হাত ধরেই তৈরি করা সম্ভব।