৮০-৯০ দশকের ডাকসু

প্রচারণা চলত মাইকে ও বাড়ি গিয়ে, লিফলেটে থাকত প্রার্থীর একাডেমিক সাফল্য-নেতৃত্বের ব্যাকগ্রাউন্ড

দেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন সবসময়ই এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে এসেছে। কেবল শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব নয়, বরং দেশের মূল রাজনৈতিক প্রবাহের প্রতিফলন হিসেবেও বিবেচিত হয়ে থাকে ডাকসু। বর্তমানে প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির ফলে প্রার্থীরা খুব সহজেই তাদের বার্তা ও কর্মসূচি শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডিজিটাল পোস্টার, ভিডিও বার্তা, অনলাইন ক্যাম্পেইন ও ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে প্রচারণা এখন মুহূর্তের মধ্যেই হাজারো মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। 

কিন্তু ১৯৮০ সাল কিংবা তার আগের সময় ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ওই সময়গুলোতে প্রযুক্তির তেমন কোন অস্তিত্ব ছিল না, ফলে প্রচারণা চালাতে হতো সম্পূর্ণ ম্যানুয়ালভাবে। প্রার্থীরা দলীয় কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে হলে ও ক্যাম্পাসে সরাসরি প্রচারণা চালাতেন, লিফলেট বিতরণ করতেন, ব্যানার-পোস্টার লাগাতেন, মাইকিং করতেন। অন্যদিকে প্রতিটি প্রার্থীর নামে ছাপানো হতো আলাদা আলাদা লিফলেট। এগুলোতে তুলে ধরা হতো প্রার্থীর পরিচিতি, শিক্ষাজীবনের সাফল্য, নেতৃত্বগুণ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। তবে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ নির্বাচনের প্রচারণা কৌশলেও এসেছে বিস্তর রূপান্তর। দীর্ঘ এই সময়ে অর্থাৎ ১৯৮০ থেকে ২০২৫; এই তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ডাকসু নির্বাচনের প্রচারণায় যেমন এসেছে বৈচিত্র্য, তেমনি পরিবর্তন ঘটেছে নির্বাচনী কৌশল ও মাধ্যমে। প্রযুক্তির প্রভাব, রাজনৈতিক আদর্শের বিবর্তন এবং শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের মাত্রায় এসেছে দৃশ্যমান পার্থক্য।

১৯৮০-১৯৯০ সালে ডাকসুর প্রচারণা যেমন ছিল
পুরনো জাতীয় পত্রিকার প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ১৯৯০ সালে ডাকসু নির্বাচনে প্রচারণা ছিল পুরোপুরি ম্যানুয়াল। প্রার্থীরা হলে হলে গিয়ে লিফলেট বিলি করতেন, দেয়াল লিখতেন, মাইকিং করতেন এবং ক্লাসে ক্লাসে প্রচার চালাতেন। শুধু তাই নয়, প্রার্থীরা অনেকে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চেয়েছিলেন। গভীর রাতে হলগুলোতেও প্রচারণার খবর পাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নানা রংয়ের ব্যানার, পোস্টার ও ফেস্টুনের ব্যবহার ছিল চোখে পড়ার মতো। ছিল প্রার্থীদের পক্ষে বড় বড় নির্বাচনী মিছিল। অনেক প্রার্থী নিজেদের ব্যক্তিগত প্রোফাইল সংযুক্ত লিফলেট বিতরণও করেন।

আরও পড়ুন: ডাকসু: বাড়ল বুথের সংখ্যা, বিকাল ৪টার মধ্যে লাইনে দাঁড়ালেই ভোট দেওয়া যাবে

‘তখনকার সময় ছিল একেবারেই ভিন্ন। ডিজিটাল কিছুর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এমনকি তখন অফসেট ছাপাখানাও ছিল না। সাধারণত হ্যান্ড প্রেস বা খুব প্রাথমিক প্রিন্টিং ব্যবস্থার মাধ্যমে ছাপা হতো লিফলেট। কিছুটা ধূসর কাগজে ছাপা হতো, রঙ ছিল সীমিত। প্রচারণার সম্পূর্ণ ধরনটাই ছিল সরাসরি। প্যানেলভিত্তিক লিফলেট ছিল প্রচারের প্রধান মাধ্যম। তবে প্রতিটি প্রার্থীর নামে ছাপানো হতো আলাদা আলাদা লিফলেট। এগুলোতে তুলে ধরা হতো প্রার্থীর পরিচিতি, শিক্ষাজীবনের সাফল্য, নেতৃত্বগুণ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।’- আব্দুস সাদিক ভূঁইয়া (ডাকসুতে ১৯৮০ সালে কার্যনির্বাহী সদস্য প্রার্থী)

ডাকসুতে ১৯৮০ সালে কার্যনির্বাহী সদস্য এবং ১৯৮১ সালে সমাজসেবা সম্পাদক পদে অংশ নেন বিশ্ববিদ্যালয়টির সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুস সাদিক ভূঁইয়া। তিনি ১৯৮২ সালে মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ছিলেন। 

আব্দুস সাদিক ভূঁইয়া বলেন, ‘তখনকার সময় ছিল একেবারেই ভিন্ন। আজকের মতো ডিজিটাল মিডিয়া, ফেসবুক পোস্ট, ভিডিও ক্যাম্পেইন কিংবা সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং; এসব কিছুর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এমনকি তখন অফসেট ছাপাখানাও ছিল না। সাধারণত হ্যান্ড প্রেস বা খুব প্রাথমিক প্রিন্টিং ব্যবস্থার মাধ্যমে ছাপা হতো লিফলেট। কিছুটা ধূসর কাগজে ছাপা হতো, রঙ ছিল সীমিত। প্রচারণার সম্পূর্ণ ধরনটাই ছিল সরাসরি। প্যানেলভিত্তিক লিফলেট ছিল প্রচারের প্রধান মাধ্যম। তবে প্রতিটি প্রার্থীর নামে ছাপানো হতো আলাদা আলাদা লিফলেট। এগুলোতে তুলে ধরা হতো প্রার্থীর পরিচিতি, শিক্ষাজীবনের সাফল্য, নেতৃত্বগুণ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।’

তিনি আরও জানান, প্রচারণা ছিল মূলত হলে হলে ঘুরে ঘুরে। প্রত্যেকটি হলের ছাত্রদের মাঝে সরাসরি গিয়ে নিজেদের পরিচিতি তুলে ধরা হতো। প্রতিদিন প্রার্থীরা বিকেলে বা দিনের যেকোন সময়ে শুরু হতো বড় বড় মিছিল। শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠত ক্যাম্পাস। ছিল দেয়াল লিখনের চল, রাতভর চলত দেয়াল রঙ করার কাজ। চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা এই কাজে বড় ভূমিকা রাখতেন। প্রার্থীরা তাদের জন্য তুলি, রঙ, ক্যানভাস সরবরাহ করতাম। তারাই শিল্পভাষায় আমাদের বার্তা রূপ দিতেন দেয়ালে, ব্যানারে, ফেস্টুনে। চারুকলার বন্ধু-বান্ধবদের দিয়ে প্রার্থীরা এসব কাজ করাতেন।’

আরও পড়ুন: স্বাধীন বাংলাদেশের ৮ ডাকসুতে একবারও ভিপি হয়নি সরকারপন্থী কেউ

তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে যেসব এলাকায় ছাত্রসংখ্যা বেশি, সেখানে গিয়ে সরাসরি ছাত্রাবাস কিংবা বাসা বাড়িতে প্রচারণা চালাতেন অনেকেই। সে সময়ের নির্বাচনী প্রচারে ছিল অনেক আন্তরিকতা। ১৯৮০, ৮১, ৮২ সালের দিকে রাজনৈতিক মতাদর্শের চেয়ে প্রাধান্য পেত প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব-ইমেজ। প্রার্থী কেমন ছাত্র, নেতৃত্বগুণ কেমন, কীভাবে কথা বলে, কীভাবে সবার সাথে মিশে এগুলো খেয়াল করত অনেকেই। ব্যক্তিগত ইমেজটাই ছিল মূল হাতিয়ার। ছাত্ররাজনীতির সেই সময়টা ছিল অনেকাংশে ব্যক্তিকেন্দ্রিক।’ তবে ১৯৯০-এর দিকে এসে রাজনৈতিক মতাদর্শের ছাপ একটু একটু করে দৃশ্যমান হতে শুরু করে বলে জানান তিনি।

২০১৯-২০২৫ ডাকসু নির্বাচনে প্রচারণা
১৯৯০-এর পর প্রায় তিন দশক ডাকসু নির্বাচন হয়নি। দীর্ঘ ২৮ বছর অর্থাৎ ১৯৯০ সালের পর ২০১৯ সালে ডাকসুর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে প্রচারণায় নতুন এক ধারার সূচনা হয়। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে, ম্যানুয়াল প্রচারণার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম; বিশেষ করে ফেসবুকের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে দেখা যায় প্রার্থীদের। প্রার্থীরা ফেসবুক লাইভ, গ্রাফিক পোস্ট, ভিডিও মেসেজের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন। এছাড়া ব্যানারের মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়েছিলেন প্রার্থীরা। নির্বাচনটি ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের পর গঠিত নতুন ছাত্রসংগঠনগুলোর উত্থান ঘটায়। যদিও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা অনিয়ম, ভোটে বাধা ও ফলাফল নিয়ে বিতর্ক ছিল, তবু এটি শিক্ষার্থীদের রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

২০২৫ সালের ডাকসু নির্বাচন আরও এক ধাপ আধুনিকতায় পৌঁছেছে। প্রচারণা হয়ে উঠেছে প্রায় সম্পূর্ণ ডিজিটাল। প্রার্থীরা নিজেদের প্রচার চালাচ্ছেন প্রফেশনাল ক্যাম্পেইন ভিডিও, ইনফোগ্রাফিকস, ডিজিটাল মেনিফেস্টো, ফেসবুক লাইভ ও ইউটিউব ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে। ডিজিটাল ব্র্যান্ডিং, ইমেজ ম্যানেজমেন্ট এবং অনলাইন জরিপের ওপর ভিত্তি করে প্রার্থীরা তাদের পরিচিতি গড়ে তুলছেন। ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে ব্যানারের মাধ্যমে প্রচারনা চালাতে পারলেও এবার তাতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ডাকসু নির্বাচন কমিশন। শুধুমাত্র সাদা কালো পোস্টার, লিফলেট বা হ্যান্ডবিল ছাপানো ও বিলি করছে প্রার্থীরা।

২০১৯ সালে ডাকসুতে হল সংসদে শামসুন্নাহার হলের ভিপি প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি। সে সময় তিনি জয় লাভ করেছিলেন। তিনি ২০২৫ ডাকসু নির্বাচনে ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ থেকে কেন্দ্রীয় সংসদে ভিপি হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। ইমির কাছে ২০১৯ সালের প্রচারণার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি হল সংসদে ভিপি হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করি। সেক্ষেত্রে প্রচারণা হল কেন্দ্রীক করতাম। ফেসবুকে প্রচারণা চালিয়েছিলাম বেশি।’

তিনি বলেন, ‘ওই সময় ব্যানারের মাধ্যমেও প্রচারণা চালিয়েছিল প্রার্থীরা। প্রচারণার ব্যানার সহ লিফলেট সবকিছু সাদাকালো ছিল। ২০১৯ সালে ডিজিটাল প্রচারণার পাশাপাশি ম্যানুয়াল প্রচারণাও অনেক বেশি ছিল।’

আরও পড়ুন: স্বপদে বহাল থাকেন হাজতবাসে থাকা ঢাবি শিক্ষকরা, বেতন-ভাতাও পান নিয়মিত

এদিকে ২০২৫ সালের ডাকসু নির্বাচন আরও এক ধাপ আধুনিকতায় পৌঁছেছে। প্রচারণা হয়ে উঠেছে প্রায় সম্পূর্ণ ডিজিটাল। প্রার্থীরা নিজেদের প্রচার চালাচ্ছেন প্রফেশনাল ক্যাম্পেইন ভিডিও, ইনফোগ্রাফিকস, ডিজিটাল মেনিফেস্টো, ফেসবুক লাইভ ও ইউটিউব ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে। ডিজিটাল ব্র্যান্ডিং, ইমেজ ম্যানেজমেন্ট এবং অনলাইন জরিপের ওপর ভিত্তি করে প্রার্থীরা তাদের পরিচিতি গড়ে তুলছেন। ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে ব্যানারের মাধ্যমে প্রচারনা চালাতে পারলেও এবার তাতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ডাকসু নির্বাচন কমিশন। শুধুমাত্র সাদা কালো পোস্টার, লিফলেট বা হ্যান্ডবিল ছাপানো ও বিলি করছে প্রার্থীরা। 
 
২০২৫ ডাকসুতে প্রচারণার বিধিনিষেধ
গত ২৭ আগস্ট বুধবার এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে ডাকসু রিটার্নিং অফিসার এবং আচরণবিধি সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানী এক বিজ্ঞপ্তিতে আচরণবিধির ধারা-৭(ক) অনুযায়ী নির্বাচনী প্রচারণার জন্য কেবলমাত্র সাদা কালো পোস্টার, লিফলেট বা হ্যান্ডবিল ছাপানো ও বিলি করা যাবে। পিভিসি/কাপড় বা অন্য কোনো মাধ্যমে ছাপানো বা লেখা ব্যানার, ফেস্টুন, বোর্ড টাঙানো যাবে না বলে জানানো হয়েছে। 

২০২৫ ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার এবং আচরণবিধি সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানী বলেন, ‘ক্যাম্পাসে যেকোনো ধরনের ব্যানার, ফেস্টুন, বোর্ড এগুলো থাকবে না। কোথাও স্টিকারও লাগানো যাবে না। শুধু সাদা কালো হ্যান্ডবিল ও লিফলেট বিলি করা যাবে। এরপরে কোন প্রার্থী নিষেধ উপেক্ষা করে, তাহলে আচরণবিধি লঙ্ঘন হবে, সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’