গাজায় হত্যাকাণ্ডে ন্যায্যতা দিচ্ছে রয়টার্স, অভিযোগ তুলে আলোকচিত্রীর পদত্যাগ
- ২৭ আগস্ট ২০২৫, ০২:৫২
গাজায় হত্যাকাণ্ডে ন্যায্যতা দিচ্ছে রয়টার্স, এ অভিযোগ তুলে কানাডীয় ফটোসাংবাদিক ভ্যালেরি জিঙ্ক রয়টার্স থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। সংবাদ সংস্থাটিতে তিনি আট বছর ধরে ‘স্ট্রিংগার’ হিসেবে কাজ করছিলেন। আজ মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) তার ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে পদত্যাগের এ ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। তার ঘোষণাটি ইতিমধ্যে ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে, অসংখ্য মানুষ শেয়ার দিয়েছে।
পদত্যাগের ঘোষণায় জিঙ্ক বলেছেন, এমন সংস্থায় তিনি কাজ করতে পারেন না, যেটি ইসরায়েলের সাংবাদিক হত্যার ধারাবাহিকতাকে ন্যায্যতা দিচ্ছে। তিনি লিখেছেন, ‘গত আট বছর ধরে আমি রয়টার্স সংবাদ সংস্থার একজন স্ট্রিঙ্গার হিসেবে কাজ করেছি। প্রেইরি প্রদেশের খবর কভার করার সময় আমার তোলা ছবি নিউ ইয়র্ক টাইমস, আল জাজিরা এবং উত্তর আমেরিকা, এশিয়া, ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে রয়টার্সের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছে। কারণ এই সংস্থাটি গাজায় ২৪৫ জন সাংবাদিককে পরিকল্পিতভাবে হত্যার প্রক্রিয়াকে ন্যায্যতা দেওয়া ও তা সম্ভব করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।’
ভ্যালেরি জিঙ্ক লিখেছেন, গত ১০ আগস্ট ইসরায়েল যখন গাজা সিটিতে আনাস আল-শরীফকে আল-জাজিরার পুরো ইউনিটের সঙ্গে হত্যা করে, তখন রয়টার্স ইসরায়েলের সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এই দাবি প্রকাশ করে যে, আনাস হামাসের সদস্য ছিলেন।
গাজা নিয়ে ইসরায়েলের চালানো অগণিত মিথ্যা প্রচারের এটি একটি উল্লেখ করে তিনি লেখেন, রয়টার্সসহ গণমাধ্যমগুলো বিনা প্রশ্নে এই ভিত্তিহীন দাবি প্রকাশ করেছে ও এটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। ইসরায়েলি মিথ্যা প্রচারণা এগিয়ে নেওয়ার এই চেষ্টার পরেও জেনোসাইড থেকে রয়টার্স তাদের নিজেদের সাংবাদিকদের রক্ষা করতে পারেনি।
সোমবার (২৫ আগস্ট) সকালে ইসরায়েলের টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয়েছেন আরও পাঁচ সাংবাদিক। আল-নাসের হাসপাতালে চালানো এ হামলায় ২১ জনকে খুন করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে রয়টার্সের ভিডিওগ্রাফার হোসাম আল-মাসরিও রয়েছেন।
ভ্যালেরি জিঙ্ক লিখেন, ‘এটি ছিল তথাকথিত ‘‘ডাবল ট্যাপ’’ হামলা। এধরনের হামলায় প্রথমে ইসরায়েল একটি স্কুল বা হাসপাতালের মতো বেসামরিক স্থাপনায় বোমা ফেলে; তারপর যখন চিকিৎসাকর্মী, উদ্ধারকারী দল ও সাংবাদিকেরা ঘটনাস্থলে পৌঁছান, তখন আবার হামলা চালায়।’
গাজা পরিস্থিতি তৈরির জন্য পশ্চিমা গণমাধ্যমকে সরাসরি দায়ী করেছেন আলোকচিত্র সাংবাদিক ভ্যালেরি জিঙ্ক। নিজের লেখায় ড্রপ সাইট নিউজের জেরেমি স্কাহিলকে উদ্ধৃত করেছেন তিনি। জেরেমি স্কাহিল লিখেছেন, ‘প্রত্যেক বড় সংবাদমাধ্যম—নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে শুরু করে ওয়াশিংটন পোস্ট, এপি থেকে রয়টার্স—সবাই ইসরায়েলি প্রচারণার কনভেয়র বেল্টে পরিণত হয়েছে, যুদ্ধাপরাধকে সাফসুতরো করেছে, ভিক্টিমকে ডিহিউম্যানাইজ করেছে, নিজেদের সহকর্মীদের পরিত্যাগ করেছে, সত্য ও নৈতিক সাংবাদিকতার প্রতিশ্রুতি ত্যাগ করেছে।’
ভ্যালেরি জিঙ্ক লিখেছেন, ইসরায়েলের জেনোসাইডমূলক মিথ্যা প্রচারণা কোনো যাচাই ছাড়াই বারবার প্রচার করে—সাংবাদিকতার ন্যূনতম দায়িত্ব থেকেও ইচ্ছাকৃতভাবে সরে এসে—পশ্চিমা মিডিয়া এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যেখানে মাত্র দুই বছরের মধ্যে এক ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কোরিয়া যুদ্ধ, ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, যুগোস্লাভিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ মিলিয়েও যত সাংবাদিক নিহত হয়নি, তার থেকেও বেশি সাংবাদিক হত্যা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি তারা একটি পুরো জনগোষ্ঠীকে দুর্ভিক্ষের মুখে ঠেলে দিয়েছে, শিশুদের ধ্বংস করেছে ও মানুষকে জীবন্ত আগুনে পোড়াচ্ছে।
গত ১০ আগস্ট আল-জাজিরার সাংবাদিক আনাস আল-শরীফসহ অন্যদের টার্গেট কিলিং নিয়ে ভ্যালেরি জিঙ্ক লিখেছেন, ‘আনাস আল-শরীফের কাজ রয়টার্সের জন্য পুলিৎজার পুরস্কার এনে দিলেও, যখন ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী তাকে তথাকথিত ‘হিট লিস্টে’ তুলে ধরেছিল—যেখানে সাংবাদিকদের হামাস ও ইসলামিক জিহাদের সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল—তখনো রয়টার্স তার পক্ষে দাঁড়ায়নি।’
গাজায় হাসপাতালে হামলার ঘটনায় ট্রাম্প বললেন, ‘আই অ্যাম নট হ্যাপি’গাজায় হাসপাতালে হামলার ঘটনায় ট্রাম্প বললেন, ‘আই অ্যাম নট হ্যাপি’
আনাস আল-শরীফ তাঁকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের কাছে আহ্বান জানিয়েছিলেন। আনাসকে যে ইসরায়েল হত্যা করতে চায়, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র এক ভিডিওতে তা স্পষ্ট জানিয়েছিল। ভ্যালেরি জিঙ্কের অভিযোগ, ‘তখনো রয়টার্স তাঁর (আনাসের) পাশে দাঁড়ায়নি। এমনকি কয়েক সপ্তাহ পরে যখন তাকে অনুসরণ করে হত্যা করা হলো, তখনো তারা তাঁর মৃত্যু নিয়ে সৎভাবে প্রতিবেদন করেনি।’
ফেসবুক স্ট্যাটাসের সঙ্গে রয়টার্সের দেওয়া নিজের প্রেস কার্ড ভেঙে দুই টুকরো করে তার ছবি সংযুক্ত করে দিয়েছেন ভ্যালেরি জিঙ্ক। স্ট্যাটাসের শেষাংশে লিখেছেন, ‘গত আট বছরে রয়টার্সে আমার কাজকে আমি মূল্যবান মনে করেছি। কিন্তু এখন এই প্রেস কার্ড গলায় ঝোলানো আমার কাছে ভীষণ লজ্জা ও বেদনার বিষয় ছাড়া আর কিছু নয়। গাজার সাংবাদিকদের সাহস ও আত্মত্যাগকে সম্মান জানানো শুরু করার মানে কী, আমি জানি না—তারা ইতিহাসের সবচেয়ে সাহসী ও শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক। তবে এখান থেকে আমি আমার সামর্থ্যের প্রতিটি অবদান সেই চিন্তা সামনে রেখে পরিচালিত করব।’