বারবার সংঘর্ষ ঢাকা-সিটি-ধানমন্ডি আইডিয়াল শিক্ষার্থীদের, নেপথ্যে তৃতীয় পক্ষ?
- ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫:৩৫
রাজধানীর স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম ঢাকা কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ ও ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজ। এ তিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি, ৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি ও ১৮ মার্চ এই তিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দ্বিমুখী ও ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় বহু শিক্ষার্থী ও পথচারী আহত হন। সর্বশেষ গত সপ্তাহে একটি কোচিং সেন্টারে ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে ক্লাস করতে গিয়ে আইডি কার্ড নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। ওই দিন শিক্ষার্থীদের মধ্যে চড়-থাপ্পড় দেওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনা নিয়ে পরবর্তী সময়ে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করে। এরই সূত্র ধরে গত বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একাডেমিক ও গবেষণা নিয়ে প্রতিযোগিতা হওয়া উচিত। কিন্তু ঘটছে উল্টোটা। কোনোভাবে শিক্ষার্থীদের মাইন্ড সেটআপ করে দেওয়া হয়েছে যে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে মারামারিতে জড়াতে হবে এবং জিততে হবে। এই তিন কলেজের দ্বন্দ্বের শুরুটা কোথায়, তা কেউ জানাতে পারেননি। তবে নেপথ্যে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে কাজ করছে বলে ধারণা কলেজ কর্তৃপক্ষের। স্থানীয় কিছু বখাটে ছেলে এটা করে থাকে বলে তারা মনে করছে। তবে এ পক্ষকে সামনে আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উদাসীন বলে দায়ী করছে তারা। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, এসব ঘটনায় তৃতীয় পক্ষ শিক্ষার্থীদের ভুল বুঝাচ্ছে কি না, সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। খুব দ্রুতই বিষয়টির স্থায়ী সমাধান করার কথাও বলছে তারা।
জানা যায়, রাজধানীর ঢাকার সায়েন্স ল্যাব মোড়ের কাছে এক কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে অবস্থিত তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—ঢাকা কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ ও ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজ। একাডেমিক বিষয় নয়, বিগত কয়েক বছরে এ তিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন সংঘর্ষে জড়িয়ে। প্রতিটি ঘটনার পর বলা হয়, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ও তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে ঘটেছে। অনলাইনে কলেজ দুটির শিক্ষার্থীরা প্রায়ই পরস্পরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। তবে বিবাদ-দ্বন্দ্ব থেকে রাস্তায় নেমে পড়লেই দুটি পক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। খুব কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ায় শিক্ষার্থীরা মুখোমুখি হন বারবার।
ঢাকা ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সম্প্রতি একটি কোচিং সেন্টারের আইডি কার্ডকে কেন্দ্র করে উভয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই বৃহস্পতিবার উভয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হওয়া ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থী অন্তর দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমরা তিন বন্ধু প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা শেষে রিকশা করে হলে আসছিলাম, তখন এক সিগন্যালে দেখলাম কিসের যেন ঝামেলা হচ্ছে। সিগন্যালে পৌঁছানো মাত্র সিটি ও আইডিয়াল কলেজের ২০০ থেকে ৩০০ শিক্ষার্থী আমাদের ঘিরে ফেলে। তখন আমরা বারবার রিকুয়েস্ট করছিলাম, আমরা মাত্রই পরীক্ষা দিয়ে আসতেছি। এ বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। পরীক্ষা দিয়ে আসার যাবতীয় কাগজ দেখিও রক্ষা হয়নি।’
ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘একপর্যায়ে আমাদের কিল, ঘুসি, লাথি তো মারছেই, শেষে রড দিয়ে পেছন থেকে আমার মাথায় আঘাত করে। পরে পপুলার হাসপাতালে নিয়ে যায় আমার মাথায় কয়েকটি সেলাই লেগেছে। কালকে আমার সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল, আমি ঢাকা কলেজের ড্রেস পরে ছিলাম। আমাকে যারা মেরেছে, তাদের আমি কখনোই দেখিনি। আমার দুই বন্ধু সিয়াম ও ফাহিমও আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে।’
সংঘর্ষের পর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম বলেন, ‘এ বিষয় নিয়ে আমরা এর আগেও আলোচনা করেছি। কিন্তু এবার আলোচনা করতে হবে, কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটে, এর মূলে যেতে হবে। এই দুই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কারণে জনগণকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। তারা যখন মুখোমুখি অবস্থান নেয়, তখন যে কোনো ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। আমরা এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান চাই।’
জানতে চাইলে আজ শনিবার (২৩ আগস্ট) ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াস দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘দু-একজনের সঙ্গে ঝামেলা লেগে পরবর্তী সেটা সংঘর্ষে রূপ নেয়। আগের সংঘর্ষগুলোর পরে আমার মিটিংয়ে শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে সমাধান করার চেষ্টা করেছি। আসলে আমাদের হাতে এটা ছাড়া তেমন কিছু করার নেই। আগামী রবিবার বা সোমবার আমরা আবার বসার চেষ্টা করছি। পুলিশের ডিসিকেও এই বিষয়ে জানানো হয়েছে।’
সিটি কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক কাজী নিয়ামুল হক শনিবার দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘উদ্ভাস কোচিংয়ে গিয়ে হাতাহাতিকে কেন্দ্র করে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত। তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে এমন ঝামেলা আমরা আর পুনরাবৃত্তি চায় না। আগামীকাল রবিবার (২৪ আগস্ট) বিকেল চারটায় তিন কলেজের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বসবে। আশা করি, কোনো একটা সমাধান বের হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তৃতীয় পক্ষ এ ঝামেলায় কাজ করে কি না, সেটা আমরা খতিয়ে দেখছি। স্থানীয় কিছু বখাটে ছেলে এটা করে থাকতে পারে। গোয়েন্দা সংস্থা চাইলে বের করতে পারে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শক্ত ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু সেটা আমরা দেখছি না।’
নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম মাহফুজুল হক শনিবার দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কোমলমতি শিক্ষার্থীরা হয়ত অনিচ্ছাকৃতভাবে বারবার এমন কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে, ফলে সাধারণ জনগণের ভোগান্তি তৈরি হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘এখন আমরা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেখছি। কয়েক দিন পরপর এমন ঝামেলা সৃষ্টি হলে শুধু ভোগান্তি নয়, অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতিও হয়। তাই আমরা এখন সমস্যাটিকে স্থায়ীভাবে সমাধান করার জন্য কাজ করছি।’
তৃতীয় কোনো পক্ষ এ ঘটনায় জড়িত কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নজরদারি করছেন। তৃতীয় পক্ষ শিক্ষার্থীদের ভুল বুঝাচ্ছে কি না, সেটিও আমরা খতিয়ে দেখছি। খুব দ্রুতই আমরা কলেজগুলোকে সঙ্গে নিয়ে বিষয়টির স্থায়ী সমাধান করার করব।’